সংগ্রামী লাহিড়ী নিউ জার্সির বাসিন্দা, বৃহত্তর নিউইয়র্ক বলা যায় |
পরিচয় - শিক্ষায় প্রযুক্তিবিদ, পেশায় কন্সাল্ট্যান্ট, নেশায় লেখিকা | শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়ে বহুকালের সিরিয়াস চর্চা আছে, অল ইন্ডিয়া রেডিওর A গ্রেড শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী | উত্তর আমেরিকায় করোনা ভাইরাসের এপিসেন্টারে বসে বদলে যাওয়া প্রবাস-জীবনের ডায়রী লিখছেন |
করোনা-ধারায় এসো – 12
অর্ধেক আকাশ – পর্ব ১
আজ এই অগাস্ট মাসের ছাব্বিশ তারিখে, বুধবারে কাজের দিনে আমার ইমেলে হঠাৎ সকাল থেকে শুভেচ্ছার বন্যা বয়ে গেল| কত ওয়েবইনার আমার সুমধুর বাণী শোনবার প্রতীক্ষায় আছে, কত অর্থনীতিবিদ, সমাজতাত্ত্বিক, লাইফস্টাইল-বিশারদ আমার সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য অর্জন করতে চান, তার আর ইয়ত্তা নেই|
কিছুক্ষণ পর শেষমেশ আমার কর্পোরেট প্রভু অন্তর্জালে আমায় ট্যাগ করলেন| তাঁরা নাকি ধন্য হয়েছেন নাচবার জন্য আমায় সমান মাপের একটি উঠোন দিতে পেরে| আজ নাকি ওম্যান’স ইকুয়ালিটি ডে!
আরো বোকা ব’নে গিয়ে পুত্রের শরণাপন্ন হলাম| সে তখন সবে এক কাপ কফি নিয়ে বসেছে| তার মতে আমি এদেশে বুদ্বুদে বাস করি| চারদিকের হালহকিকতের কোনো খবরই রাখি না|
কথাটা মিথ্যে নয়| সে এদেশে স্কুলকলেজে গেছে, পপুলার কালচার নিয়ে অনেক বেশি ওয়াকিবহাল|
ইমেল দেখে সে মন্তব্য করলো, “এতো বছর ধরে তুমি ছেলেদের সঙ্গে সমানে সমানে কাজ করেছো, এতদিনে তোমার প্রভুর খেয়াল হয়েছে যে তুমি সমান|”
আমি অথৈ জলে|
সে দয়াপরবশ হয়ে আমায় উদ্ধার করলো, “এদেশের কনস্টিটিউশনের সেই ঐতিহাসিক নাইন্টিন্থ অ্যামেন্ডমেন্ট হয়েছিল আজকের দিনে, মানে এই ছাব্বিশে অগাস্ট, উনিশশো কুড়ি সালে| আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে আমেরিকান মেয়েরা ভোটের অধিকার পেল| তারই সেন্টেনারি আজ, তাই জেন্ডার ইকুয়ালিটি নিয়ে এতো হৈচৈ|”
আমি হাঁ “একশো বছর পরে আমাকে আলাদা করে appreciate করছে? তাহলে একশো বছরে কিছুই এগোয় নি বল? তা হঠাৎ এত আদিখ্যেতা? “
পুত্র হাসলো, “আচ্ছা মা, কলকাতায় যে এতবছর পড়াশোনা করেছো, চাকরি করেছো, তোমার জীবনের আদ্ধেকেরও বেশি কেটেছে তৃতীয় বিশ্বে| কোনোদিন কি তোমার মনে হয়েছে যে তুমি মেয়ে?“
অবাক হই, “না তো? মনে করতেও চাই নি| স্কুলে কলেজে, চাকরিতে ঢুকে কে ছেলে আর কে মেয়ে? কাজ খারাপ হলে একই রকম ধাতানি খেয়েছি| মেয়ে বলে কেউ কোনোদিন রেয়াত করে নি|”
“ঐখানেই তো মজা| তোমরা যা বোঝোনি, এদেশের মেয়েরা তা হাড়ে হাড়ে টের পায়|”
“তা বটে| শুনেছি এদেশে একই কাজের জন্যে ছেলে আর মেয়েদের আলাদা আলাদা মাইনে| এসব তো আমরা ভাবতেও পারিনে|” আমার সুচিন্তিত মতামত|
পুত্র বললো, ” চাকরি পর্যন্ত অতো দূরেও যেতে হবে না, তার আগেই স্কুল কলেজে দেখেছো কি ‘ওম্যান ইন স্টেম’ ক্যাম্পেইন? আমি এদেশে যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করি, প্রথম প্রথম খুব আশ্চর্য লাগতো| মেয়েদের সায়েন্স, অঙ্ক আর টেকনোলজি পড়াবার জন্যে এতো চেষ্টা? আমি তো বরাবর দেখেছি বাড়িতে সবাই সায়েন্সের লোক| তুমি রেডিওফিজিক্স পড়েছো, কাকিমা ডাক্তার| কোনোদিনই তো মনে হয়নি তোমরা খুব স্পেশাল? বাবা-কাকাও যেমন, তোমরাও তেমনি|”
সায় দিলাম, “সে তো একশোবার| তোর দিম্মা-ই তো সারাজীবন সংসার করে স্কুলে পড়িয়ে এলো| এ সব আমাদের কাছ খুব স্বাভাবিক|”
পুত্র বললো, “তাই তোমার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, এদেশের মেয়েদের ভোটিং রাইট কত কষ্ট করে পেতে হয়েছে|”
বলেই বললো, “আমাদের পলিটিকাল সায়েন্সের প্রফেসর ক্যাথির কথা তোমার মনে আছে মা?”
মনে ছিল| পুত্রই বলেছিলো| সে এক কাহিনী|
ক্যাথি ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন| সেখানে পাঠ্যক্রম অনেকটাই উদারপন্থী| ক্যাথির অনেকদিনের সাধ আমেরিকার এই লিবারেল আর্টস কলেজে তাঁর ডিপার্টমেন্টে একটি গ্লোবাল ফেমিনিজম ক্লাস চালু করেন| কিন্তু যতবার তিনি প্রস্তাবটি পাড়েন, ততবারই নাকচ হয়ে যায়| পুরুষ সহকর্মী তো বটেই, মহিলা অধ্যাপকদেরও তাতে প্রথম প্রতিক্রিয়া হয় – “পলিটিক্যাল সায়েন্সে ফেমিনিজম এর ক্লাস মানে সময় নষ্ট|”
ক্যাথি দমবার পাত্রী নন, লড়ে গেলেন, “ইউরোপের প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয় ফেমিনিস্ট স্টাডির ওপর ডিগ্রি দেয় | আর আমরা সামান্য একটা ক্লাস চালু করতে পারবো না?”
এবার উত্তর এলো, “তুমি যদি মেয়েদের অধিকার-টধিকার নিয়ে মাথা ঘামাতে চাও, তাহলে সরি, এ দেশটা তার জায়গা নয়| আমরা তেমন মেয়েদেরই পছন্দ করি যারা ভালো স্যান্ডউইচ বানাতে পারে|”
এ পর্যন্ত শুনে আমি বাকরহিত হয়েছিলাম মনে আছে| তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বে জন্মেও এমন উক্তি আমি কোনোকালে শুনিনি|
ক্যাথি অবশ্য হাল ছাড়েন নি, গ্লোবাল ফেমিনিজম ক্লাস ঢুকিয়েই ছেড়েছিলেন|
ওই গ্লোবাল ফেমিনিজম ক্লাসে যে গুটি পাঁচেক পড়ুয়া পড়তে এসেছিলো, তার মধ্যে পুরুষজাতির একমাত্র প্রতিনিধি ছিল – আমার পুত্র|
ভোটাধিকারের একশো বছর পরেও ফেমিনিজম পড়াতে গেলে যে সব মন্তব্য শুনতে হয়, ক্যাথি তাঁর ক্লাসের পাঁচটি পড়ুয়ার সঙ্গে তা বড় দুঃখেই ভাগ করেছিলেন|
ক্যাথির ভক্ত ছিল আমার পুত্র| ক্যাথিও তাকে একটু বিশেষ চোখে দেখতেন| হাজার হলেও ক্লাসে জেন্ডার ডাইভার্সিটি এনেছে সে!
সে স্মৃতিচারণ করে আমার সুচিন্তিত মতামত, “তৃতীয় বিশ্ব তাহলে মেয়েদের সমানাধিকারে এগিয়ে আছে বল?”
পুত্র জোরগলায় বললো, “নিশ্চয়ই| একবার ভেবে দ্যাখো, সেই একশো বছর আগে যখন পৃথিবীতে স্প্যানিশ ফ্লুর মহামারী, তখন আমেরিকায় গুটিকয়েক মেয়ের লড়ে গিয়েছিল, ভোটের অধিকার চেয়ে| ঠিক যেন আজকেরই ছবি, একশো বছরের ফ্ল্যাশব্যাকে|”
বললাম, “অথচ দ্যাখ, ভারতে কিন্তু মেয়েদের ভোটাধিকার এসেছে স্বাধীনতারও আগে| উনিশশো উনিশ থেকে ঊনত্রিশের মধ্যেই পুরো কলোনিয়াল ভারতের মেয়েরা ভোট দিতে পারে, নির্বাচনে লড়তে পারে, পার্টিতে উচ্চপদে থাকতে পারে| ইংরেজিতে যার নাম ‘অফিস হোল্ড করা’|”
এসব পৃথিবীর বহু দেশেই তখন কল্পনাও করা যেত না|”
“তুমিই তো বলেছিলে মা, স্বাধীনতার কুড়ি বছরের মধ্যেই ভারতে মহিলা প্রধানমন্ত্রী তাঁর কিচেন ক্যাবিনেট নিয়ে তৈরী ছিলেন| মোটামুটি একই সময়ে আরও দু’জন মহিলা বিশ্বের আরো দু’টি দেশের কর্ণধার| ইসরায়েলে গোল্ডা মেয়ার, শ্রীলংকায় সিরিমাভো বন্দরনায়েক খবরের কাগজে হেডলাইন| ভালো মন্দ বিচারে যাচ্ছি না, কিন্তু কত আগেই তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বে মেয়েরা সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত|” পুত্রের মনে আছে|
পরিবেশটা একটু হালকা করতে চাইলাম| বড্ডো গুরুগম্ভীর হয়ে গেছে|
“এ ছবি তো এখানে চোখে পড়লো না এখনো, কখনো সত্যি এমনটা হবে কি না তাই বা কে জানে| বাদ দে সে কথা| ভেবে দেখেছিস কি, একশো বছর আগে একটা প্যানডেমিকে এদেশের মেয়েদের ভোটাধিকার মিললো, আর একশো বছর পর আরেক প্যানডেমিকে আজকের দিনে আমি পেলাম woman appreciation”.
পুত্র কান দিলো না, “জানো মা, সামান্য একটা ফেমিনিজমের ক্লাস চালু করতে চেয়ে ক্যাথির এই যে দীর্ঘদিনের লড়াই, – আমি বরাবর ভেবে আশ্চর্য হয়েছি, কোথা থেকে ক্যাথি পেয়েছেন এতো ধৈর্য, এতো সহনশীলতা| শেষে একদিন উত্তরটা পেলাম| ক্যাথির রক্তেই যে উত্তরাধিকার|”
আমি উৎসুক, “কীরকম?”
“সে এক লম্বা গল্প, পরের দিন বলবো| তুমি এবার কাজে ফেরত যাও| মিটিঙে না ঢুকলে তোমায় মেয়ে বলে কেউ ছেড়ে কথা বলবে বলে তো মনে হয় না| সে যতই আজ ওম্যান’স ইকুয়ালিটি ডে হোক না কেন|”