মার্গে অনন্য সম্মান শিপ্রা মুখার্জি (সর্বোত্তম)

অনন্য সৃষ্টি সাহিত্য পরিবার

পাক্ষিক প্রতিযোগিতা পর্ব – ২২
বিষয় – নারী স্বাধীনতা

স্বনির্ভর

ট্রেন্ড ফ‍্যামিলী কাউন্সেলর।
একে শীতের রাত তায় অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে।বাইরে লোকজন নেই।অলকা বোস এর ঘুম আসে না শুয়ে এপাশ ওপাশ করছেন তিনি। স্বামী অনিল বোস বললেন——কি হলো,ঘুম আসছে না? অলোকা বললেন—না গো।কি ভাবে যে মেয়েটাকে মেরেছে ভাবতে পারবে না।সারা পিঠে লাল লাল দাগ।
অনিল বাবু বলেন —-একেবারে পশু। এখানে থাকে কেন?
অলোকা বলেন —যাবে কোথায়?তাছাড়া ছাড়বে ও
না ওকে।
অনিল বাবু বলেন —তোমার জানা শোনা অনেক
হোম আছেতো।সেখানে পাঠিয়ে দাও।থানা পুলিশ
করলেতো মহিলা কে আটকে রাখবে।
অলোকা বলেন—-ওসব না ভেবে অন্য কথা ভাবতে
হবে।যাতে ওকে স্বনির্ভর করা যায়।কারো দয়ায় যাতে
বাঁচতে না হয়।
অনিল বাবু বললেন—কি করতে চাও?তোমার নিজের
সংগঠনে কি কিছু করতে পারো?
অলোকা বললেন—-দেখি কি করা যায়।গুন গুন
করে গান গায় মাঝে মাঝে।গলার সুরটা মিষ্টি।আমাদের
কাজে লাগতে পারে।তবে ওর জেঠিমা ছাড়বে না।
————
সেই মেয়ের নাম মনিকা।ডাক নাম মনি।এখানে ও
বাড়িতে সবার মুখে একটাই নাম “বাপ মা খেকো মেয়ে”। বাপ মা কে মনি খেতে পারে?ও বাড়িতে এর
ওর মুখ নাড়া খেয়েই বড়ো হচ্ছে।এখন বয়স বারো।
তিন দিদি আর দুই দাদার সবচেয়ে ছোট ভাই ছিল
মনির বাবা।সব বাড়িতে ঘুরে ঘুরে শেষ অবধি ঠাঁই
হয়েছে কোলকাতায় বড়ো জেঠুর বাড়িতে।জেঠুর মেয়ে তনু দিদি আর ফুলু দিদি স্কুলে পড়ে।মনির ও স্কুলে যাবার ইচ্ছে।সে কথা শুনে বড়োমা খুব রাগ করেছে। তবে রাগ করে বলেছে,গরীবের ঘোড়া রোগ।
সেই থেকে বড়ো মা অত‍্যাচার শুরু করেছে।ছাতে গিয়ে
লুকিয়ে কাঁদতো মণি।
সেদিন দুপুরে বড়োমা টি ভি দেখছিলেন বাইরের ঘরে।
মণির রোজের কাজ ছিল খাওয়ার পর এঁটো বাসন
মেজে রাখা। মনির বাসন মাজা শেষ হতে মনি জেঠুর ঘরে গেল।মনটা ভালো না লাগলে মনি জেঠুর কাছে
যায়।জেঠুর মাথার কাছে মাটিতে বসে বললো—জেঠু,
আমি বাড়ি যাব।
জেঠু বললেন—কেনরে?এখানে ভালো লাগছে না?
মনি বলল —— ঠাকুমার কাছে যাব।
জেঠু বললেন—–দিদিদের সাথে স্কুলে যাবিনা?
ঠিক তখনই বড়োমা শোবার ঘরে ঢুকলেন।
জেঠুকে বলেন—-আদরের ভাইঝি কি বলছে?ঠিক আছে তনুকে বলবো স্কুলে ভর্তি করে দিতে।
মনির চোখ চকচক করে উঠলো।ভাবলো বড়ো মা রাজি হয়ে গেল? কিন্তু বড়ো মায়ের ঘর অবধি যেতে হলো না।তার আগেই হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেলেন নিজের ঘরে।দরজা বন্ধ করে মারতে লাগলেন তিনি।পাখার ডাঁটের দাগে ভরে গেল পিঠ।মনির কান্নায় জেঠু দরোজায় ধাক্কা দিলেন।
বললেন– হচ্ছে টা কি ?তুমি কি মেয়েটাকে মেরে
ফেলবে?
বড়োমা মনির মুখ চেপে ধরলেন।বললেন—একেবারে
টু শব্দ করবি না।আবার পড়ার কথা শুনলে দেখ তোকে
কি করি।
সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।নিঃশব্দে ছাতে উঠে গেছে মনি।এই একটা জায়গায় বুক হালকা করে কাঁদা যায়।
——কি রে কাঁদছিস কেন?জেঠী বুঝি আবার মেরেছে?
আঁতকে ওঠে মনি।মিসেস বোস মনির পেছনে দাঁড়িয়ে।
——–এ কী।তোর ঘাড়ে এতো দগ্ দগে ঘা কিসের?
নিশ্চয়ই তোর জেঠীর কাজ!ছি ছি!! ওকী মানুষ!!
মনি বলে ওঠে—না গো,।
মিসেস বোস থামিয়ে দেন মনিকে।
বলেন—-চুপ কর।আমার সব জানা আছে।
কথা শেষ না করে নিচে নেমে যান ।
মনি কাঁধের ব্যথা জায়গায় হাত দেয়।হাতে রক্তের
ছাপ।ভাবে ওর ওপরে জেঠীর এতো রোখটোক কেন?
দিদিরা তো বেশ পড়াশুনো করছে।অথচ ওর বেলা এতো জেদ।মনির ইচ্ছে ফুলু দিদি আর তনু দিদির মতো জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। দিদিরা স্কুলে যায়।মনির দিন কাটে ঘরে।বাইরে পা দেওয়া একেবারে বারণ।পৃথিবীর আলো দেখতে পায় ছাদে এলে।তাও এটা ওটা মেলতে এলে। মনটা হু হু করে ওঠে। কেঁদে বুক হালকা করে মনি।দেশের জন্য,ঠাকুমার জন্য মন খারাপ লাগে।একমাত্র ঠাকুমাই মনিকে ভালোবাসে। মায়ের কথা মনে পড়ে।মা থাকলে মনির এত কষ্ট হতো না। মনে হয় দু’খানা পাখনা থাকলে মায়ের কাছে উড়ে চলে যেত মনি। হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে মনি।
—–মা গো তুমি আমায় নিয়ে যাও।
আবার বোস মাসীমা ছাতে এসেছেন।
——কি রে এখনও নামিস নি নিচে?বুঝেছি,তোর বড়
মা বুঝি খুব মেরেছে?
ভয় পেয়ে গেল মনি। কি জানি জেঠীমা যদি জানতে
পেরে যায়?তাই বলে—–না গো মাসীমা বড়মা আমায়
বকে না।
মিসেস বোস বলেন—–আর বলতে হবে না।সব জানি।
ইস্ কাঁধ থেকে রক্ত জামায় ভরে গেছে।দেখি তোর জন্য
কি করতে পারি।এ ভাবে কেউ মারে?
ভয় পেয়ে মনি বলল—-না গো বড় মা কে তুমি কিছু
বলবে না।আমি পড়তে চাইলে জেঠীমা আমাকে মারে।
মিসেস বোস বললেন—-তুই ভয় পাস না।আমি এসব
বলবো না।দেখি কি করা যায়।
তবুও মনি ভয়ে ভয়ে থেকেছে। দু দিন পর মিসেস
বোস এসে হাজির হয়েছে। বোস মাসীমাকে দেখে
মনি রান্না ঘরে ঢুকে গেছে।
মনির বড় মা বেশ সমাদরেই মিসেস বোসকে বসালেন।রান্না ঘর থেকেই মনি লক্ষ্য করছিল সব কিছু।
বড়ো মা বললেন—-বোসদি এতোদিন পর ছোট বোনকে মনে পড়লো?
মিসেস বোস বললেন—-আরে রোজই মনে পড়ে। কষ্ট
হয় তোর জন্য। নিজের দুটো আবার মা বাপ খেকো
আর একটা জুটেছে। বোঝা একটা।
বড়ো মা বললেন—-ঠিক বলেছেন।
মিসেস বোস বলেন——বলি কি ওকে একটা কাজ
জুটিয়ে দেই।বোঝাটাও হাল্কা হবে আর মাস গেলে
তোর হাতে ও কিছু টাকাও আসবে।
বড়োমা বলেন—–ওর জ্যাঠা কি রাজি হবে?
বোস মাসীমা বলেন—–কাজের কথা বলবি না।বলবি
আমি ওকে দিয়ে গান করাবো।
বড়োমা বলেন——আপনার সংগঠনে?
বোস মাসীমা—-হ্যাঁ রে বাবা।আমার সাংস্কৃতিক
সংগঠনে নেবার কথা বলবি।মেয়েগুলো খাওয়া দাওয়া
করে তো তাই কাজের লোক দরকার। এখন পাঁচ শো টাকা পাবি।
রান্না ঘর থেকে মনি সব শুনেছে।বড়োমার গদো গদো
হাঁসি দেখেছে।মনির কান্না উথলে উঠেছে।এতোদিন
বাড়ির ঝি ছিল ,এবার পাকাপাকি ঝি গিরিতে নাম
লেখানো হলো।মনির চোখে জল এসে গেল।বোস
মাসীমাকে এতোদিন ভালো ভেবেছিল মনি।সে ও মনিকে মা বাপ খেকো বলল!কে বলবে এই মাসীমাই
ছাতে লুকিয়ে লুকিয়ে এটা ওটা খাওয়াতো।
বড়োমাকে বোস মাসীমা বললেন—–সেই মেয়ে কোথায়?
বড়োমা মনিকে ডাকলেন।এ সুর মনির সম্পূর্ণ অচেনা।
—–এই মনি এ দিকে আয়।
কোন কথা না বলে মনি বোস মাসীমার দিকে এগিয়ে গেল।
ওকে দেখে মাসীমা বললেন—-কাল সকাল দশটায়
আমার ওখানে যাবি।ওখানেই খাবি।সব মেয়েরা খায়।
মনি বড়োমার দিকে চেয়ে রইল। বড়োমা বলেন।
——তোর ভাগ্য ভালো ।বোসদির পায়ে ঠাঁই হলো।কত
বড় সংগঠন বোসদির।
এবার বোস মাসীমা বললেন—-কেবল বসে বসে
খেলে হবেনা কাজ ও করতে হবে।ঘরের কাজ।
বোস মাসীমা মনিকে এমন কথা বলতে পারেন তা
মনি ভাবতে পারেনা।বোস মাসীমার কথায় কান্না উথলে উঠছে মনির। কিন্তু এখন ছাতে গিয়ে কাঁদার
উপায় নেই। কারণ বোস মাসীমাও বড়োমার মতো
হয়ে গেছেন।
পরদিন বোস মাসীমার ফ্ল্যাটে যাবার আগে বড়োমা
বলে দিল—-সাবধান , তোর জেঠু যেন জানতে না
পারে।
বেলা দশটায় মনি ,বোস মাসীমার ফ্ল্যাটে গেল। ওরই
বয়সের মেয়েরা কেউ নাচ করছে, আবার কেউ গান করছে। মনি সোজা বোস মাসীমার রান্না ঘরে ঢুকলো।
দেখলো সব বাসন মাজা হয়ে গেছে।
মনি চুপি চুপি বললো—-বাসন তো মাজা হয়ে গেছে।
আমি কি করবো?
মাসীমা হাসতে হাসতে বললেন—তোকে দিয়ে আমি কাজ করাবো নাকি?তোর বড়ো মা কে কাজের কথা না বললে তোকে ছাড়তো না। বুঝেছিস?বনানী এদিকে
আয় তো।
বনানী এসে দাঁড়ালো।—–কি দিদি?
মাসীমা বললেন—-ওকে ভালো করে পড়াবি তুই।
মনি বললো—-তুমি যে বড়োমা কে টাকা দেবে বললে?
কোথা থেকে দেবে?
মাসীমা বললেন—-দেব তো। তোর বড়োমা টাকার
লোভেই তোকে ছেড়েছে। কোথা থেকে দেব?সংগঠন
ফাংশন করে সারা বছর আয় করে। সে গুলোই তোর
মতো মেয়েদের জন্য খরচ করি।
মনি বলল—আমায় কেন দেবে?
——তোর গানে গলা আমি শুনেছি। একদিন তুই
অনেক টাকা আয় করতে পারবি।
চোখে জল এসে যায় মনির। এমন একজন মানুষকে
মনি খারাপ ভেবেছিল!!
——-তবে মনে রাখিস যতোদিন না আসরে গান গেয়ে তোর প্রথম আয় হয় ততো দিন তোর বড়োমার কাছে আমার কাজের লোক তুই। কেউ যেন আসল কথা জানতে না পারে। নিজে টাকা আয় করে স্বনির্ভর
হয়ে তবে সবাইকে জানাবি।
মনি বললো—-স্বনির্ভর কি গো মাসীমা?
মাসীমা বললেন—-যে নিজের আয়ের ওপর নির্ভর
করে বাঁচতে পারে।সেই স্বনির্ভর।কারও পয়সার
জন্য হাঁ করে বসে থাকতে হবেনা।বুঝলি?
মনি বললো—-মাসীমা গো আমার ঠাকুমা ঐ কথা
বলেই কাঁদতো। একটা চিঠি লিখে দেবে গো আমার
ঠাকুমাকে?
মাসীমা বললেন—–না। নিজে লিখতে শিখে লেখো
ঠাকুমাকে। তখন ঠাকুমাকে লিখে জানাবে যে তুমি
স্বনির্ভর হয়েছ।
অনেক বছর পার হয়ে গেছে। মিসেস অলকা বোস
মারা গেছেন।এখন “সঙ্গীত নৃত্য কলাকেন্দ্র” যার দ্বারা
পরিচালিত হচ্ছে তিনি মিসেস অলকা বোসের সুযোগ্যা
ছাত্রী শ্রীমতী মনিকা মিত্র।
আজ “সঙ্গীত নৃত্য কলা কেন্দ্রে”র রজত জয়ন্তী উৎসব।
মাইকে ঘোষিত হলো—আজকের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সন্ধ্যায় মঞ্চে আসছেন এই সমাজ সেবী
কেন্দ্রের অধ্যাপিকা শ্রীমতী মনিকা মিত্র (ওরফে সেই ছোট্ট মনি।)
মঞ্চের পর্দা সরে যেতে চোখে পড়লো বড়ো বড়ো
তিন খানা ছবি।তাতে ফুলের মালা পড়ানো হয়েছে।
মনিকা মিত্র তিন খানা ছবির সাথে দর্শকদের পরিচয়
করিয়ে দিলেন।
“ইনি অলকা বোস।আমার গুরু বলুন,দেবতা বলুন,
সবই এই মাঝের জন।তাঁকে আপনারা যেভাবে
চেনেন আমি একটু অন্য ভাবে চিনি।ইনি আমায়
কন্যা সম স্নেহে টেনে নিয়েছিলেন।তাঁর দরদী মনের
জন্যই আজ আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি।নইলে
আমার পরমাত্মীয়ার কাছে আজ অবধি কাজের
লোক হিসাবে আমার পরিচিতি হতো।
এঁর দু পাশে যাদের ছবি রয়েছে তাঁরা আমার
জন্মদাতা পিতা ও মাতা।
আর ও একজনের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে
দিতে চাই।তিনি অলকা বোস এর স্বামী মধুবোস।
মাসীমা মারা যাবার পর মেশোমশায় এইসংস্থা চালনা
করছেন এবং আমাদের পিতৃ স্নেহ থেকে বঞ্চিত
করেন নি।তিনি এবার মঞ্চে আসছেন।এরপরই
নৃত্যনাট্য নটীর পুজা শুরু হবে একটু ধৈয্যধরে
অপেক্ষা করুন।
দর্শকদের হাত তালিতে মঞ্চের পর্দা পড়ে গেল।
অপেক্ষা দর্শকদের করতেই হবে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।