সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি ( পর্ব – ২১)

রেকারিং ডেসিমাল 

এই পরিবারে এসে নতুন বউ অনেক কিছু নতুন নিয়ম কানুন শিখছে। নিজের বাড়ির শান্তিপুর কৃষ্ণনগর ছোঁয়া নবদ্বীপের রীতিনীতি, যাকে ঘটি বাড়ির নিয়ম বলা হয় এখন, বা মামাবাড়ির ফরিদপুর কুমিল্লার কুলীন মুখোপাধ্যায় বাড়ির গোঁড়া ব্রাহ্মণ্য আচার, রীতি, যাকে কলকাতা শহরে বাঙাল ধরন বলা হয়, তার সাথে এ বাড়ির চলাফেরার অনেক তফাত।
মায়ের এবং বাবার পরিবারের পুরুষদের ব্রাহ্মণ বলে এক অন্যরকম অহংকার দেখে বড় হয়ে এসেছে নতুন বউ। সে জানে উপবীত পড়ে থাকে যারা তারা শাস্ত্র মেনে চলা কঠিন মানুষ। তারা গণ্ডুষ করে ঈশ্বরকে স্মরণ করে পঞ্চভূতের কল্যাণে খাদ্য দান করে তবে অন্ন মুখে দেয়। তারা উচ্ছিষ্ট গ্রহণ করে না। যে কোন পূজাঅর্চনায় তারাই উপবাস আর কৃচ্ছসাধন করে সবচেয়ে বেশি। কারণ পূজায় তাদেরই অধিকার। নারায়ণশিলা শালগ্রাম ত মেয়েদের ছোঁবার ও উপায় নেই।
গায়ত্রী মন্ত্র বেদ বা চণ্ডী পাঠের শুদ্ধ উচ্চারণ অহরহ শুনে শৈশব থেকে বড় হয়ে আসা ডাক্তার অবাক হয়ে দেখে এই বাড়িতে পুরুষদের কোন ভূমিকাই নেই পুজোআচ্চায়। তিনতলার উপরে সুন্দর ঠাকুরঘরে শিব লিঙ্গ, ঠাকুরের আসন, সাজাতে ভারি ভালো লাগে। কিন্তু সেখানে শুধুই বাড়ির বউয়েরা কাজ করেন। বড় পুজো, মানে লক্ষ্মী বা সরস্বতী পূজাও বাইরের পুরোহিত এসে যা মন্ত্র পড়ে দিয়ে যান তাতেই কাজ চলে। বাড়ির পুরুষ মানুষরা রীতিমতো ভাত মাছের ঝোল খেয়ে ঘুম লাগান দোতলায়। এমনকি অঞ্জলি দেবার জন্যেও কেউ উপোস থাকার দিকে নেই। নিরামিষ খাবার ত কখনো প্রশ্নই ওঠে না। মেয়ে মহলে আবার খুব নিষ্ঠার সাথে সব নিয়মকানুন মেনে চলা।
এর ফলে একটা মস্ত প্র‍্যাকটিকাল অসুবিধার দিক দেখতে পায় নতুন ব্রাহ্মণী।
তার বাড়ির পুজোর বাজার এবং ভোগ রান্না বাবা হাতে করে নিয়ম মেনে, মুখে কাপড় বেঁধে রান্না করেন। তারপর আবার স্নান করে এসে ধুতি পড়ে ধুতির খুঁট চাদরের মত গায়ে দিয়ে অসামান্য জলদমন্দ্র স্বরে মন্ত্রোচ্চারণ করে ঘট স্থাপন করেন। সকালের ঘর সাজানো আলপনা ছবির মত রঙ মিলিয়ে পুষ্পপাত্র প্রস্তুত করা, নৈবেদ্য, ভোগের জোগাড় এই সব মায়ের কাজ। আগের দিন রাত থেকে তিনি ব্যস্ত থাকেন এইসব নিয়ে। একটু বড় হয়ে থেকে বাড়ির ছোটরাও চন্দন বাটা ফুল সাজানোয় হাত লাগায় এখানে।
সবাই পুজোর দিন ভোর থেকে সমস্ত মন প্রাণ পুজোর মধ্যেই ডুবিয়ে রাখে।
কিন্তু এরমধ্যে পুরুষদের খাদ্যপানীয় দিতে হলে ত মহা মুস্কিল। একে ত উপোষী মেয়েদের বাড়তি ধকল। তার ওপরে রান্নাঘরের এঁটোকাঁটা সামলে আবার পরিচ্ছন্ন না হয়ে সে পুজোর দিকে আসবেই বা কি করে।
আর পুজো ত শুধু ফুলপাতা নৈবেদ্য নয়। পুজো ত ঈশ্বরচিন্তা। সেইটা সংসারের ” রাঁধার পরে খাওয়া আর খাওয়ার পরে রাঁধার ” দৈনন্দিন গ্লানির মাঝে কেমন করে হবে ? এরথেকে অন্তত পুজোর দিন ও কি এবাড়ির মহিলাদের ছুটি নেই?
নতুন বউ আর বাড়ির ছোটদের নিচে কোন কাজ নেই। তারা ঠাকুরঘরের কাজে লাগবে বলে সেজেগুজে বসে থাকে।
কিন্তু বাকি মহিলাদের টানাপোড়েন দেখে প্রশ্ন উঠতে থাকে নতুন সদস্যের মনে।
এই রকম বেনিয়ম কেন ?
মহিলা পুরুষে এই বিচিত্র ভেদাভেদ কি জন্য?
এই নতুন সংসারে কোন পুজোতেই ভোগ দেবার ধারা নেই। কেবল আষাঢ় মাসে নিস্তারিণী পুজোর দিন বাড়িতে ভোগ হয়। আমিষ ভোগ। ইলিশ মাছ, ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচুর শাক, এই পুজোয় হতেই হবে।
প্রথম বার বিয়ের পর, দিদা সব আত্মীয়স্বজনকে নেমন্তন্ন করলেন। কত লোক।
দাদুর ভাইয়েরা। বোনেরা। তাদের ছেলেমেয়ে। দিদার ভাইয়ের বউ, বোন। তাদের ছেলেমেয়ে বউ নাতি নাতনি। প্রথম প্রথম একটু খেই হারিয়ে গেলেও, কৌতুহলী নতুন বউ নতুন মানুষের নতুন গল্প খোঁজে।
বউয়ের বাবা মাও নিমন্ত্রিত ।
রোগা-সোগা নিরীহ বেয়ান দিব্যি মিশে যান এ বাড়ির মেয়ে মহলে।
মাসি দিদা আর মামি দিদা গল্প করেন নতুন কুটুমের পাশে বসে খাবার সময়ে।
বুঝলা না, কর্তারা গিয়া থিকা আমাগো ঝাড়া হাত পাও। নাতিপুতিরা ও বড় হইয়া গেসে। অহন আমরা দুই জনে ট্র‍্যাভেল গো লগে ঘুইরা বেড়াই।
যাইতাসি ত এই পরের হপ্তায়ই। কেদার বদরী।
মৃদুভাসী বেয়ান যিনি এই গুরুজনদের সব কথাই মেনে হেসে চলছিলেন, এইবার উসখুস করে উঠলেন একটু।
ঘোমটা টেনে সব সময় কোমরে আঁচল গুঁজে রাখা, শাঁখা পলা আর বড় সিঁদুরের টিপে নেহাৎ সাবেকি চেহারার মানুষ। লিপস্টিক পাউডার ও ব্যবহার নেই। বড় বেশি সুন্দর বলে প্রসাধনীর অভাব টের পাওয়া যায়না।
বাইরের কথাবার্তা শুনে ঘরোয়া মেয়েরা কেউ ভাবতেই পারে না এই মহিলা, ইস্টার্ন রেলের ফেয়ারলি প্লেসের সিপিও অফিসের দীর্ঘ চাকরি জীবনে একজন দাপটের সঙ্গে কাজ করে আসা মানুষ। এমন মানুষ যাঁর ইংরেজি বলা এবং লেখার দক্ষতা আর কঠিন ব্যক্তিত্বকে একেবারে ওপর দিকের আধিকারিকরাও সম্মান এবং সমীহ করতেন । ডালহৌসি পাড়ায় অনেকেই বলত রণচণ্ডী। আর মেয়েরা মুগ্ধ হয়ে বলত আমাদের সুচিত্রা সেন।
পারিবারিক পরিবেশে নিজেকে অনায়াসে ঢেকে রাখতে জুড়ি ছিল না তাঁর।
কিন্তু এবারে তিনি মুখ খুললেন একটু গম্ভীর হয়ে।
বললেন, একটা কথা কই। এই যাত্রায় আপনাদের তীর্থ দর্শন হইব না। যাওয়া বন্ধ রাখেন।
থতমত খেয়ে গেলেন দুই বৃদ্ধা। নতুন কুটুমের মুখে এ কি অদ্ভুত কথা!
টাকাপয়সা সব দেয়া, টিকিট কাটা। এখন যাওয়া ক্যানসেল করা যায় নাকি!
কারণ ও ত কিছু নাই।
প্রায় অচেনা একজন মানুষের কথায় কি আর এমন পাগলামি করা চলে?
দুই জা আর ননদে মুখ তাকাতাকি করে কথা ঘুরিয়ে অন্য প্রসঙ্গে যান।
সারা দিনের পর বাড়ি ফেরার আগে প্রণাম করতে এসে নতুন কুটুম আরেকবার মনে করান।
” যাইবেন না যেন। প্রাণ সংশয় হতে পারে। যাত্রা সিদ্ধ হবে না মনে হয় আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে। “
এ বাড়ির ছেলেরা বা পরের প্রজন্ম, কেউ জ্যোতিষ ভক্তি আধ্যাত্মিকতা এসব বিশেষ মানে না। নাস্তিক হওয়াকে আধুনিকতার মাপকাঠি বলে ধরা হয়।
কাজেই রাতের খাবার টেবিলে একটু হাসাহাসি হল।
কুটুম বাড়ি ভটচাজ বামুন ত। বেশ একটু সেকেলে মনে হয় । আশার কথা বউ ডাক্তার। এসব কুসংস্কারের বদ প্রভাব নিশ্চয় কাটিয়ে উঠেছে।
সপ্তাহ দুই তিন পরে মাসি দিদা এলেন বড় ছেলের সঙ্গে। ধরে ধরে নিয়ে এলেন ছেলে। বেশ কাহিল দেখাচ্ছিল।
দিদা ব্যস্ত হয়ে বললেন, একি! কি হইল রে।
হাউমাউ করে যা বললেন মাসি সেটা রোমহষর্ক গল্প।
যাবার পথে দিল্লি থেকে পাহাড়ের দিকে রওনা হওয়া বাস স্লিপ করে খাদে পড়ে গিয়েছিল।
একটা গাছের ডালে আটকে ছিল বলে সবাই প্রাণে বেঁচেছেন। কিন্তু এই মহা আতঙ্কের মধ্যে ঝুলন্ত অবস্থায় প্রায় চব্বিশ ঘন্টা কাটানোর কষ্টে মর মর হয়ে ফেরত এসেছে সব যাত্রী। তীর্থ, দেব দর্শনের পুণ্য কোনটাই হয়নি।
বাড়িতে অতিথি আসার শব্দ পেয়ে, পায়ে পায়ে দাদু দিদার ঘরে এসে দাঁড়িয়েছিল নাতবউ। প্রণাম করতেই মাসি দিদা হাউমাউ করে উঠলেন।
আরে তোমার মায়ে ত কইসিলো। সে আইব কবে। আরে তার লগেই ত দেখা হওনের দরকার আসিলো। সে ত খনা এক্কেরে।
মেয়ে ভাবে মায়ের আবার এত কি গুণ। ধুত।
মা ত মা-ই। একেবারে সাধাসিধে, ঘরোয়া, সব সময় পিছনে পিছনে খাবার নিয়ে ঘুরে বেড়ানো একটা মানুষ ।
শ্বশুর বাড়িতে কিন্তু মায়ের একটা অন্যরকম খাতির হয়ে গেল সেই থেকে।
বেয়ান এলেই মেয়ে মহলের সবাই তাঁকে ঘিরে বসে পড়ত।
বাইরের কুটুম বলে ভাবত না।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।