• Uncategorized
  • 0

T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় সৌমী আচার্য্য

নন্দিনীর আপনজন

সন্ধ‍্যা আঙুলে জড়িয়ে বিষন্ন ঝিঁঝিঁর দল একটানা বিরহ বুনতে বুনতে সোনাঝুড়ির পাশে এসে জমায়েত শুরু করলো।নন্দিনী একাই খোয়াইয়ের বাঁশের চেয়ারটায় বসে।অনুভব করলো কিছুটা দূরে স্তূপের মতো জমাট হলো তার উপস্থিতি।
-কেন আসেন বারবার?আমি দুদণ্ড শান্তি পাইনা।সবাই ভুল বোঝে দূরে সরে যায়।
অপর পক্ষ শান্ত সমাহিত।কোথাও থেকে চন্দন গন্ধ ভেসে আসছে।তার চোখেও বেদনা অথচ মুখে অলৌকিক প্রসন্নতা।বিলাসবহুল রিসর্ট বাউল গানে উদ্বেল।একটু উৎসুক হয়ে কান খাড়া করার পরেই নিবিষ্ট হয়ে যাওয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটলো।
-মেয়েটা বারবার আমার চোখে চোখ রেখে করুণ বীণার তার টেনে দেয় জিজ্ঞাসা করে,’আমার তো সব ছিল তবু এত রিক্ত কেন আমি?’ কিছু বলতে পারি না।কিসের দোহাই দেব তাকে?সমাজ সংস্কার?উফ্ কি নিদারুণ বিধি তার জন‍্য নির্বাচন করা হল।কেন কেন?আপনি একটাও উত্তর দেননা।আমার মেয়েটাও বিনোদিনীর মতো গুণী ভয় হয় ওর জন‍্য।লুকিয়ে লুকিয়ে শুনি বয়ফ্রেণ্ডের সাথে ঝগড়া করে।ওরা ঝগড়াটাও ইংরেজিতে করে।আমি বলেছিলাম বিনোদিনীর কথা ও বললো আমার কথা ভীষণ ধোঁয়াটে ওর বোধগম‍্য হয় না।সাহিত‍্য আর জীবন মিশিয়ে দেওয়া নাকি অলিক ভাবনা।কি জানি তাই হবে হয়তো।
স্তূপের ভেতর থেকে কোন হেলদোল অনুভূত হয় না।বরং নন্দিনী অস্হির হয়ে ওঠে।আঁচলের খুঁটটা দাঁতে চেপে ধরে নিঃশ্বাস ঘন করে তুললো।
-আমার তো নদীর জলে পা ডুবিয়ে দিলেই ইচ্ছা হয় পেছন থেকে চয়ন এসে চোখ চেপে ধরুক।ফিসফিসিয়ে বলুক,দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি। কিন্তু ওর মোবাইলে অন্য কারো আশার কথা।এখন প্রতিরাতে আমি আমার ভাবনার সাথে ঘুমাই,জেগে থাকি আর রাজা তার চারপাশে দেওয়াল কেবল শক্ত করে তোলে।যত বলি,বাইরে এসো তোমায় একবার দেখবো।ততই সে খণ্ডাংশ চেপে ধরে।আমাকে ও ক্ষুদ্রার্থে পেতে চায় কিন্তু সবটা ছাড়া যে সৌন্দর্য্য ব‍্যর্থ।আচ্ছা আমাকে আপনি এমন বিভোর করে তুললেন কেন বলুন তো?
গভীর কালো তারাভরা আকাশ থেকে একটা তারা খসে গেলে ছায়া উঠে দাঁড়ালো স্তূপের মধ‍্যে থেকে।চলতে শুরু করলো আপনমনে।নন্দিনী পিছু নিতেই আঁচলে টান পড়লো।
-কোথায় যাচ্ছো?
-কে?চয়ন?উনি চলে যাচ্ছেন যে।ওর সাথে যাবো।
-নাহ্,তুমি আমার সাথে যাবে।চলো।
-আমার ওনার কাছে থাকতে ভালো লাগে।
-উনি তোমার ঘরেই যাচ্ছেন।চল্ গেলেই দেখতে পাবে।
-চয়ন তোমার ফোনে জরুরি আলাপ আলোচনা শেষ।আমার সাথে থাকবে কিছুক্ষণ।
-হ‍্যাঁ চলো।
অতি ধীরে চয়নের সাথে হেঁটে চলে নন্দিনী।দূরে ছায়ার মতো চলেন তিনিও।একটু যেন ক্লান্ত।ঘরের কাছে এসে চয়ন বলে,তুমি যাও আমি তোমার খাবারটা ঘরেই দিতে বলছি।
-চালতা দিয়ে মুগের ডাল আর কাঁচা ইলিশের ঝোল বলেছিলাম সাথে কুলফি।
-হুম্ বলা আছে।
-ওনার বড় প্রিয়।
চয়ন শুনতে পেল গুনগুন করতে করতে নন্দিনী ঘরে প্রবেশ করছে।এসো এসো আমার ঘরে এসো আমার ঘরে।বাহির হয়ে এসো।বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছ অন্তরে।চয়ন হতাশ হয়ে রেস্টুরেন্টের দিকে এগোয়।খাবারটা ঘরে সার্ভ করতে বলে,সোনাঝুরির গাছের নীচে চেয়ারে বসে সিগারেট ধরায়।
-বাবা!এভাবে কি ঠিক হচ্ছে?
-কুর্চি!আয় বোস।
-তুমি মাকে এ্যাসাইলামে দিচ্ছ না কেন?মনতোষ কাকু বারবার ওর ওখানে দিতে বলছেন অথচ তুমি তাই না করে শান্তিনিকেতনে বাড়ি কেনার প্ল‍্যান করছো?এতে মার ক্ষতি হতে পারে বাবা।আর আমাদের জীবনটাও তো জটিল হয়ে যাচ্ছে।
-কুর্চি রবীন্দ্রনাথ কে আমরা ভালোবাসি শ্রদ্ধা করি অনেকেই।কিন্তু ওর মতো করে এমন আপন করতে পেরেছি বল।রবীন্দ্রনাথ ওকে অনুসরণ করেন ছায়ার মতো ও সেটা বিশ্বাস করে।
-কিন্তু এটা নরম‍্যাল নয় বাবা।
-তোমার আমার সাপেক্ষে হয়তো নয় কিন্তু ওর কাছে স্বাভাবিক।
-এর কোন মানে হয় না।তুমি অকারণে সমস‍্যাটা এড়িয়ে যাচ্ছ।
-এড়িয়ে যাচ্ছি না বলেই সুইজারল্যান্ডের ডাক্তার মাওরিকো নভোলোর সাথে অনলাইনে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি।উনি এখানে থাকার সংবাদে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন জানিস?
-না জানিনা,তুমি বলোনি।
-গতমাসে তিনবার তোর মা উধাও হয়ে গিয়েছিল তাইতো!কোথায় পেলাম শেষ পর্যন্ত…জোড়াসাঁকো তে।একা একা বসে ‘জীবনস্মৃতি’ থেকে কাউকে গল্প বলে চলেছে।ঠিক গল্প না আলোচনা করছে কখনো বাহ্বা দিচ্ছে, কখনো অভিযোগ করছে।এটা শুনে নভোলো রীতিমতো আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল।শান্তিনিকেতনের সর্বত্র ও রবীন্দ্রনাথ কে পাবে কিন্তু কোলকাতায় বিষয়টা রিস্কি হয়ে যাচ্ছে।ওর একা পথচলা দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলছিলো।
-যাই হোক তোমাকে যে সন্দেহ করে মা সেটা তুমি জান?তোমার মোবাইল ঘাঁটতে দেখছি আমি।রবীন্দ্রনাথ এটা শেখান বুঝি?
চুপ করে সিগারেটের ধোঁয়ায় চোখ রাখে চয়ন।তার আর ঊর্মির সম্পর্কটা সন্দেহ কেবল নয় সত‍্যি।নন্দিনী জানে তবে অভিযোগ করে না।কষ্ট পায় কাঁদে।নন্দিনী পাগল নয় বাস্তবের সব বোধ তো ওর আছে।ওর পক্ষে স্বামীর বিপথে যাওয়া অনুভব করা কিছু অস্বাভাবিক নয়।চয়নের রবীন্দ্র রোমান্টিসিজম ধারণ করা সম্ভব হয়নি কখনোই।প্রাইভেট ফার্মের হাড়ভাঙা খাটুনির পর শরীর মন তৃপ্ত হয়েছে ঊর্মির আগুনে।নন্দিনী তো চিরকাল ধরা ছোঁয়ার বাইরে। শেষের কবিতা পড়তে ভালো লাগলেও অমিত হয়ে ওঠে তার পক্ষে সম্ভব হয়নি।শিলং পাহাড়ে গিয়ে অভিমানী স্ত্রীর কান্না,আকুলতা তাকে বিরক্ত করেছে ভীষণ।ঘটনা গুলোর পুনরাবৃত্তি মংপু,কালিংপং সর্বত্র ঘটেছে।কখনোই নন্দিনীকে বোঝেনি চয়ন।ধীরে ধীরে সরে গেছে নন্দিনী তার জীবন থেকে।মেয়েকে পেয়ে নতুন করে সাজাতে চেয়েছিল সব কিন্তু সময়ের সাথে সাথে নিতান্ত বাস্তববাদী মেয়ে মায়ের কল্পনার ফানুস নিভিয়ে দিয়েছে।নন্দিনী আবার একা হয়ে গেছে।ধীরে ধীরে সাব কনশাস মন সবটুকু দখল করে নিতেই কাল্পনিক রবি ঠাকুর ওর বাস্তবে মূর্ত হয়ে উঠেছে।চয়নের মনে পড়লো এমনটাই ব‍্যাখ‍্যা দিয়েছেন ডাক্তার বাবু।
-বাবা কি এত ভাবছো বলতো?চল খাবে।
-তোর মা কে আমি কতখানি একা করে দিয়েছি মাঝে মাঝে তাই ভাবি জানিস।ওর জগতে প্রবেশ করতেই পারলাম না।মানুষটা এক আবছায়ার পিছনে দৌড়ে গেল আজীবন।
-তুমি অকারণে নিজেকে দায়ী করছো বাবা।এতটা অসংগতি নিয়ে চলা যায় না।তুমি জানো এখানে আসার পর কাল রাতে আমায় হঠাৎ বললো,’তোমার চোখে আমি বিনোদিনী কে দেখতে পাই।নিজেকে ধরে রেখ কুর্চি।’…কি বলবে বল।
-কিচ্ছু বলবো না।তোমার মায়ের জন‍্য তোমার কোন দায় নেই কিন্তু আমার আছে।ও এই শান্তিকেতনে শান্তি পায়।কবিগুরুকে দেখতে পায় পাশে।ওনার সাথে কথা বলে তৃপ্তি পায়।আমি তাই এখানেই ওকে রাখবো।তুমি কোলকাতা ফিরে যাও।আমি কিভাবে ব‍্যালেন্স করবো চিন্তা করছি।
-তোমার কি মনে হয় বাবা আমি মাকে ভালোবাসি না?আমার মাকে পেতে ইচ্ছে করে না?ঐ বুড়োটা আমার মাকে পুরো গিলে নিয়েছে।আমার বন্ধুরা মায়ের সাথে শপিং করে,বেড়াতে যায়,কত কি শেয়ার করে।আর আমি একা বাবা ভীষণ একা।অথচ আমার উচ্চ শিক্ষিত সুন্দরী মা আমার অহংকার হতে পারতো।
বলতে বলতে ঢুকরে ওঠে কুর্চি।চয়ন ওর পিঠে হাত বোলাতে থাকে হঠাৎ হোটেলের ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এল নন্দিনী।আলুথালু চঞ্চল।মুখে অনাবিল আনন্দ অথবা প্রসন্নতা।চয়নের পাশে বসে বলল,কেমন সুন্দর চাঁদ উঠেছে একটা গান গাইবো?কুর্চি তোমার অসুবিধা হবে না তো?
-কেন অসুবিধা হবে ওর?তুমি গাও।
-না ও বলুক।ও কি শুনবে আমার গান।আমার কাছে বসে।ওর হাতের ছোঁয়াটা পেলে আমার ভালো লাগবে।
কুর্চি চোখ মুছে মায়ের পাশে ঘন হয়ে বসে।হাতের মধ‍্যে হাতটা নিয়ে বলে,করো মা গান আমি শুনবো।
নন্দিনী গেয়ে উঠলো,একা মোর গানের তরী ভাসিয়ে ছিলাম নয়ন জলে/সহসা কে এলে গো এ তরী বাইবে বলে ভাসিয়ে ছিলাম নয়ন জলে।কুর্চির খুব কান্না পেয়ে গেল আর চয়নের ফোনে সাইলেন্ট মোডে বারবার ভেসে উঠতে লাগলো ঊর্মি কলিং।সোনাঝুরির পাকা রাস্তা দিয়ে সাদা জোব্বা পরে এক বৃদ্ধ উপাসনা গৃহের উদ্দেশ‍্য হাঁটা শুরু করলো,ভারী নরম সুরে বললো,কি আশ্চর্য খেলা এই জীবন জুড়ে তাইনা রবি বাবু।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।