কিছুদিন পরে হঠাৎ একদিন নুরা রাজাকার পুকুরে বরশী পেলতে আসে। কেউ কিছু বলে না ভয়ে। আরো উল্টো কেশব বাবু তার আদর যত্নে ব্যস্ত।কিন্তু তাদের কুকুরটা মেনে নিতে পারে নাই। সে প্রতিবাধ করতে থাকে। সারাক্ষণ ঘেউঘেউ করতে থাকে। তার সাগরেদরা তাকে তাড়ানোর চেষ্টা করে। তাকে এখান দিয়ে তাড়ালে ওখান দিয়ে আসে। আবার ওখান দিয়ে তাড়ালে আরেকখান দিয়ে আসে। এভাবে ঘুরে ঘুরে সে প্রতিবাদ করে। অবশেষে নুরা রাজাকার বিরক্ত হয়ে তার সাগরেদ এর কাছ থেকে রাইফেলটা নিয়ে কুকুরটার পায়ে গুলি করে। গুলি খেয়ে কুকুরটা চিৎকার করতে করতে পালিয়ে যায়।
কেশব বাবু এক অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্যে আছে। কিছু বলতে পারে না,আবার সইতেও পারে না।মনে মনে শত মন্দ বলে তাকে। কাউকে তা বুঝতে দেয় না।আর নিভৃতে খুব ঈশ্বরের নাম জপে।
যেন তার মেয়ের পোষা মাছটা না ধরে। কারণ মাছটাকে সে প্রচন্ড ভালোবাসে।ছবি ছিল তার কাছে মাতৃতুল্য।কখনো সে বাড়ির বার হলে অথবা কোথাও গেলে মেয়ে মাকে বলে যেত।যে সময় মেয়ে হওয়াকে অনেক হিন্দু পরিবার ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বলে ভৎসনা করত। পরিবারের বোঝা মনে করত।ঠিক সে সময় ছবি জন্ম নেয়। তাকে পেয়ে সে আনন্দে বিহ্বল হয়ে পড়ে। ছবিকে সে খুব ভালোবাসত।বিভিন্ন জায়গা হতে ছবির জন্য বিয়ের ডাক আসত।কিন্তু সে ইচ্ছাকৃতভাবে বয়স হয়নি বলে ফিরিয়ে দিত। এর জন্য তার বৌয়ের অনেক বকাঝকা তাকে সহ্য করতে হত।
সেবার বর্ষার সময় মাছটা বাহির হয়ে যায় পুকুর হতে। কয়েক দিন থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিলো। হঠাৎ করে বৃষ্টির মাত্রা বেড়ে যায়। টানা অবিরাম বৃষ্টি নামে আকাশ হইতে। ঘরের বার হওয়ার কোন উপায় নেই।ছবি সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখে বাড়ির উঠনে হাঁটু সমান পানি। ঘরের দরজা খুলতে যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। এলাকার সকল পুকুর আজ একেই মোহনায় মিশে গেছে। খাল-বিল,নদীনালা যেন পানিতে আলিঙ্গন।
তখন গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।
ছবি একটা ছাতা নিয়ে পুকুর পাড়ে উঁচু মাটির টিবিতে এসে দাঁড়ায়। টিবিটা এখন পানির উপরে মাথা তুলে আছে। তখন সে দেখতে পায়। তার এত বছরের পোষা মাছটা বাহির হয়ে যাচ্ছে। সে নির্বাক হয়ে তার চলে যাওয়া দেখছে।
করুন চাওনি তার।
তাকে ফিরানোর মত কোন উপায় নাই।ফিরাবে কি করে। চারিদিকে বন্যার পানি ঢেউ তুলে যায়। বন্যার পানি হয়ত মানুষের জন্য মহা বিপদ।কিন্তু মাছেদের জন্য মহা উৎসবের দিন। বাঁধন ছিঁড়া মুক্ত পাখির মতো। বিরামহীনভাবে ছুটে চলে দূর হইতে দূর। মাছের শোকে ছবির নিদ নাই, খাওয়া নাই। সারাক্ষণ শুধু ভাবে। কোথাও গিয়ে আবার কোন শিকারীর হাতে ধরা পড়ে এ তার ভয়।
মেয়ের এ অবস্থা দেখে কেশব বাবু একটা ঘোষণা দেয়। যদি কেউ মাছটাকে ধরতে পারে। আর যদি তাকে জীবিত ফেরত দিতে পারে, তাকে উপযুক্ত সম্মানিত করা হবে। ঘোষণাটি শুনে এলাকার সবাই বন্যার কথা ভুলে গিয়ে মাছটাকে খোঁজতে লেগে যায়। যে কখন মাছ ধরার কথা চিন্তা করত না। কিন্তু আজ সেও ধরবে পুরস্কারের আশায়। এমন অনেককে দেখা যায় ছুটাছুটি করতে।
দিক-বিদিক মানুষ জাল হাতে ছুটছে।
কখন ক্ষেতে আবার কখন খালে।হঠাৎ একটা শোর- চিৎকার পড়ে। পাইছে পাইছে বলে সমস্বরে আওয়াজ করে। একজন মাছটাকে হিন্দু বাড়িতে নিয়ে আসে। তারা দেখার পরে নাখোশ করে দেয়।
আমাদের ‘মৎস্য ষাড়’ আরো বড়ো।
এলাকার সবচেয়ে বড় মাছ শিকারী আবু খায়ের চোখ জোড়া কপালে উঠে যায়।
আরো বড়ো! বিস্ময় প্রকাশ করে ।
ছবি আদর করে তার নাম রাখে মৎস্যষাড়। পানিতে তার বিচরণ সব সময় ষাঁড়ের মতো। তার গুতে পানিতে কতজন যে আহত হয়েছে তার কোন হিসেব নেই। আর যখন পানির উপরে এসে কাবি খেত সূর্যের কিরণ পড়ে কানের ফুল দুইটা বালির মত চিকচিক করতো।
আস্তে আস্তে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। হাঁটুজল হইতে এখন পায়ের পাতায় নেমে আসে । এখন মৎস্য ষাঁড়ের সন্ধান মিলে নাই। ছবির উদ্বেগ আরো তীব্র হচ্ছে। এমন সময় একজন এসে খবর কয়।জেলে পাড়ার মতলব জেলের ভেয়েল জালে একটা বড় মাছ ধরা পড়ে। ছবিদের বাড়ি থেকে সামান্য অদূরে ওয়াপদার খাল।সেখানে মতলব জেলে জাল পেতে মাছ ধরে। দূর হইতে তারা একটা উৎসুক জনতার ভীড় দেখতে পায়।
সবাই মাছটাকে দেখতে চায়।
কিন্তু মতলব জেলে কাউকে দেখতে দেয় না।ছবি আর তার বাবা কেশব বাবু অনেক আকুতি-মিনতি করে তবু সে রাজি হয় না। পরে উপস্থিত সকলের অনুরোধে সম্মতি হয়।
মতলব জেলে একটা শর্ত দেয়। এটা যে তাদের মাছ এর সত্যতা কি?
তখন ছবি বলে আমার মৎস্যষাড়ের দুই কানে দুটো রুপার ‘কান ফুল ‘ পরা আছে।
উপস্থিত জনতার মধ্যে একজন বলে। আমি একবার ঐই পুকুরে গোসল করতে নামছিলাম হঠাৎ কি যানি পানির মধ্যে আমার উরুতে আঘাত করে। আমি ভয়ে তাড়াতাড়ি হুমড়ি খেয়ে উপরে উঠে আসছি।পরে জানলাম এ মাছের কথা। আজো মাঝে মাঝে ব্যথা করে আঘাতের স্থান।
আচ্ছা দেখুন বলে মতলব তার মাছ রাখার টুকরিটা সবার সম্মুখে তুলে আনে।ছবির কথার সাথে সব মিলে যায়। তবু মতলব দিবে না।সে মনে মনে ভাবে অন্য কথা। এটাকে সে বাজারে বিক্রি করলে অনেক টাকা পাবে। এত বড় মাছ তার জেলে জীবনে আর পাইনি। হয়তো এরা নামে মাত্র কিছু দিবে।
একজন মধ্যস্ততা করার চেষ্টা করে। তোমাকে কিছু দিবে। সঙ্গে সঙ্গে মতলব প্রতিবাদ করে।
না।
আমি উপহার -উপটকন চাই না।আমার থেকে নিতে হলে কিনে নিতে হবে।
পরে আর কি করা।
যেহেতু আদরের মাছ।কিনে নিতে হলো। মাছটিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে এক বুক পানিতে নেমে ছবি তার সাথে কত আবেগি প্রলাপ বকে।যদি হারিয়ে যেতে। মাছটি মিট মট
করে তাকায় আর কাবি খায়।যেন সেও কিছু বলতে চায়। তারপর হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে মাছটি ছবির কোল হইতে গভীর পানিতে নেমে যায়। কিছু দূর গিয়ে শূন্যে একটা লাফ দেয়। যার সৃষ্ট ঢেউগুলো কূলে এসে আঘাত করে। সে যেন আনন্দে উদ্বেলিত। আবার ফিরে এসেছে তার পুরনো ঠিকানায়।
সেই চিরচেনা তলদেশ।
পুকুরের চার পাড়।
আর ছবির মুখে এক খন্ড অম্লান হাসি। সে হাসি যেন পুরায় না।হাজার ঢেউ খেলে যায় জলের সাথে।