• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শিল্পী নাজনীন (পর্ব – ২৫)

বেনু মশলাঘর

হঠাৎ ভীষণ শীত-শীত লাগল টোটনের। পায়ের কাছে ভাঁজ করে রাখা চাদরটা পা দিয়ে টেনে নিল ঘুমের মধ্যেই। ঘুমের ঘোরে মার শরীরের গন্ধ লাগল নাকে। কেমন মিষ্টি, লেবুপাতা গন্ধ মার শরীর জুড়ে। শৈশবে এ গন্ধটা নাকে মেখে ঘুমোতে যেত টোটন। মার শরীরের এই গন্ধটা ছাড়া ঘুম আসত না কিছুতেই। মা বিরক্ত হতো খুব। সারাদিনের ক্লান্তিতে মার চোখে নামত রাজ‍্যের ঘুম। কিন্তু টোটনের অত সহজে ঘুম আসত না। মাকে জড়িয়ে ধরে, মার বুকের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে গল্প শোনার বায়না করত সে। গল্প শুনতে শুনতে, মার শরীরের মিষ্টি লেবুপাতা গন্ধে ডুবতে ডুবতে গভীর ঘুমে তলিয়ে যেত টোটন। বহুবছর বাদে, মার শরীরের সেই লেবুপাতা গন্ধে কেমন নেশা লাগল তার। মনে হল, মা তাকে জড়িয়ে ধরল এসে। বহুকাল আগের হারিয়ে যাওয়া সেই শৈশব ঘুমের ভেতর টোটন আচমকা ফিরে পেল আবার। ভিয়েতনামের আকাশ ছোঁয়া অত‍্যাধুনিক হোটেলের এই নির্জন কক্ষে হঠাৎ কোত্থেকে উড়ে এসে টোটনের চেতনায় জুড়ে বসল তার দূরন্ত শৈশব, টেরই পেল না টোটন। সে তখন মার বুকের মধ‍্যে মুখ লুকিয়ে গল্প শুনছে মগ্ন হয়ে। মা তখন ঘুম-ঘুম স্বরে বলছে, একদেশে ছিল এক রাজা, রাজার ছিল চাঁদের মতো সুন্দর এক রাজকুমার… টোটন শুনছে। শুনছে আর মার গায়ের গন্ধ নিচ্ছে। আহ। পৃথিবীতে এর চে সুগন্ধি কী আছে আর! ভেবে ঘুমের ঘোরেই হাসল টোটন। মাকে জড়িয়ে ধরল আরো শক্ত করে। ফিসফিসিয়ে বলল, ভালোবাসি মা। খুব ভালোবাসি তোকে। আবার আসব তোর বুকে। আবার… আবার… বলেই আফসোসে চুকচুক শব্দ করল মুখে। মনে মনে ভাবল, ইসসস! মাকে তো বলাই হল না কখনো, ভালোবাসি! মা কি জানে সে-ও যে মাকে এতটা ভালোবাসে! এতটা ভালোবাসার জল টলটল করে তারও বুকের ভেতর মার জন্য! ভেবেই কুঁকড়ে গেল সে। গুটিয়ে গেল নিজের মধ্যেই। আরও বেশি শীত করল তার। আরও বেশি নিবিড় করে জড়িয়ে ধরল মাকে। মা তখনও ফিসফিসিয়ে গল্প বলছে তাকে। ঘুম-ঘুম জড়ানো স্বরে মা তখনও তাকে শুনিয়ে যাচ্ছে রাজা আর রাণীর গল্প। ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে টোটন আবার ফিসফিস করল, ঠোঁট নাড়ল অগোচরে, মা! মা!
মা যে কী! আস্ত একটা বোকা! মনে মনে ভাবল টোটন। এত যে মাকে ডাকছে টোটন, এত যে চিৎকার করে বলছে, ভালোবাসি! তবু যদি কিচ্ছুটি টের পায় মা! কিচ্ছু যদি বোঝে। টোটন কোথায় পুড়ে যাচ্ছে ভালোবাসার অসহ‍্য তৃষ্ণায়, অথচ মা তখনও বকে যাচ্ছে রাজকুমারের রাজ‍্য জয়ের অলীক সব গল্প। টোটন আবার ডাকল, মা! অ মা!
মার কোনো সাড়া নাই তবু। এই তো দিব‍্যি গল্প বলছিল মা তাকে জড়িয়ে! কোথায় হাওয়া হয়ে গেল আবার! একটুও যদি কাণ্ডজ্ঞান থাকে তার! যখন তখন, সময় নেই, অসময় নেই কোথায় যে হাওয়া হয়ে যায় হুট করে! মার শরীরের মিষ্টি লেবুপাতা গন্ধটাও কোথায় হারিয়ে গেল হঠাৎ। শরীরে তীব্র অস্বস্তি টের পেল টোটন। উঠে বসল বিছানায়। ডিম লাইটের মৃদু আলোয় রুমের মৃদু নীলচে আলোটা কেমন অলৌকিক লাগল তার। প্রথমে বুঝতে পারল না কোথায় আছে সে। বোধশূন‍্য, ভয়ার্ত গলায় ডাকল, মা! মা!
সাড়া দিল না কেউ। মনে পড়ল তখন। সে আছে ভিয়েতনামের রাজধানীর ফাইভস্টার হোটেলের অতি নির্জন এক কক্ষে। একা। মা কোথায় এখানে! তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে গেল টোটনের। নিয়নের ঝাপসা আলোয় দেখল অনতিদূরে, টেবিলে ঢেকে রাখা জল। হাত বাড়ালেই নাগাল পাওয়া যায়। হাত বাড়াতে চাইল টোটন। অসাড় লাগল শরীর। হাত মস্তিষ্কের নির্দেশ মানতে অস্বীকার করল হঠাৎ। এমনও হয়! অবাক হয়ে ভাবল টোটন। তার ভেতরে তাহলে বাস করে অন্য কেউ! শরীর আর মন, তাহলে আলাদাও ভাবে কখনো কখনো! তীব্র বিস্ময়ে আবার জলের দিকে হাত বাড়াতে চাইল টোটন। এতদিনের চেনা হাত, যাকে একান্ত নিজের বলে জানত টোটন, সাড়া দিল না সে। অসাড় পড়ে থাকল তারই কাঁধের সঙ্গে ঝুলে। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে গেল টোটনের। সেইসঙ্গে তাকে গ্রাস করে নিল তীব্র এক ভয়ের অনুভূতি। শরীর কি তবে ছেড়ে দিচ্ছে তাকে, কিংবা টোটনই কি ছেড়ে যাচ্ছে এই শরীরের মায়া? ভেবে দিশেহারা বোধ করল টোটন। বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা লাগল তার, মনে হল, অসীম এক শূন্য তাকে টেনে নিচ্ছে নিজের বুকের ভেতর। দারুণ শীতে কুঁকড়ে গেল টোটন। বিছানায় বসা টোটন ভীষণ শীতে কুঁকড়ে গিয়ে মাথা গুঁজল দু হাঁটুর ভাঁজে। সকাল হলেই এই হোটেল ছেড়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে তাকে সাইক্লিং টিমের সঙ্গে রওনা দিতে হবে কম্বোডিয়ার পথে, পনেরো দিনের লম্বা সফরে, পলকের জন্য ভাবনাটা মাথায় এসেই হারিয়ে গেল আবার। তীব্র শীতে তলিয়ে যেতে যেতে অনন্ত এক তৃষ্ণা নিয়ে সে শুধু ফিসফিসিয়ে ডেকে চলল, মা! মা!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।