সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শিল্পী নাজনীন (পর্ব – ১৫)

বেনু মশলাঘর

বাড়ি থেকে ফিরে কিছুতেই হোস্টেলে মন বসছে না এবার। ইচ্ছে করছে সব ছেড়ে ছুড়ে আবার সে ফিরে যায় বাড়ি। মার শরীরটা একটু বেশিই খারাপ দেখল এবার কণা। রিপোর্টগুলোও দেখল খুঁটিয়ে। মেজাজ খারাপ হল খুব। কোলেস্টেরল বেড়েছে, বেড়েছে ক্রিটিনিন আর সুগারও। অথচ খাবারে মোটেই নিয়ন্ত্রণ নেই বেনুর। যেগুলো নিষেধ সেগুলোর প্রতিই যত ঝোঁক তার। দেখারও কেউ নেই। ইচ্ছে মাফিক চলে বেনু। কণা যে কটাদিন বাড়িতে থাকে সে কটাদিন শুধু যা একটু সমঝে চলে সে, খাবারে সতর্ক হয় খানিকটা, একটু বেছে খায় সে সময়টাতে। বাকি সময়টাতে সে স্বাধীন। হাজী বক্কর আলীকে গোণায়ই ধরে না বেনু। বেনুকে কিছু বলতে এলে উল্টে বেনুই তাকে ধমকে বাপের নাম পর্যন্ত ভুলিয়ে দেয় পারলে। বেচারা বক্কর আলী তাই মুখে রা কাড়ে না সচরাচর। বরং সে মেয়ে কণাকে ফোনে নালিশ জানিয়েই দায় সারে। হোস্টেলে কণার দিন কাটে মেডিকেলের হাঁফ ধরানো মোটা মোটা বই পড়ে, ক্লাশ, টিউটোরিয়াল আর এসাইনমেন্টের ব‍্যস্ততায়, সেই সঙ্গে বাপ-মায়ের একে অপরের বিরুদ্ধে করা নালিশ শুনে। মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে ওঠে কণা, বাবা-মার এইসব অর্থহীন ছেলেমানুষী ঝগড়ায় সে বিরক্ত হয় খুব। কিন্তু এবার বাড়ি থেকে ফিরে কেমন এক অস্থিরতা ঘিরে ধরেছে তাকে। ফেরার সময় বার বার মাকে সতর্ক করে এসেছে কণা, পই পই করে বলে এসেছে খাবারের ব‍্যাপারে যেন সতর্ক হয় বেনু, উল্টাপাল্টা খাবার যেন না খায় একদম, অনিয়ম যেন না করে মোটেই। কিন্তু বেনুর হাবভাব সুবিধের নয়, হালছাড়া গোছের। ‘কী হবে আর বেঁচে’ টাইপ। এটাই ভয়ঙ্কর। নিজের ভেতর লড়াইয়ের ইচ্ছেটুকু ভীষণ দরকার। ওটুকু ছাড়া শুধু ওষুধের ক্ষমতা সামান্যই। পথ‍্যও ভারি গৌণ তখন। মার জন‍্য কেমন এক চাপা উদ্বেগ ঘিরে ধরছে তাকে ক্রমশ। ফোনে যতটা সম্ভব গাইড করছে সে। মাকে ছাড়া পৃথিবী কল্পনা করতেও দমবন্ধ লাগে কণার, মাকে সেটা বোঝানোর চেষ্টা করছে আপ্রাণ। তবু কী যে এক দুর্বোধ‍্য অভিমান বেনুর পৃথিবীর ওপর। তার ধারণা কেউ ভালোবাসে না তাকে। স্বামী না, সন্তান না এমনকি বেনুর প্রয়াত বাবা-মা পর্যন্ত ভালোবাসত না বেনুকে, তেমনই ভাষ‍্য বেনুর। কেউ ভালোবাসে না বেনুকে, চায় না কেউ, বোঝেও না। সে তাই ঝরে যেতে চায়। ফুরিয়ে যেতে চায় দিনান্তের রোদ্দুরের মতো। মার এই ছেলেমানুষী অভিমানে কী যে রাগ হয় কণার, কান্নাও পায় ভারি। মা ছাড়া সে কী করে বাঁচবে? কেন বেনুর ভেতর এমন ভাবনা জন্মাবে যে কণা ভালোবাসে না মাকে! কী বোকা বোকা ভাবনাতেই না সময় পার করে তার বোকা মা!
ঘুম ভেঙে উঠেই ফোনে বেনুর সাথে কথা বলল কণা। খোঁজ নিল শরীরের, টুকটাক নির্দেশনা দিল। তারপর ব‍্যস্ত হল নিজের কাজে। ভীষণ মনোযোগে পড়তে বসেছিল কণা, খেয়াল ছিল না কোনোদিকে। হঠাৎ ফোনের শব্দে মনোযোগ টুটে গেল। ভাইব্রেশন দেয়া ফোনটা কাঁপছে খুব। কাঁপছে টেবিলটাও। বিরক্ত হল বেনু। বিপু। ফোন ধরবে না, ভেবে রেখে দিল একপাশে। পরক্ষণেই কী মনে করে রিসিভ করল। সমস্যা ঝুলিয়ে রাখার মানে হয় না কোনো। রিসিভ করতেই বিপুর কণ্ঠ ভেসে এল।
বলো। -নিরুত্তাপ সাড়া দিল কণা।
কী হয়েছে বলো তো? কেন এমন করছ?
কেমন করছি?
ফোন দিচ্ছি ধরছ না, কথা বলছ না ঠিকমতো, দেখা করতে চাইছি দেখাও করছ না। কেন করছ এমন? কী হয়েছে?
এই তো ধরলাম ফোন! -বলে ক্লান্তিতে হাই তুলল কণা। শব্দটা ওপাশ থেকে স্পষ্ট শুনল বিপু। সম্পর্কটায় কবে এত ক্লান্তি জমে গেল ভেবে কিছুতেই বের করতে পারল না সে।
আমি দেখা করতে চাই কণা! -বিপুর কণ্ঠে জিদ আর উষ্মা, টের পেল কণা।
আমি তো চাই না বিপু। -আস্তে, শান্ত গলায় বলল কণা।
কেন চাও না কণা? আমার অপরাধটা কী?
আমি তো তোমাকে বলেছি বিপু, তোমার প্রতি আমার ভেতর যে আবেগটুকু ছিল আগে সেটুকু নেই আর। তোমার প্রতি আমার ভেতর কোনো অন‍্যরকম অনুভূতি জাগে না এখন।
কেন নেই কণা? কেন জাগে না?
আমি জানি না বিপু। সত‍্যিই জানি না। -করুণ শোনাল কণার কণ্ঠ এবার। বিপু মরিয়া হয়ে বলল, আমি কোনো কথা শুনব না কণা। আমি দেখা করতে চাই, ব‍্যস। অন্তত আর একবারের জন‍্য হলেও দেখা করব আমি।
কবে আসতে চাও? -ক্লান্ত গলায় বলল কণা।
আজ?
না। আজ আমার ব‍‍্যস্ততা থাকবে। ওটি ডিউটি আছে আজ।
তাহলে তুমিই বলো কবে আসব।
কাল পারবে? তিনটার পর, বিকেলের দিকে?
পারব। -সাথে সাথেই উত্তর দিল বিপু।
ফোন রেখে থম হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকল কণা। বিপুকে কিছুতেই বোঝাতে পারছে না সে। বিপুর প্রতি কোনো অনুভূতি তার ভেতর জাগে না ইদানীং। বিপু এখন তার কাছে অতি সাধারণ। অন‍্যরকম অনুভূতির মোড়কে তাকে এখন আর মুড়িয়ে তোলে না তার অতি স্পর্শকাতর মন। বিপু তাকে টানে না আর। অদ্ভুত এক অনাসক্তি সে টের পায় নিজের ভেতর। খানিকটা বিতৃষ্ণাও কি? প্রশ্নটা নিজেই নিজেকে করে কণা। তন্ন করে খোঁজে নিজের মনের যত গলি- চোরাগলি। বিপুর জন‍্য বন্ধ সব। সেখানে ছড়িয়ে আছে রিফাত। কেঁপে উঠল কণা। সেদিনের ছবিটা স্পষ্ট ফুটে উঠল চোখে।
বাসে ভীড়। ভীষণ। সীট হয়নি তাদের কারও। দাঁড়িয়ে আছে তারা। পাশের সীট ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কোনোমতে সীটের এক কোণা ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার পাশে বিপু। বিপু পাশের সীটে হেলান দিয়ে ফোনে ব‍্যস্ত ফেসবুকে। কানে এয়ার ফোন। তার পাশে রিফাত। বিপুর বন্ধু। সেদিনই প্রথম পরিচয়। বিপু ছটফটে, চঞ্চল। রিফাত ধীর, শান্ত। মিতভাষী। বিপুর মতো কথায় পটু নয়। অবশ‍্য কথাও হয়েছিল সামান্যই। ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কণা। এমন জার্নিতে অভ‍্যস্থ নয় সে। কখন পথ শেষ হবে সময় গুনছিল মনে মনে। হঠাৎই ষষ্ঠেন্দ্রীয় সতর্ক করল তাকে। ঘাড়ের কাছটা মুহূর্তে কেমন তিরতিরিয়ে উঠল তার। চোখের কোণা দিয়ে দেখল বাম দিক থেকে একটা হাত এগিয়ে আসছে তার বুক লক্ষ্য করে। একহাতে ব‍্যাগ ধরা বেনুর। অন্য হাতে সীটের কোণা ধরে কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে সে। বাস ছুটছে ভীষণ গতিতে। সীটের কোণা থেকে হাত সরালে সে গিয়ে আছড়ে পড়বে অন‍্যকারো ওপর। মস্তিষ্ক নির্দেশ দিল মাইক্রো সেকেন্ডেই। অন‍্যহাতের ব‍্যাগ ফেলে ধেয়ে আসা হাতটা ধরতে গেল কণা। তার আগেই আরেকটা হাত এসে ধেয়ে আসা নোংরা হাতটা মুচড়ে দিল মুহূর্তে। চমকে তাকাল কণা। রিফাত। নোংরা লোকটা ততক্ষণে উহ্ শব্দ তুলে মোচড়ানো হাত নিয়ে সরে যাচ্ছে দরজার দিকে। মুহূর্তেই ঘটে গেল ঘটনাগুলো। পড়ে যাওয়া ব‍্যাগটা ঝুঁকে পড়ে তুলে দিল রিফাত। তাকাল কণার চোখে।
থ‍্যাঙ্কস! -প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল কণা। কণার চোখে তাকিয়ে মৃদু হাসল রিফাত। বুকের ভেতরটা কেমন কেঁপে উঠল কণার। দুলে উঠল পৃথিবী। বিপুর দিকে তাকাল কণা। সে তখনও ফোনে ব‍্যস্ত। এতসব ঘটনার কিছুই খেয়াল করেনি বিপু। গলার কাছটায় কী এক বিতৃষ্ণা পাক খেল কণার। চোখ সরিয়ে বাইরে তাকাল। প্রকৃতি ছুটছে দুরন্ত গতিতে।
পড়া ছেড়ে উঠে পড়ল কণা। সেদিনের ঘটনাটা মনে পড়ে আবার তেতো হয়ে উঠল মন। রিফাতের নাম্বারটাও নেয়া হয়নি সেদিন। কিন্তু রিফাত? সে-ও তো নিতে পারত নাম্বারটা, ফোন দিতে পারত একবার!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।