• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শিল্পী নাজনীন (পর্ব – ৩০)

বেনু মশলাঘর

সকাল থেকে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে আজ। সেই কোন সকালে ঘুম ভেঙেছে মেহেরবানুর। অনেক চেষ্টায়ও ঘুম আসেনি আর। পাশের ঘর থেকে ছেলে বক্কর আলীর কোরআন তেলাওয়াতের শব্দ ভেসে আসছে। কান পেতে শুনল মেহেরবানু। বড় মিষ্টি গলা বক্কর আলীর। মেহেরবানুর সামর্থ‍্য ছিল না তাকে লেখাপড়া শেখায়। স্থানীয় মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল সে। সেখানে বক্কর আলীকে রাখেনি শেষতক। মাদ্রাসার হুজুর মেহেরবানু পাকসেনাদের শিবিরে বন্দী ছিল, তাদের নির্যাতনের শিকার হয়েছিল, সে খবর জানার পর বক্কর আলীকে বের করে দিয়েছিল মাদ্রাসা থেকে। গ্রাম ছেড়ে অগত‍্যা শহরে এসে পথে পথে ঘুরেছে মেহেরবানু। খেয়ে না খেয়ে বড় করেছে ছেলেকে। অতি কষ্টে হাফেজি পাস করিয়েছে বক্কর আলীকে। যদিও মেহেরবানুর নিজের ধর্মে-কর্মে মতি ছিল না কোনোকালেই। আজকাল অবশ‍্য মাঝে মাঝে নামাজ পড়ে সে। মৃত্যুর ওপারে কী আছে, সে চিন্তায় বিচলিত হয়ে আল্লাহ্-খোদার নাম নেয় হঠাৎ হঠাৎ। তবে সংশয় ঘোচে না তার। ওপারের অনিশ্চয়তা তাকে দ্বিধাগ্রস্ত করে দেয়। কী করা উচিত অথবা অনুচিত সে দোটানায় পড়েই জীবন প্রায় পার করে দিল মেহেরবানু। বক্কর আলীর তেলাওয়াতে মনটা হঠাৎ কেমন আর্দ্র হয়ে উঠল তার। মনে হলো বড় ছোট এ জীবন। ফুরিয়ে যাবে যখন তখন। মনে হতেই জীবনের অপ্রাপ্তিগুলো হুল ফোটাল যেন। দীর্ঘশ্বাস পড়ল অজান্তেই। বৃষ্টির ছাঁট উপেক্ষা করেই বারান্দায় গিয়ে বসল মেহেরবানু। অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে সকাল থেকে। কয়েক হাত দূরের জিনিসটাও ঝাপসা এখন। অবশ‍্য পৃথিবী মেহেরবানুর চোখে বহুদিন থেকেই ঝাপসা। চোখে হালকা ছানি পড়েছে তার। ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে। কণা বলেছে অপারেশন করিয়ে ঠিক করে দেবে। শুনে ভয়ে ভয়ে আছে সে। কাটাচেরাতে বড় ভয় মেহেরবানুর। আর কণাকেও মনে মনে যমের মতো ভয় পায় সে। নাতনীটা খুব জেদি তার। একরোখা। কিন্তু মনটা পরিষ্কার। নইলে কি আর যে বাড়ির চৌকাঠ পর্যন্ত কোনোদিন ডিঙোনোর সুযোগ মেলেনি মেহেরবানুর, রাস্তা থেকে তুলে এনে সে বাড়িতে এত যত্নে ঠাঁই দেয় তাকে! যেখানে পেটের ছেলেটা পর্যন্ত খোঁজ নেয়নি কোনোকালে, সেখানে নাতনীর এই আদর ভারি বেমানান ঠেকে তার। বদহজম হয়। মাঝে মাঝে হঠাৎ মেলা এই আয়েশটুকু ভালোই লাগে, শরীর, মন দিয়ে উপভোগ করতে ইচ্ছে করে, করেও মেহেরবানু। কিন্তু সে বড় অল্প সময়। খানিক বাদেই শরীর ভারি কুটকুট করে তার, ভয়ানক আনচান করে মন। অনভ‍্যস্ত এই আয়েশি জীবন ছেড়ে সেই অভ‍্যস্ত, চেনা, হাভাতে জীবনে ফেরার জন্য অধীর, উদগ্রীব হয়ে ওঠে মন। বাইরে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বৃষ্টি দেখে মেহেরবানু। মনটা উতলা হয় ভীষণ। স্টেশনে তার থাকার সেই নির্দিষ্ট জায়গাটুকুর জন্য মন কাঁদে। এতদিনে বেদখল হয়ে গেছে নিশ্চিত। মৌসুমী আর তার মেয়েটা কেমন আছে কে জানে। খদ্দের সামলানোর সময় এখন মৌসুমীর মেয়েটার হ‍্যাপা কে সামলায়? কার কাছে দিয়ে যায় মৌসুমী? ভেবে পায় না মেহেরবানু। ইচ্ছে করে একছুটে চলে যায়। সব ছেড়ে-ছুড়ে ফিরে যায় নিজের ডেরায়। সেখানে কিছু নাই। তবু স্বাধীনতা আছে। ইচ্ছেমতো চলার সুযোগ আছে। এখানে সব আছে, কিন্তু স্বাধীনতা নাই। ইচ্ছেমতো চলার সুযোগ নাই। সারাক্ষণ থাকতে হয় ভয়ে ভয়ে। যতই হোক ছেলের নিজের বাড়ি তো নয়। ঘর জামাই থাকা ছেলে বক্কর আলীর নিজেরই অবস্থান নড়বড়ে এ বাড়িতে। বউ বেনুর সঙ্গে সম্পর্ক মোটেই ভালো নয় ছেলের, সংসার চলে বেনুর নির্দেশে, সেটা বেশ বোঝে মেহেরবানু। ফলে এ বাড়িতে সহজ হতে পারে না মোটে মেহেরবানু। ছটফট করে। ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে থাকে আড়ষ্টতায়। কণা বোঝে না। কিংবা পাত্তা দেয় না এসব। মেহেরবানুর রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা সহ‍্য হয় না তার। সে চায় শেষ জীবনে অন্তত আরামে থাক মেহেরবানু। স্বচ্ছন্দে থাক। কিসে যে কার আরাম, কোথায় যে কার স্বস্তি, সেটা বোঝে না মানুষ সহজে। দীর্ঘশ্বাস পড়ে মেহেরবানুর। অনেকদিন হলো সে এ বাড়িতে এবার। প্রায় তিনমাস। পালাই পালাই করেও শেষ পর্যন্ত পালানো আর হয়ে ওঠেনি মেহেরবানুর। এর মধ্যে কণা একবার এসে ঘুরে গেছে বাড়ি থেকে। বিউটির মা মারা যাওয়ায় মেহেরবানু পালানোর ইচ্ছেটা তাড়িয়েছিল মাথা থেকে। তার কদিন পরেই বউ বেনুর অসুস্থতা আটকে দিয়েছিল তার পলায়ন-পর্ব। এ জন‍্যই সংসার জায়গাটাকে আরো অপছন্দ মেহেরবানুর। সংসার মানেই শক্ত বাঁধন। মায়ার, দায়িত্বের, সামাজিকতার। মেহেরবানুর ওসব পোষায় না। সেই কবে সংসার জীবনের সুতো কেটে রাস্তায় বেরিয়েছিল সে, তারপর থেকে সে নাটাইবিহীন ঘুড়ি হয়ে উড়েছে আর উড়েছে। তাতে অভাবের বৈরি বাতাস ছিল, অসচ্ছলতার প্রকট কষ্ট ছিল, ছিল খিদের প্রবল যন্ত্রণা। তবু তাতে স্বাধীনতার সুখ ছিল। ছিল ইচ্ছেমতো উড়বার অবাধ আনন্দ। সেটুকুর জন্যই মন পোড়ে মেহেরবানুর। ভেতরে ভেতরে দমবন্ধ হয়ে মরে যায় সে। কণা সেটা বোঝে না। কেউ বোঝে না। সবার এক কথা। মেহেরবানু পাগল। নইলে এমন আরাম-আয়েশ ছেড়ে কেন সে পালিয়ে যায়। রাস্তায় ঘোরে, স্টেশনের প্লাটফর্মে রাত কাটায় খেয়ে না খেয়ে! বিউটি রাগ করে। বউ বেনুও ইদানীং তাকে এখানে রাখতে চায় মন থেকেই, মেহেরবানু টের পায়। কণা তো চায়ই। বক্কর আলীর চাওয়াটা বোঝা যায় না। সে থাকে দূরে। অপরিচিতের মতো। মেহেরবানুর মন খারাপ হয় মাঝে মাঝে। নিজের পেটের ছেলে বক্কর আলী। অথচ সাত রাজ‍্যের দূরত্ব তার সঙ্গে। সে তুলনায় বরং বউ বেনু কাছের। কণা তো আরও। আফসোস হয় মেহেরবানু। ইচ্ছে হয় বক্কর আলীর কাছে গিয়ে বসে। তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দুটো স্নেহের কথা কয়। দুঃখ-সুখের খোঁজ নেয়। কিন্তু শেষ অবদি সেই সাত রাজ‍্যের দূরত্বই জারি থাকে। কেউ কারো ছায়াও মাড়ানো হয়ে ওঠে না আর। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বৃষ্টিটা কখন ধরে এসেছে খেয়াল করেনি মেহেরবানু। ঘোর কাটল বিউটির ডাকে। বিউটি ডাকছে, দাদি! ও দাদি!
কী লো? ডাহিস হ‍্যা অবা?
বুড়ির কতা শোনো! খাবা না? খিদে লাগে নাই?
এত সহালে কী লো খাব? কী নাদিচিস?
তুমি আর ঠাটে বাঁচো না, তেয় না? এহনও সহাল আচে? নয়ডা বাইজে গেচে। খ‍্যায়া নেওসা, আইসো!
অগত‍্যা উঠল মেহেরবানু। হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসল গিয়ে। সকাল সকাল খিচুড়ি করেছে বিউটি। সাথে কড়া করে ভাজা ইলিশ। পাতে তুলে নিয়েই মৌসুমীকে মনে পড়ল মেহেরবানুর। খিচুড়ি আর ইলিশ বড় পছন্দ তার। কথায় কথায় একদিন মেহেরবানুকে বলেছিল মেয়েটা। কতদিন খায় না, বলে আফসোস করেছিল খুব।
অল্প নাদিচিস, না বেশি? ও বু?
তুমার যা লাগে খাও নিয়ে। অল্প না বেশি তা জাইনে দরকার কী?
বেশি থাহ্লি ইটু এটা বাসুনি দে না, ও বু?
ক‍্যা? কী হরবা?
দেবো একজনেক।
কাক দিবা?
মৌসুমীক।
এহ। বুড়ির শখ কত! আমি তুমাক দেই আর তুমি য‍্যায়া হোনে আবার ঘাঁটি গাড়ো, তেয় না? ওসপ হচ্চে না। কণা আপা শুনলি মারেই ফেলবিনি আমাক।
বুঝিয়ে-শুনিয়ে, অনেক কাকুতি মিনতি করে বিউটিকে বাগে আনল মেহেরবানু। খাওয়া সেরে একটা প্লাস্টিকের বক্সে মৌসুমী আর তার মেয়ের জন্য খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ নিয়ে বের হলো অতঃপর। বের হতেই মুক্তি। বের হতেই একপশলা স্বস্তির হাওয়া।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।