সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শিল্পী নাজনীন (পর্ব – ৪)
by
TechTouchTalk Admin
·
Published
· Updated
বেনু মশলাঘর
দিনটাই কুফা অাজ। সকাল থেকে একটা কাজ যদি ঠিকঠাক হয়। বেহুদা সময় নষ্ট হল কেবল। ওহ্ বেইবি! গেট রেডি প্লিজ! ইটস ঠু লেট টু গো!
-গ্লোরির ভারী শরীর থেকে ল্যাপটপে চোখ সরিয়ে তাড়া দিল টোটন।
ইয়েস হানি! জাস্ট টু মিনিটস প্লিজ!
লিপস্টিক ঠোঁটে ঘষতে ঘষতে দারুণ অাদুরে ভঙ্গিতে বলল গ্লোরি। কালো, পুরু ঠোঁটে লাল লিপস্টিক অাগুন জ্বেলেছে প্রায়। লাল লংস্কার্ট ফুঁড়ে গ্লোরির দোহারা লম্বা শরীর বিদ্রোহ করতে চাইছে যেন। ল্যাপটপে পাওয়ার বাটন অফ করে অাবার গ্লোরির দিকে চোখ রাখল টোটন।
ওহ সুইট হার্ট! য়্যু অার লুকিং গ্রেট এন্ড সেক্সি!
ওওও! রিয়েলি হানি?
ইয়েস ডিয়ার!
খুশিতে ঠোঁট সরু করে খানিকটা শিষ দেয়ার মতো শব্দ করল গ্লোরি, কালো মুখ উজ্জ্বল দেখাল তার। টোটন হাতের কাজ সেরে জানালার পাশে চেয়ারটা সরিয়ে নিয়ে গ্লোরির তৈরি হওয়া দেখল মন দিয়ে। গ্লোরি দারুণ চটপটে, ভীষণ প্রাণবন্ত। দু মিনিটে তৈরি হয়ে টোটনের পাশে দাঁড়াল এসে। টোটনের হাতের সিগারেটটা টেনে নিয়ে এ্যাশট্রেতে চেপে নিভিয়ে দিল অাগুনটা। বিরক্ত টোটন জানালা দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল বাইরে। কপাল কুঁচকে উঠল তার। গ্লোরি সেসবে পাত্তা দিল না। চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে পেছন দিক থেকে টোটনকে জড়িয়ে ধরে বলল, অ্যাম রেডি হানি! নাউ লেটস গো!
নিজেকে সামলে নিয়ে উঠল টোটন। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল একপলক। ঠাঠা রোদ বাইরে। ভরদুপুরে শহরটাকে পোড়াচ্ছে খুব।প্রেতপুরির মতো খা খা করছে পুরো শহর। ঝিম মেরে অাছে। তেরো তলার ফ্ল্যাট থেকে নিচে তাকিয়ে শহরটাকে অলৌকিক লাগছে, মনে হচ্ছে নাচছে বিল্ডিংগুলো। চোখ সরিয়ে ভেতরে তাকাল টোটন। অন্ধকার লাগল প্রথমটা। গ্লোরির দিকে তাকিয়ে মনে হল রাত নামল হঠাৎ। তারপর সয়ে এল। স্পষ্ট হল গ্লোরি। ততক্ষণে সামনে এসে হাসিমুখে টোটনের দিকে হাত বাড়িয়েছে সে।
লেটস গো! -টোটনকে তাড়া দিল অাবার।
উঠল টোটন। হাসির প্রত্ত্যুত্তরে হাসল অাধফোটা। দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলল, ইয়েস ডেয়ার! লেটস গো!
এসির শীতলতায় বাইরের গরম অতটা বোঝা যাচ্ছে না। তবু গ্লোরির লাল স্কার্ট অার লাল লিপস্টিকের দিকে তাকিয়ে ভেতরে ভেতরে কেমন ঘেমে উঠল টোটন। এই গরমে গ্লোরির কালো শরীরে অাগুন লাল পোশাক কেমন অস্বস্তি জাগায় মনে। গ্লোরির কোনো বিকার নেই। লাল তার প্রিয় রঙ। অধিকাংশ দিনই লাল পোশাক পরে সে, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। কেমন লাগছে, মানাচ্ছে কিনা, সেসব নিয়ে মোটেই মাথা ঘামায় না গ্লোরি। মাঝে মাঝে মেয়েটাকে মাথামোটা মনে হয় টোটনের। মনে হয় মাথায় গোবর পোরা অাছে মেয়েটার। কিন্তু গ্লোরির অন্যান্য কার্যক্রম, তার দৈনন্দিন জীবনের ক্লিশে রুটিন বলে, গ্লোরি মোটেই অতটা বোকাসোকা নয়। যতই সাদামাটা দেখাক তাকে, মোটেই অতটা হাবাগোবা নয় সে। নইলে, সেই সুদূর দক্ষিন অাফ্রিকা থেকে এসে বাংলাদেশের মতো দেশের টাউট-বাটপারদের সাথে পাল্লা দিয়ে একা একটা মেয়ের পক্ষে গার্মেন্টস ব্যবসা দাঁড় করান সহজ নয় মোটেই। গ্লোরি সেটা করে দেখিয়েছে। প্রতিমাসে অাড়াইশ শ্রমিকের বেতন দিচ্ছে অনায়াসে। প্রতিমাসে অাড়াইশ শ্রমিকের বেতন দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয় হে চাঁদু! -নিজেকেই কথাটা মনে মনে শোনায় টোটন।
গ্লোরি বরাবরের মতোই টোটনের কাছ ঘেঁষে বসেছে। টোটনের বুকের সাথে মাথা হেলিয়ে। ব্যাপারটা উপভোগ করে টোটনও। গাড়িতে, রিক্সায়, বাসে টোটনের পাশে অাফ্রিকান নিগ্রো মেয়ে গ্লোরির লেপ্টে থাকা দেখে দেশের অধিকাংশ মানুষ ট্যারাচোখে তাকায়, ফিসফাস করে, ব্যাপারটা বেশ লাগে তার। নিজের কালো রঙ অার বিশাল বপু নিয়ে তার নিজের মধ্যে হীনম্মন্যতা ছিল একসময়, স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাসে, ট্রেনে, পরিচিত, অপরিচিত প্রায় সবার টিটকারির শিকার হয়েছে সে প্রতিনিয়ত। যেন সে ইচ্ছে করলেই বেশ পছন্দসই একটা বপু অার লাল্টুস মার্কা গায়ের রঙ নিয়ে জন্মাতে পারত, নেহাত নিজের অনিচ্ছেয় এই না তথাকথিত সুন্দর হয়ে না জন্মানোটা ক্ষমার অযোগ্য একটা ভুল তার, অার তারই শাস্তি তাকে উজাড় করে দিতে কার্পণ্য করত না কেউই। টোটন মুখ বুজে সহ্য করত সব অপমান অার টিটকারি, মনে মনে কুঁকড়ে যেত নিজের মধ্যেই, রাতে বালিশে মুখ গুঁজে বাচ্চাদের মতো কাঁদত, অার মায়ের কাছে গিয়ে তার এই ‘কদাকার’ চেহারার ব্যাখ্যা চাইত ছোটবেলায়। মা তাকে কোলে নিত, কপালে চুমু দিত, অার সান্ত্বনার স্বরে বলত, কে অামার ছেলেকে কালো বলে এ্যাঁ? কার এত সাহস? অামার ছেলের চে সুন্দর চেহারা অার কার অাছে শুনি? তুমি তো অামার চাঁদের কণাটা, ময়না সোনাটা!
ছোটবেলায় মার অাদরে গলত টোটন।
কিন্তু একটু বড় হতেই সে বুঝেছিল, মা যতই বলুক, অন্যদের চোখে সে মোটেই চাঁদের কণাটি নয়। বরং তাদের চোখে সে একেবারেই ‘নিগ্রোদের মতো’। কথাটা যত শুনত টোটন, ততই গুটিয়ে যেত নিজের ভেতর, হীনম্মন্যতা জন্মাত মনে, ক্ষোভ, হতাশা অার অভিমানে মরে যেতে ইচ্ছে করত তার, অার নিজের প্রতি টের পেত ঘৃণা। মাকে সে ভালোবাসত ভীষণ। পৃথিবীতে এই একজন অাছে, যার চোখে সে অন্তত কুৎসিত নয়, ভেবে কৃতজ্ঞতায়, ভালোবাসায়, করুণায় চোখে জল জমে যেত তার।
এই মাঝ বয়সে এসে রাস্তা-ঘাটে গ্লোরির এই অাহ্লাদটুকু তাই যতটা না উপভোগ করে সে, তারচে বেশি এক বিকৃত অানন্দে ভরে থাকে তার মন। অচেনা লোকগুলো তাদের দুজনকে নিগ্রো ভেবে অাগ্রহ নিয়ে দেখে, তাদের একান্ত হয়ে বসে থাকাটুকুতে নিজেদের অনভ্যস্ততা প্রকাশ করে বিস্মিত দৃষ্টি দিয়ে, অার পরিচিতজনেরা তাদের দেখে কৌতুক অার ঈর্ষার এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে। টোটনের মতো বাতিল একজনের জন্য এমন ‘অাফ্রিকান হাতি’ ই যথার্থ, ভেবে কৌতুক উপচায় চোখে, অাবার গ্লোরির অর্থনৈতিক গুরুত্ব ভেবে ঈর্ষা চলকায় তাদের চোখে, টোটন পরিষ্কার বোঝে। সে কারণে সে উপভোগ করে ব্যাপারটা, অানন্দও পায়। অাগে সে সব রকম সামাজিক অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলত, নেহাত বাধ্য না হলে কোনো জনসমাগমে যেত না। অাজকাল যায়। গ্লোরিকেও সাথে নিয়ে যায়। উপযাচক হয়ে পরিচিত হয় সবার সাথে, গ্লোরিকেও পরিচয় করিয়ে দেয়। ‘লিভ টুগেদার’ করছে তারা, যেচে গিয়ে তথ্যটা দেয় সবাইকে। শুনে সাপ দেখার মতো চমকায় অনেকে, সং দেখার মতো হা করে গেলে তাকে অার গ্লোরিকে। পারলে বয়কট করত তাকে, বের করে দিত এসব অনুষ্ঠান থেকে পরিচিতজনেরা, বোঝে টোটন। কিন্তু দুনিয়া বড়ই অাজব জায়গা। তারচে অাজব টাকা। টাকায় যে কী হয় অার কী না হয়, অাল্লা মালুম। মনে মনে হাসে টোটন। তার হাতে অগাধ টাকা। তার টাকার দিকে তাকিয়ে পরিচিতজনেরা বুকের ভেতর ঘেন্না লুকিয়ে মুখে কেমন ভালোবাসার মাখন মাখিয়ে হাসে, দেখে ভেতরে ভেতরে নিজেই সে ঘেন্নায় মরে। অার টাকা নামক বস্তুটার প্রতি তার প্রেম বাড়ে অারও, নেশা ধরে যায়। শালা! টাকা থাকলে অসুন্দরও তাহলে সুন্দর হয়ে ওঠে! সুন্দরও হতে পারে অসুন্দর! থুঃ!
নাজীব খুব করে অাপ্যায়ন করে তাদের। হেসে হেসে গ্লোরির সাথে কথা বলে, ভাব জমাতে চায়। দূর থেকে দেখে টোটন, মুচকি হাসে। গ্লোরির পাশে ছোটখাট বপুর নাজীবকে দেখায় অনেকটা টিকটিকির মতো। গ্লোরি ঝুঁকে অনেকটা নিচু হয়ে কথা বলে তার সাথে। নাজীবের কী একটা কথায় খিলখিল হাসে গ্লোরি, হাসির শব্দে অনেকেই তাকায় ঘুরে। হাসান পাশে বসা ছিল টোটনের। বড় বড় চোখে গ্লোরিকে দেখছিল অনেকক্ষণ ধরে, হাসির শব্দে টোটনের দিকে তাকাল ফিরে। ফিসফিসিয়ে বলল, এই অাফ্রিকান মালটারে কেমনে সামলাস, দোস্ত? পুরাই হাতি!
-যেন খুব উঁচুদরের একটা রসিকতা করেছে, চোখ টিপে টোটনের দিকে তাকিয়ে তেমন ঢঙে হো হো হাসে হাসান। টোটন গম্ভীরমুখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে হাসানের চোখে। চোখে চোখ রেখেই নিচুস্বরে বলে, চেষ্টা করে দেখবি নাকি? কথায় বলে, একবার না পারিলে দেখ শতবার!
হাসান অাগের মতোই হাসে। অন্য কেউ শুনতে না পায়, তেমন গলায় বলে, মাফ চাই দোস্ত! ও অামার কম্ম নয়! সারেন্ডার!
সারেন্ডার শব্দটা এমনভাবে বলে হাসান যে টোটনও না হেসে পারে না অার। হাসি থামিয়ে চুপ থাকে কিছুক্ষণ। দম ছেড়ে বলে, তোরা ছোটবেলায় অামাকে নিগ্রো হাতি বলে ক্ষেপাতিস, মনে নাই? তো এক নিগ্রো হাতি অারেক নিগ্রো হাতিকে সামলাতে পারবে না সেটা হয় কখনও?
হাসান হাসে। বলে, হ দোস্ত! মানাইছে দারুণ! তোগোরে দেখে যে কেউ ভাববে তোরা খাঁটি অাফ্রিকান মাল!
গ্লোরিতো খাঁটিই। অামার মধ্যে যা একটু ভেজাল, তবে দেখে তো বোঝার উপায় নাই। -বলে উঠে পড়ে টোটন। এসব ফালতু প্যাচাল অার এখন পোড়ায় না তাকে। এক সময় পোড়াত খুব। কষ্ট দিত ভীষণ। মানুষের উপহাস অার অবজ্ঞা যে কতটা নিঃষ্ঠুর অার অমানবিক হয়, তারচে ভাল কে জানে অার!
ম্যারেজ এনিভার্সারির খাওয়াটা রাতে জমবে অারও। তখন মদ খাওয়া হবে দেদারসে। গ্লোরিকে নিয়ে বের হয়ে পড়ল টোটন। কাজ অাছে তাদের, রাতে অন্য জায়গায় এপয়েন্টমেন্ট অাছে গ্লোরির, ব্যস্ততা অাছে টোটনেরও। ঠিক বের হওয়ার মুখে দিদারের সাথে দেখা হয়ে গেল তার। হন্তদন্ত হয়ে ঢুকছে, মুখে সিগারেট। তাকে দেখে হাসল একগাল, ট্যেরাচোখে গ্লোরির দিকে একবার তাকিয়ে টোটনকে বলল, হেঁ হেঁ! বেনু জানে তো?
গা জ্বলে গেল টোটনের। বিষচোখে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল গ্লোরির হাত ধরে।
ক্রমশ…