• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শিল্পী নাজনীন (পর্ব – ২৮)

বেনু মশলাঘর

মেডিকেলের সামনে জটলা। হরেক লোকের ভীড়। ভাংচুর চলেছে সকাল থেকে। গেটের কাছে ইটপাটকেলের স্তুপ জমে গেছে। নাগালের ভেতরের অনেকগুলো জানালার কাচ ভাঙা। কাচের টুকরো ছড়িয়ে আছে এদিক-ওদিক। গেটের বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করল কণা। পরিস্থিতি উত্তপ্ত। কে একজন লোক মারা গেছে ‘ভুল চিকিৎসায়’। তার আত্মীয়-স্বজন যে যেখানে ছিল জড়ো হয়েছে এসে। আমজনতাও জুটেছে বিস্তর। উত্তেজনার গন্ধ পেয়েছে তারা। এখন তাদের বোঝানো মুশকিল। এই এক যন্ত্রণা ডাক্তারদের। রোগ সারলে আল্লাহ সারায়। ভগবানের দয়ায় রোগী সেরে ওঠে। মরলেই ডাক্তারের ভুল। তাকে ঠ‍্যাঙাও। অদ্ভুত হিসেব মানুষের। মনে মনে গজরায় কণা। চিকিৎসাটা ভুল নাকি ঠিক সেটাইবা কীভাবে বোঝে এরা কে জানে! তাসনূভা আর অরিণ ভেতরে আটকা পড়েছে। গেট অবরোধ করে রেখেছে জনতা। কাউকে বের হতে বা ঢুকতে দিচ্ছে না। দুপুরের খাওয়া হয়নি বেচারাদের। কেয়া বেঁচে গেছে এই হাঙ্গামা থেকে। তার ক্লাস ছিল না আজ। ডেটিংয়ে গেছে নতুন কারো সঙ্গে। এপ্রোনটা রুমে খুলে রেখে এসেছে কণা। বক্সে তাসনূভা আর অরিণের জন্য খাবার। ভেতরে যারা ঢুকছে তাদের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তবেই ঢুকতে দিচ্ছে জনতা। খাবারের বক্স হাতে শুকনো মুখে সামনে এগোলো কণা। চোখে-মুখে কর্তৃত্বের ভাব ফুটিয়ে তার দিকে এগিয়ে এলো এক তরুণ। বখাটে। দেখেই বোঝা যায়। মাতবরির মওকা পেয়ে এখানে এসে একহাত নিতে চাইছে আজ। জেনারেল ওয়ার্ডে রোগী আছে ভাই। খাবার নিয়ে এসেছি- যতটা সম্ভব কণ্ঠ করুণ করে বলল কণা।
আরেকজন ঠ‍্যাঙারে চেহারার লোক এগিয়ে এলো। হাতে বাঁশের মোটা লাঠি। কঠিন গলায় বলল, রোগী কে হয় আপনের? শুনতাছেন না আইজ গ‍্যাঞ্জাম লাগছে? আপনে আইতে গেছেন ক‍্যা? পুরুষ কাউরে পাঠাইতে পারেন নাই?
ভেতরে ভেতরে রাগে জ্বলে গেল কণা। ইচ্ছে হলো লোকটার হাত থেকে লাঠি কেড়ে নিয়ে বসিয়ে দেয় দু ঘা। কষ্টে নিজেকে সামলালো সে। করুণ কণ্ঠে বলল, আসার মতো আর কেউ নাই ভাই। আমার বোন ভর্তি আছে জেনারেল ওয়ার্ডে। ডেলিভারি কেস।
আচ্ছা যানগা। -মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে কণাকে পথ ছেড়ে দিল লোকটা। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল কণা। দ্রুত পায়ে এগোলো। প্রায় উড়ে পৌঁছে গেল তাসনূভা আর অরিণের কাছে। ওটির পাশের লম্বা বারান্দায় তারা তখন পেতে রাখা চেয়ারে পা ছড়িয়ে বসে ক‍্যান্টিনের বাসি সিঙারা চিবুচ্ছে। কণাকে দেখে হৈ হৈ করে উঠল অরিণ। তাসনূভা স্মিত হাসল। সে মিতভাষী। বরাবর কথা কম বলে। তার ব‍্যক্তিত্বের কাছে মাঝে মাঝে কণারা সবাই কুঁকড়ে যায়। মেপে কথা বলার চেষ্টা করে। তাদের সামনে খাবারের বক্স রেখে পাশের চেয়ারটায় ধপ করে বসল কণা। কণ্ঠে কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলল, তোদের জন্য কত মিথ্যে বলতে হলো আজ জানিস? এইটুকু আসতে কত কাঠখড় পুড়িয়ে তবে আসতে হলো! কিছুতেই ঢুকতে দিচ্ছিল না!
তাহলে ঢুকলি কী করে?
সমস্বরে প্রশ্ন করল দুজনে।
কী করে আবার! দেখছিস না এপ্রোন খুলে রেখে এসেছি। তারপরও আটকে দিচ্ছিল। তখন কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম, আমার বোন জেনারেল ওয়ার্ডে ভর্তি। ডেলিভারি কেস। খাবার নিয়ে যাচ্ছি। আমারে যেতে দেন প্লিজ!
কণার বলার ধরণে হেসে গড়াল অরিণ। তাসনূভাও হাসল খিলখিল। খিদে পেয়েছিল দুজনেরই। আর কথা না বাড়িয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এসে খেয়ে নিল গপাগপ। কণা খেয়ে এসেছে হোস্টেল থেকে। চুপচাপ তাদের খাওয়া দেখল সে। খানিক বাদে বিরক্ত গলায় বলল, তোরাও তো দেখি অগা রে। আমার মতো এপ্রোনটা খুলে ব‍্যাগে নিয়ে বেরিয়ে গেলেই তো পারতিস!
ইশ! সে চেষ্টা করিনি ভেবেছিস! আমরা যে অটিতে ছিলাম, সেটা রোগীর সঙ্গে যে ব‍্যাটা ছিল সে দেখেছে। এপ্রোন খুলে যেই বেরোতে গেছি অমনি সে ব‍্যাটা হারামজাদা সবাইকে বলতে শুরু করল, ঐ যে দুজন পালাচ্ছে! ওরা আমার বোনকে মেরে ফেলেছে। ওদের পালাতে দেবেন না! আটকান! ওদের আটকান!
ব‍্যস। জনতা হুল্লোড় তুলে এগোতে থাকল। সঙ্গে শুরু হলো ইটপাটকেল ছোড়া। কোনোমতে দৌড়ে এসে ভেতরে ঢুকেছি। নইলে বেইজ্জতির শেষ ছিল না আজ। কেন যে বালের এই ডাক্তার হওয়ার শখ হয়েছিল! বাল পড়তে গেছিলাম কষ্ট করে। -রাগে গজগজ করতে করতে প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলল অরিণ। কণা শুনলো। বলল না কিছুই। ইদানীং তারও আফসোস হয় প্রবল। এখানকার পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে তার কষ্ট হয় ভীষণ। গত সেমিস্টারে এক কোর্সে ফেল করিয়ে দেয়া হয়েছে তাকে। তার অপরাধ স‍্যারের চেম্বারে সে একা না গিয়ে অরিণকে সঙ্গে নিয়েছিল। তখন তাকে কিছুই বলেনি ডাক্তার বিপ্লব চৌধুরী। হেসে হেসে কথা বলছিল বরং। খোশগল্প করে বিদায় করেছিল সেদিন তাদের। পরে করিডোরে তাকে একা পেয়ে ধমক দিয়ে বলেছিল, এই মেয়ে! তোমাকে না বলেছিলাম চেম্বারে একা আসবে! অরিণকে এনেছিলে কেন তোমার সঙ্গে? ফাজিল মেয়ে!
কণা মনে মনে বলেছিল, একা গেলে তো কেয়ার মতো আমারও বুকের মাপ নিতেন স‍্যার! তাই অরিণকেই সঙ্গে নিতে হয়েছিল অগত‍্যা!
ফলস্বরুপ চৌধুরীর কোর্সে ফেল এসেছে কণার। এমন আরও কত নোংরামি যে চলে এখানে। সেবার নামে রমরমা বানিজ‍্যও চলে হামেশা। রোগীদের প্রতি অবহেলা আর অমানবিক আচরণও খুবই সাধারণ ঘটনা এখানে। তবে সবাই একরকমও নয়। সত্যিকারের মানুষও আছে এখানে। যারা প্রকৃতপক্ষেই সেবার ব্রত নিয়ে এ পেশায় এসেছেন। যেমন আছেন দস্তগীর স‍্যার, কল্পনা ম‍্যাডাম, মাহবুব স‍্যার। যাদের দেখলেই রোগী অর্ধেক সুস্থ হয়ে যায়। যাদের কাছাকাছি গেলে শ্রদ্ধায় মাথা আপনাতেই নত হয়ে আসে।
আজ কী হয়েছিল? রোগী মারা গেল কীভাবে?
গুমোট পরিবেশটা হালকা করতে প্রশ্নটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল কণা। অরিণ লুফে নিল সেটা। ফোঁস করে উঠে বলল, মরবে না তো কি কত্থক নাচবে? শুয়োরের বাচ্চাগুলো মূর্খ। রোগীর পেটে বাচ্চা ছিল উল্টো হয়ে। সারারাত মেয়েটা নরক যন্ত্রণা সহ‍্য করেছে। ব্লিডিং হয়েছে একটানা। বাচ্চাটা পেটের মধ্যেই মরে গেছে রাতে। সকালে যখন এখানে এনেছে ততক্ষণে রোগী কোমায় চলে গেছে। ওটিতে নিয়ে বেডে তুলতে তুলতেই মরে গেছে মেয়েটা। এখন সব দোষ ডাক্তারদের। তারা নাকি চিকিৎসা দিতে দেরি করেছে। শালা শুয়োরের দেশ! মূর্খের আড্ডাখানা! -ঘৃণায় মুখ বিকৃত করল অরিণ। কণা আর তাসনূভা বসে থাকল থমথমে মুখে। ততক্ষণে পুলিশ গিসগিস করছে পুরো মেডিকেল গ্রাউডে। এবার দ্রুত স্বাভাবিক হবে পরিস্থিতি। স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল সবাই।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।