• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শিল্পী নাজনীন (পর্ব – ২৬)

বেনু মশলাঘর

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সময়টা অলস কাটছে আজকাল। আরও মাসখানেক বিশ্রামে থাকতে হবে, পইপই করে বলে দিয়েছে ডাক্তার। রেজারও বিশেষ তাড়া কিছু নেই। বসে বসে বেতন পেলে কে চায় আগবাড়িয়ে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামতে। বরং কটাদিন শুয়ে বসে কাটানো যাক। জীবন গেল শুধু দৌড়াতে দৌড়াতে। কিংবা তার নিজের ভাষায়, কুকুরের মতো ল‍্যাংচাতে ল‍্যাংচাতে। মায়ের মৃত্যুর পর রেজার বাপ, গাঁয়ের মোড়ল চৌধুরী সাহেব ছ মাসের মাথায় বিয়ে করে ভোল পাল্টে ফেলার পর থেকে সেই যে ল‍্যাংচানি শুরু হয়েছে রেজার, তার শেষ কোথায়, নিজেই কি জানে সেসব! ভাগ‍্যিস আর কোনো ভাই-বোন ছিল না তার। থাকলে আরও কত দুর্দশা জুটত কপালে কে জানে। অন্তত অত সহজে চৌধুরীর তালুক-মুলুক ছেড়ে এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়া সহজ হতো না তাতে। পিছুটান মানুষকে অনেক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ আর ঘটনার সঙ্গে মানিয়ে নিতে বাধ‍্য করে, ব‍্যাপারটা সেই থেকে বুঝেছে রেজা। তাকে অন্তত তেমন পরিস্থিতির শিকার হতে হয়নি, ভেবে ভেতরে ভেতরে দারুণ স্বস্তি পায় সে। মা-বাবার প্রতি খানিকটা কৃতজ্ঞতাও জমা হয় মনে। রেজা চলে আসার পর যা কিছু ছিল তার বাপের, সব নিজের নামে করিয়ে নিয়েছিল চৌধুরীর নয়া বউ। একটা মেয়েও নাকি হয়েছিল এ পক্ষে। মেয়ে আর সম্পত্তি, সব বগলদাবা করে, চৌধুরীকে পথে বসিয়ে বাপের বাড়ি ভেগেছিল চৌধুরীর পেয়ারের নয়া বউ। চৌধুরীর শেষ জীবন কেটেছে অবহেলা, অপমান আর চরম দারিদ্র্যে। এসবই দূর থেকে লোকমুখে শুনেছে রেজা। কাছে গিয়ে সত‍্যতা যাচাইয়ের আগ্রহ হয়নি। কিংবা কাছে গিয়ে বাপের দুর্দশা মোচনের ইচ্ছে জাগেনি। তার মনে তখনও মা মারা যাবার পর বাপের নতুন বিয়ে আর তার পর পরই লোকটার আমূল পাল্টে যাওয়ার দগদগে ক্ষত। সেটা এখনো তেমনি দগদগে। বিভৎস। স্নেহময় এক পিতার রাতারাতি অমন গণেশ উল্টে যাওয়া রূপ সহ‍্য হয়নি রেজার। মার স্মৃতিটুকু বুকে নিয়ে, কাউকে কোনো অভিযোগ না জানিয়ে, এক কাপড়ে বাড়ি ছেড়েছিল সে। আর কোনোদিন ফিরবে না, প্রতিজ্ঞা করে বেরিয়ে পড়েছিল, ফেরেওনি আর। বাপ গত হয়েছে বছর দুয়েক আগে, খবর পেয়েও যায়নি তখন রেজা। আশ্চর্য। লোকটাকে শেষবারের মতো দেখার বিন্দুমাত্র আগ্রহ বা ইচ্ছে, কোনোটাই নিজের ভেতর খুঁজে পায়নি তখন সে। বরং অদ্ভুত এক ক্লান্তি টের পেয়েছিল নিজের মধ্যে। লোকটার সঙ্গে এতকাল মনে মনে চালিয়ে যাওয়া যুদ্ধটা অবশেষে শেষ হওয়ায় ক্লান্ত আর অবসন্ন মন নিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল সেই রাতে। অথচ বাপ-ছেলের এই যুদ্ধে এতটা ক্লান্তি যে জমে গেছিল মনের ভেতর, সেটা রেজা নিজেই বুঝতে পারেনি তার আগে। আচ্ছা, ঐ লোকটার মনেও কি ঠিক একইরকম ক্লান্তি জমেছিল? কিংবা আরও কিছু বেশি? শেষ মুহূর্তে কি লোকটার মনে কোনো শোচনা জন্মেছিল? কিংবা রেজাকে একবার দেখার তৃষ্ণা? প্রশ্নগুলো, কেন কে জানে, বারবার ঘাই দিয়ে যাচ্ছিল রেজার চৈতন‍্যজুড়ে। লোকটাকে তবু দেখতে যায়নি রেজা। প্রশ্নই ওঠেনি। সে কী করে ভুলে যাবে শুধু এই লোকটার ভুলের জন‍্যই একটা জীবন লেংচে কাটাতে হচ্ছে তাকে! বাপের অগাধ সম্পদ আর প্রতিপত্তি থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে তার জীবন কেটেছে রাস্তায়, স্টেশনে, বস্তিতে, মানুষের করুণা ভিক্ষা করে। যে জীবনে এসে যুক্ত হয়েছে এমনকি আলেয়ার মতো মানুষেরা পর্যন্ত। নিজের এই জীবনের প্রতি বিপুল ক্ষোভ আর ঘৃণা ছাড়া আর কিছু নেই রেজার। বাপের প্রতিও। তবু, লোকটা মরার পর কেমন একটু কষ্ট মতো হয়েছিল রেজার। খারাপ লেগেছিল ভেতরে ভেতরে। করুণার মতো কেমন একটা বোধ তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল কয়েকটা দিন। অই পর্যন্তই। তার বেশি কিছুর সুযোগ দেয়নি রেজা তার ছন্নছাড়া মনকে। পথে পথে ঘুরে প্রায় বখে যেতে যেতে কী মনে করে একসময় ড‍্রাইভিংটা শিখেছিল সে। দু চারপাতা বই পড়া বিদ‍্যেও ছিল তার পেটে। ভাসতে ভাসতে ততদিন আলেয়াও এসে গেছে তার জীবনে। আলেয়ার আলোয় রেজা তখন আগুপিছু ভুলে পড়ে থাকল তার ডেরায়। তার তখন নিজের বংশ পরিচয় নিয়ে বাহাদুরি করার কিংবা অতীত নিয়ে অহংকার দেখানোর সময় নেই। বরং সব ভুলে নতুনের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতেই সে উন্মুখ। বাপের মুখে চুনকালি মাখতে পারলেই তার সুখ। ফলে আলেয়াতে তার কোনো অরুচি হয়নি মোটেই। আলেয়াই তাকে চেষ্টা তদ্বির করে চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। তখন আলেয়াই ছিল তার একমাত্র ত্রাতা। তার প্রতি অরুচির তাই কারণই ছিল না কোনো। কিন্তু আজকাল হচ্ছে। আলেয়াতে এখন মন মজে না আর। বাপের মৃত্যুর পর তার মুখে চুনকালি মাখানোর প্রশ্নটা যেহেতু এখন নেই। তাছাড়া এমনিতেও আলেয়া তাকে আগের মতো টানে না। বিশেষত এবার অসুস্থতার পর থেকে, কেয়ার অতি আন্তরিক ব‍্যবহারে, তার প্রতি কেয়ার যত্নাতিশয‍্যে ধীরে ধীরে তার প্রতি আরও বেশি আসক্তি বাড়ছে রেজার। সেই সাথে আলেয়ার প্রতি বাড়ছে বিরক্তি। তাকে আর সহ‍্যই হচ্ছে না আজকাল। তাকে দেখলেই মেজাজ খারাপ হয় ভীষণ। আলেয়াও বুঝেছে সেটা। প্রথম প্রথম গালমন্দ করত, চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় করত, ইদানীং আর এ পথ মাড়াচ্ছে না সে। চুপ হয়ে গেছে একদম। দেখা হলেও না চেনার ভান করে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছে নিজের পথে। যাক। স্বস্তি চায় রেজা। আলেয়া কি অকৃজ্ঞত ভাবছে তাকে? ভাবুক। বিশ্বাসঘাতক ভাবছে? থোড়াই কেয়ার করে তাতে রেজা। পৃথিবীটাই নিমকহারামদের দখলে, সে কেন দলছুট হতে যাবে খামোখা! জন্মের পর থেকে এখন পর্যন্ত কাকে সে দেখেছে যে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি তার সঙ্গে? নিজের ভাগ্যটাই তার সবচে বড় বিশ্বাসঘাতক। সবচে বড় নিমকহারাম। তাকে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে অবহেলা আর অপমানের গভীরতম খাদের কিনারে। সে ছিল এক সামান্য বল। ভাগ্য তাকে লাথি দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে একেকবার একেক গোলপোস্টে। আলেয়া আর কেয়াও ভাগ‍্য নির্ধারিত তেমনই একেকটা গোলপোস্ট তার কাছে। সেই শিশুবেলা থেকে ভাগ‍্যের লাথি খেতে খেতে, ল‍্যাংচাতে ল‍্যাংচাতে এ পর্যন্ত এসেছে সে। কারো কাছে আশাতিরিক্ত খাতির পেলেই সে তাই বর্তে যায়। আলেয়া তাকে প্রেম দিয়েছিল, দিয়েছিল প্রশ্রয়। এখন দিচ্ছে কেয়া। তার ব‍্যবহারে ডাক্তারের স্বভাবসুলভ সেবার চেয়েও আছে প্রেমিকার আবেগঘন যত্ন। আপাতত তাই আলেয়া বাদে কেয়ার প্রতিই মনোযোগ তার। তাতে যে যা বলে বলুক। আপত্তি নাই তার। আলেয়ার ভাষায় আপাদমস্তক নিমকহারাম সে, বিশ্বাসঘাতক। বেশ। সে তবে তাই। দুনিয়াসুদ্ধ লোক যেখানে নিমকহারাম, বিশ্বাসঘাতক আর স্বার্থপর সেখানে তার একার কিসের দায় পড়েছে সাধুসন্ত হওয়ার! ও পথ মাড়াবে না সে। সে খারাপ। অতি অসাধু। তাই ই থাকবে। আপাতত কেয়াতেই সব মনোযোগ তার। কেয়াই একমাত্র আরাধ‍্য। আলেয়া বাদ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।