• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শিল্পী নাজনীন (পর্ব – ২৪)

বেনু মশলাঘর

স্টেশনের প্লাটফর্মের একপাশে, নিজের জায়গাটাতে বসে আনমনে লোকজনের যাওয়া-আসা দেখছিল মেহেরবানু। লোকজনের এই অর্থহীন ব‍্যস্ততা দেখতে বেশ লাগে তার। মেহেরবানু চুপচাপ দেখে আর মিটিমিটি হাসে। তার বলিরেখা ভরা তামাটে মুখে সে হাসি দিন গড়ানোর সাথে সাথে বিস্তৃত হয় আরও। মানুষগুলো কী বোকা! হাসে আর ভাবে মেহেরবানু। এত ব‍্যস্ত হয়ে কোথায় ছুটছে তারা! কোন মোক্ষ লাভে! সেই তো একই গন্তব্য নির্ধারিত সবার জন‍্যই! মৃত্যু! সে জন্য এত হন্যে হয়ে ছোটার কী আছে বাপু! সে তো ঠিক সময় মতো হাজির হবে এসে প্রত‍্যেকের শিয়রে! কথাগুলো ভেবে দীর্ঘশ্বাস পড়ে মেহেরবানুর। সব ভালো লাগে তার। স্টেশনের এই কু ঝিক ঝিক ট্রেনের শব্দ, এই ছন্দময় দুলুনি, লোকজনের এই অর্থহীন ছুটোছুটি, ব‍্যস্ততা, ফেরিঅলার চিৎকার, হকারের হাঁকডাক, এখানকার বাসিন্দাদের খেয়োখেয়ি ঝগড়া, এমনকি তার থেকে হাতকয়েক দূরের মৌসুমী নামক মেয়েটার রাতদুপুরে খদ্দের সামলানোয় তাল দিতে তার সদ‍্য বিয়োনো তিনমাসের বাচ্চাটার হ‍্যাপা সহ‍্য করা পর্যন্ত, সব ভালো লাগে তার। ভালো লাগে না শুধু এই একটা ব‍্যাপার। মৃত্যু। কেন রে বাপু! বেশ তো বেঁচেবর্তে আছে সে। খেয়ে, না খেয়ে, বেশ তো দিন যাচ্ছে তরতরিয়ে। মরতে কেন হবে তাহলে! কোনো মানে হয়! মরতে একেবারেই ইচ্ছে করে না মেহেরবানুর। অসহ‍্য। সব আছে, সব থাকবে, শুধু সে একা নাই হয়ে যাবে, এরচে অদ্ভুত কথা আর কী হতে পারে! কপালে ভাঁজ তুলে ভাবে মেহেরবানু। পান চিবোয় আর ভাবে। মৌসুমী চিৎ হয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। বেশবাস ঠিক নেই কিছু। নোংরা। মাছি উড়ছে তার মুখের আশেপাশে। মুখের একপাশ গড়িয়ে লালা পড়ে দাগ জমেছে গাঢ়। পাশে তার তিনমাসের বাচ্চাটাও গভীর ঘুমে। বাচ্চাটাকে একহাতে জড়িয়ে আছে মৌসুমী। বাচ্চার সামান্য নড়াচড়া মুহূর্তে জাগিয়ে দেবে তাকে। সেদিকে তাকিয়ে দেখল মেহেরবানু। বক্কর আলীকে নিয়ে তার যুদ্ধটা খুব সহজ না হলেও এতটা কঠিনও ছিল না আদতে। অন্তত পরিচয় দেয়ার মতো একটা বাপের নাম পেয়েছিল বক্কর আলী। মৌসুমীর বাচ্চাটার তুলতুলে মুখটা স্পষ্ট নয় এখান থেকে। চোখে আজকাল ঝাপসা দেখে মেহেরবানু। তবু বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে চেনা-পরিচিত কারো আদল খোঁজে সে। পায় না। মাঝে মাঝে মৌসুমীকে জিগ্যেসও করে বসে আলটপকা, ইঁলো মাগি, তোর গেঁদার বাপ কিডা লো?
উত্তরে মৌসুমী ফ‍্যাক ফ‍্যাক হাসে। তার অপরিচ্ছন্ন, উষ্কখুষ্ক মাথা চুলকে বলে, অসপ জানিনে নানী। কেম্মা কবো!
হারামজাদি! খালি নাঙ নিয়ে শুবের জানো, তেয় না? মুখ ভেংচে খেঁকিয়ে ওঠে মেহেরবানু। মৌসুমী গা করে না। সে বাচ্চাটাকে মনোযোগ দিয়ে তেল কাজল মাখায়। চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে তোলে তার কচি মুখ। দেখে মন কেমন করে মেহেরবানুর। মৌসুমীর মন্দভাগ‍্য দেখে তার দুঃখ হয় খুব। আন্তরিক গলায় বলে, কেবা ইয়ে মানুষ হরবি তুই? ছাওয়াল অলি পরে তাও অতে! এই মিয়া নিয়ে কী হরবি তুই? ইটু ডাঙর অলি উয়োকও দেহিস তোর মতোই শিয়েল-কুত্তোয় ছিঁড়ে খাবি!
মৌসুমী শুনে ফোঁস করে ওঠে। গায়ে ফোস্কা পড়ে যেন। রাগী, তীব্র গলায় বলে, ফালতু কতা কবা না কলাম নানী। আমার মিয়াক লেহাপড়া শিহেবো আমি। বড় অপিছার বানাব তাক, দেহে তুমি।
শুনে হাসে মেহেরবানু। সস্নেহে বলে, আচ্চা শিহেসখেনে। আমার লাতিনও তো কত লেহাপড়া শিকতেচে, ডাক্তারি পড়তেচে। না অয়খেনি মিয়া। তাই কী অয়চে! মানুষ হইরবের পারলি ছাওয়াল কী আর মিয়া কী সেহন! সপ এক।
খুশিতে মাথা দোলায় মৌসুমী। মেহেরবানুর একটু আগের কথা ভুলে যায় মুহূর্তেই। মেয়েটা বড্ড সরল। মাথার দোষ আছে। কীভাবে সে এই নরকে এসে পড়েছে কে জানে। জিগ্যেস করলে উত্তর দেয় না। মাথা চুলকায়। আর ফ‍্যাক ফ‍্যাক হাসে।
সেই দিনগুলো মনে পড়ে যায়। সেই উনিশশ একাত্তর। বক্কর আলীর বাপ মুক্তিযুদ্ধে গেল। ট্রেনিং নিতে হুট করে একদিন চলে গেল ভারতে। তারপর ফিরলেও ঘরে আর ফেরেনি লোকটা। যুদ্ধেই মারা পড়েছিল, বলেছে সঙ্গের লোকজন। শহীদ। কথাটার অর্থ কী, কে জানে! মেহেরবানুর তখন ভরা যৌবন। বক্কর আলী মাত্র বছর তিনেকের। লোকটা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে সেই অপরাধে গ্রামের শান্তিবাহিনীর সদস্য শমসের আলী মেহেরবানুকে তুলে দিল পাকিস্তানি মিলিটারিদের গাড়িতে। প্রায় তিনমাস বন্দী ছিল মেহেরবানু। ছিল তার মতো আরো অনেকে। সয়েছিল জানোয়ারদের অকথ‍্য অত‍্যাচার। কী করে যে বেঁচেছিল মেহেরবানু! আত্মহত্যা করারও চেষ্টা করেছে তখন কতবার। পারেনি। শুয়োরের বাচ্চাগুলো উলঙ্গ করে রাখত মেয়েরবানুদের। যাতে পরনের পোশাক গলায় পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করতে না পারে মেহেরবানুরা। তাছাড়া তাদের উলঙ্গ শরীর দেখে বিকৃত আনন্দ পেত পিচাশগুলো। বেয়নেট দিয়ে খোঁচাত। উল্লাস করত। সেখানে থাকতেই বক্কর আলীর বাপের শহীদ হওয়ার খবর পেয়েছিল মেহেরবানু। বাঁচার ইচ্ছে আর সম্ভাবনা দুইই ফিকে হয়ে গেছিল তার। তার ধারণা ছিল বক্কর আলী না খেতে পেয়ে ততদিনে মারা গেছে নির্ঘাত। আচমকা একদিন ছাড়া পেয়ে গেছিল তারা। দেশ নাকি স্বাধীন হয়ে গেছে। পাকিস্তানি মিলিটারিরা লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে, বলাবলি করছিল সবাই। গ্রামে ফিরেছিল মেহেরবানু। তাকে দেখে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল গ্রামবাসি। গ্রহণ করেনি তার পরিবারও। ছি ছি করছিল সবাই। মেহেরবানুর জন্য সেখানে জায়গা ছিল না আর। তার মতো, যারা অমন দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছিল তখন, তাদের প্রায় কারোই পরিবারে বা পরিচিত সমাজে ঠাঁই মেলেনি আর। আত্মহত্যা করেছিল অনেকেই। মেহেরবানু পারেনি। জীবনকে ভালোবাসত সে। তাছাড়া ফিরে এসে দেখেছিল টিমটিমে বাতির মতো তখনও টিকে আছে বক্কর আলী। মেহেরবানুর আঁধার ঘরের সলতে হয়ে জ্বলছে নিভুনিভু। তাকে নিয়ে গ্রাম ছেড়েছিল মেহেরবানু। ভাসতে ভাসতে চলে এসেছিল এই মফস্বল শহরে। তারপর কত উত্থান-পতন। কত সংগ্রাম। বক্কর আলী হাজী বক্কর আলী এখন। মেহেরবানুকে চেনে না আর। না চিনুক। তাতে দুঃখ নাই আর মেহেরবানুর। এই খোলা হাওয়ায়, স্টেশনের এই কোলাহলময় প্লাটফর্মে যেন তেন প্রকারে বেঁচে থাকতে পারাতেই সে ভীষণ সুখি এখন। বাহুল্যে তার প্রয়োজন নেই। পুরনো স্মৃতি ঘেঁটে এসব ভেবে সবে একটা দশাসই দীর্ঘশ্বাস গড়াচ্ছিল মেহেরবানুর। ঠিক তখনই কানের কাছে গর্জে উঠল কণার ক্ষ‍্যেপা কণ্ঠ। হারামি বুড়ি! আবার পালিয়ে এসেছ এখানে! মজা দেখাচ্ছি তোমার, দাঁড়াও!
চমকে তাকাল মেহেরবানু। কণার চণ্ড মূর্তি দেখে মুখ শুকাল হঠাৎ। আবার বন্দীদশা শুরু হলো, ভেবে হতাশ মাথা নাড়ল সে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।