• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শিল্পী নাজনীন (পর্ব – ২৯)

বেনু মশলাঘর

ওটির সামনে সকাল থেকেই মচ্ছব বসেছে আজ। কে একজন মারা গেছে অপারেশন টেবিলে তুলতে তুলতেই। তার জ্ঞাতী-গোষ্ঠী যে যেখানে ছিল সব এসে জড়ো হয়েছে খবর পাওয়া মাত্রই। মাছের হাট বসিয়ে দিয়েছে তারা। ভাঙচুর চালিয়েছে বাইরে। এখানে সুবিধা করতে না পারলেও ভীড় জমিয়ে ডাক্তারদের পিণ্ডি চটকাচ্ছে ইচ্ছেমতোন। খিস্তি-খেউর করে যাচ্ছে সমানে। অন্য রোগী, যাদের জরুরি অপারেশন দরকার তারা পড়েছে মহাবিপদে। তাদের স্বজনেরা নানানভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে, থামাতে চাইছে লোকগুলোকে, কিন্তু কিছুতেই থামছে না গোঁয়ার লোকগুলো। ওটিরুমে সদ‍্য প্রাণ হারানো মেয়েটা পড়ে আছে তখনও স্ট্রেচারে। পেটে মৃত সন্তান। পর্দা উঁচিয়ে একফাঁকে দেখে এসেছিল আলেয়া। পেটটা ফুটবলের মতো আরও ফুলে উঠছে ক্রমশ। মুখটা রক্তশূন্য, কাগজের মতো সাদা। এত চিৎকারের মধ্যে কারও সময় হয়নি লাশটাকে ঢেকে দেয়ার। মুখের ওপর মাছি ভনভন করছে। বিভৎস। সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নিয়েছিল সে। এসব দৃশ্য তার সহ‍্য হয় না। এত বছর হাসপাতালে কাজ করছে সে, তবু মৃত্যু আজও তাকে বিচলিত করে ভীষণ। মেয়েটার বয়স বড়জোর বছর কুড়ি। মেয়েটার জায়গায় রোশনিকে কল্পনা করে কেমন হিম হয়ে আসতে চায় শরীর। ওটি থেকে খানিকটা দূরত্ব রেখে সে নজর রাখে পুরো দৃশ্যে। ডাক্তাররা নির্বিকার। এমন মৃত্যু প্রতিদিন দেখে তারা। আলেয়াও কত দেখেছে। কিন্তু সে অমন নির্বিকার হতে পারেনি আজও। হয়তো মূর্খ বলেই। হয়তো সে বোকা বলেই। সে ডাক্তারদের দেখে, একদিকে তারা কাটা-চেরা করে, অপারেশন চালায়, অন‍্যদিকে পাশে দাঁড়ানো অন‍্যদের সঙ্গে হাসিঠাট্টায় মেতে ওঠে একই সময়ে। জটিল অস্ত্রপচার সেরে মুহূর্তেই হাতের গ্লাভস খুলে চলে যায় খাবার টেবিলে। মৃত্যু দেখেও মুখের একটি রেখারও পরিবর্তন ছাড়াই তারা যোগ দেয় জীবনের কোলাহলে। নার্সদেরও দেখে সে হাসিমুখে সব পরিস্থিতিকে সামলে নিতে। অথচ আয়া সে, আলেয়া, পারে না। মৃত্যু দেখলেই চোখে জল আসে তার। শিথিল হয়ে আসে শরীর। আজকের মৃত্যুটা যেন কেমন। আহা। বাচ্চাটা। পৃথিবীতে আসতে চেয়েও আসা হলো না তার। না জানি কত কষ্ট পেয়ে সে মারা গেছে মায়ের পেটেই। আর ঐ মা। কতটা যন্ত্রণা পেয়ে সে মরল। আহা। নারীজনম। নিজের স্মৃতিটা জাগল মনে। রোশনি হওয়ার সময় এমনই যন্ত্রণা সহ‍্য করতে হয়েছিল তাকেও। মরতে মরতে বেঁচে গেছিল সেবার। না কোনো ডাক্তার ছিল, না কোনো বদ‍্যি। স্রেফ দাইটা অভিজ্ঞ ছিল। তাই পুরো তিনদিনের নরকযন্ত্রণার পর মুক্তি পেয়েছিল সে। রোশনিরও বাঁচার আশা ছিল না। তবু বেঁচে গেছিল মেয়েটা। মেয়ে বলেই হয়তো। নারীজনম মানেই অভিশপ্ত। যন্ত্রণা ভোগের জন্যই কেবল বেঁচে থাকে তারা। ভাবে আলেয়া। ওটির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ এখন। লাশ সম্ভবত পেছনের দরজা দিয়ে সরিয়ে নেয়া হয়েছে মর্গে। ভেতরে আলো জ্বলছে। তার মানে নতুন অপারেশন শুরু হয়েছে। মৃত্যুকে অস্বীকার করে আবার শুরু হয়েছে জীবনের বন্দনা। পুলিশ এসে সরিয়ে দিয়েছে হুল্লুড়ে লোকগুলোকে। দ্রুত নিজেকে সামলে নিল আলেয়া। কাজে মন দিল। অটির সামনেটা পরিষ্কার করল অভ‍্যস্ত দ্রুততায়। রোশনিকে দেখল একঝলক। আজ ওটি ডিউটি ছিল তার। ইন্টার্নি করছে কুশল। ওটিতে যেদিন ডিউটি থাকে তার, সেদিন ডাক্তারদের বলে রোশনিরও ডিউটি ফেলে সে। ডিউটি বলতে সামান্য। ছুরি-কাঁচি এগিয়ে দেয়া, ফাইফরমাশ খাটা। ইন্টার্নি ডাক্তারদের কাজও তেমন কিছু নয়। মূলত দেখে শেখা। সহায়তা করা। কিন্তু ব‍্যাপারটায় কেমন খুঁতখুঁত করে আলেয়ার মন। অপারেশন টেবিল মানেই জীবন-মৃত‍্যর খেলা। সেখানে কোনোরকম অন্যমনস্কতা বা অবহেলা বড় বিপদ আনতে পারে। ঘটাতে পারে বড় কোনো দূর্ঘটনা। রোশনি আর কুশলের একসঙ্গে ডিউটি নেয়ায় তাই সায় দেয় না তার মন। ডাক্তাররাই বা কেমন! তারা কি জানে না রোশনি আর কুশলের সম্পর্কের ব‍্যাপারটা! জানলে কীভাবে অনুমতি দেয় তারা! রোশনি মাকে দেখে চলে গেল ব‍্যস্ত ভঙ্গিতে। হয়তো কুশলের সামনে মাকে দেখে অস্বস্তি হলো তার। হয়তো কুশলের সামনে তার মায়ের পরিচয় নিয়ে কুণ্ঠিত সে, লজ্জিত হয়তো। তবু কীই বা করার আছে আলেয়ার। হাসপাতালের সামান্য এক আয়া সে। এই কাজ করেই সে গ্রাসাচ্ছাদনের ব‍্যবস্থা করে এসেছে এতদিন। রোশনিকেও খাইয়ে-পরিয়ে বড় করে তুলেছে। এখন যদি রোশনি মায়ের পরিচয় নিয়ে বিব্রত হয় কিংবা লজ্জিত, তাতে কিইবা করার আর তার! তবে কুশলের ভেতর কোনো জড়তা দেখেনি আলেয়া। আগেও যেমন সে আলেয়াকে দেখে হেসে কথা বলত, কেমন আছে জানতে চাইত, এখনো তেমনই করে। আলেয়ার মতো মানুষের জন্য এটুকুই ঢের ছিল। তখন, এখনো। কারণ তার সঙ্গে সচরাচর ভালো করে কথা তো তেমন বলে না কেউ। এড়িয়ে যায়। তাচ্ছিল্য করে। কিংবা ঘৃণা। সেখানে কুশলকে প্রথম থেকেই ব‍্যতিক্রম লাগত তার। তা বলে রোশনির বর হিসেবে দুঃস্বপ্নেও তাকে ভাবেনি কোনোদিন। অত সাহস ছিল না তার। কিন্তু ইদানীং তো মনে হচ্ছে ব‍্যাপারটা অনিবার্যভাবেই ঘটতে চলেছে। সে কারণেই ভয় পায় আলেয়া। শেষ পর্যন্ত কী হবে কে জানে! কুশল যদি বা না বিগড়ে যায়, তো তার পরিবার? তারা কোনোদিন মেনে নেবে এই অসম সম্পর্ক? রোশনিকে কোনোদিন বরণ করবে তারা কুশলের বউ হিসেবে? ভেবেই গায়ে জ্বর এসে যেতে চায় তার। আর ভাবতে পারে না সে। রোশনি অবশ‍্য নিশ্চন্ত। ড‍্যাং ড‍্যাং করে সারাদিন কুশলের সঙ্গে ঘুরছে। কোনো বিকার নেই তার। কোনো দুঃশ্চিন্তা নেই। কিছু বললে ঠোঁট উল্টে বলে, ছাড় তো মা। না মানলে না মানবে। পা ধরে কে সাধতে যাবে? দেশে কি কুশল ছাড়া আর ছেলে নাই নাকি? অন‍্য কাউকে বিয়ে করে নেব তখন। আমি সেটা কুশলকেও বলে দিয়েছি।
আলেয়া আকাশ থেকে পড়ে জানতে চেয়েছে, কী বলে দিয়েছিস?
বলেছি, ভেবো না তুমি তেড়িবেড়ি করলে ফ‍্যা ফ‍্যা করে কাঁদতে বসব, ল‍্যা ল‍্যা করে তোমার পেছন পেছন ঘুরতে যাব। দিব‍্যি আরেকজনকে ধরে বিয়ে করে সংসার করতে বসে যাব।
শুনে হাসবে নাকি কাঁদবে ভেবে পায়নি আলেয়া। আজকালকার ছেলেমেয়েগুলো যেন কেমন। তাদের কোনো কিছুই বোঝে না আলেয়া। এই দেখা যায় থৈ থৈ প্রেম এই আবার খটখটা খরা। কেয়াকেও দেখছে আজকাল। রেজার প্রতি তার প্রেমে ভাটা পড়েছে সম্ভবত। আরেকজনের সঙ্গে ঘুরছে এখন। ডেটিংয়ে যাচ্ছে। রেজা আবার আলেয়ার ডেরায় ধর্ণা দেয়ার চেষ্টা করছে ইদানীং। ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছে আলেয়া। হারামজাদা। আস্ত কালসাপ একটা। এখন লেজে বাড়ি পড়েছে বলে আশ্রয় চাইছে এসে। সুযোগ পেলে আবার ছোবল দেবে তাকে হারামখোর। আবার ছুড়ে দেবে অবহেলায়। সে সুযোগ তাকে আর দেবে না আলেয়া। কক্ষনও না।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।