সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শিল্পী নাজনীন (পর্ব – ৯)
by
TechTouchTalk Admin
·
Published
· Updated
বেনু মশলাঘর
বসন্তবৌরি অার মৌটুসির ডাকে ঘুম ভাঙল টোটনের। পাতার অাড়াল থেকে মাঝে মাঝেই ডানা মেলে এ ডাল থেকে ও ডালে যাচ্ছে, বাহারি রঙের লেজ নাড়িয়ে ডাকছে বিচিত্র সুরে। মুগ্ধ চোখে দেখল টোটন, অাড়মোড়া ভাঙল অালস্যে। সকালের ঘুমটা বড় প্রিয় তার, বিশেষত শীতে। পাখির কিচির মিচিরে ঘুমটা সাত তাড়াতাড়ি ভেঙে গেল অাজ। ভালোই হল, ভোরের অাকাশ দেখা হয় না বহুকাল, অার পাখির ডাক সে তো ভুলেই গেছে প্রায়। একসময় পাখির প্রতি ভীষণ অাগ্রহ ছিল তার, রাতদিন পড়ে থাকত পাখি নিয়ে, বাড়িতে এখনও পাখিদের ওপর তার সংগ্রহ করা অনেক বই মিলবে, মিলবে জমানো বহু পত্রিকা যেগুলো মূলত পাখিদের ওপর নানান তথ্যে ঠাসা। সেসব স্মৃতি এখন। এখন তার ধ্যান-জ্ঞান সাইক্লিং। নেশা। সাইকেল নিয়ে সে দেশ-বিদেশের সাইক্লিস্টদের সঙ্গে পাড়ি দেয় মাইলের পর মাইল, বেড়ায় পৃথিবীর নানান প্রান্ত বছরজুড়ে।সাধারণত শীতেই বেরিয়ে পড়ে সে সদলবলে। সেই কারণে মা শাহানা বেগমের অাফসোসের শেষ নেই। শাহানা বেগম চায় অন্তত শীত মৌসুমটা কাছে থাকুক টোটন, শীতের হরেক পিঠা, নানান সবজি, একা একা গলা দিয়ে নামে না তার, টোটন না এলে শীতের পিঠা তার খাওয়াও হয় না একদম। এমনিতেও বয়স হয়েছে, খাওয়ার রুচি নেই-ই বলতে গেলে। তবু, টোটনকে খাইয়ে তার সুখ, স্বস্তি। টোটন বোঝে না সেসব। অন্য ছেলেরাও বোঝে না। কেন যে অাল্লাহতালা একটা মেয়ে দিল না! মেয়ে থাকলে ঠিক বুঝত তার মন! -অাফসোসে মনটা বড় উচাটন হয় শাহানা বেগমের। টোটন তার কোলমোছা ধন, বড় অাদরের। তবু কেন যে ছেলেটা এমন বাউন্ডুলে হল তার! কেন যে ঘর-সংসার করল না জীবনে! অন্য ভাইদের সাথেও সম্পর্ক রাখে না ছেলেটা, বাড়িতে অাসেও খুব কম, নেহাত শাহানা বেগমের অনুযোগ, অভিযোগে অতিষ্ঠ না হলে এ তল্লাট মাড়ায় না টোটন। গতবছর টোটনের সাইক্লিং মিশন ছিল সেই কোন দূরের চীন, জাপান অারও কী সব বিদঘুটে নামের দেশগুলোতে। গতবার ফোনে শাহানা বেগমের কান্নাকাটি অার হাহুতাশের বহর দেখে টোটন কথা দিয়েছিল অাসছে শীতে মার সাথে দেখা করে তবেই সাইক্লিং এর পথ পাড়ি দিতে বের হবে টোটন। শীতটা অবশেষে এসেই গেল এবার। মাকে দেয়া কথা রাখার দায় থেকেই এবার বাড়ি অাসা টোটনের। নইলে এ শহর এখন অার বড় একটা টানে না তাকে। কোথায় যেন সুর কেটে গেছে, পুরোনো সেই সুরে অার বাজে না মন, পরিচিত সেই তালে অার নাচে না বোধ।
বেনু অাজকাল অার টানে না তাকে। কী করে কে জানে, বেনুর কাছেও পৌঁছে গেছে গ্লোরির খবর, তার সাথে টোটনের লিভ টুগেদারের চটকদার খবর গুজবের বাহারি বর্ণে বহুবর্ণা হয়ে পৌঁছে গেছে বেনুর কানেও। কিছুদিন অাগে বেনুর কুশল জানতে ফোন করতেই বেনু্ একগাদা কথা শুনিয়ে দিয়েছে তাকে, গ্লোরিকে নিয়ে করেছে অনেক তীর্যক ঈর্ষাকাতর মন্তব্য। বিরক্ত হয়েছে টোটন। নারীর ঈর্ষাকাতরতা সহ্য হয় না তার, বেনুরটা অারো হয় না। বেনু কতটা জুড়ে অাছে তার, অার কেউ না জানুক, বেনুর তো অজানা নয় সেটা। তবু কেন যে লোকমুখে শোনা কথায় অমন প্রতিক্রিয়া দেখায় সে, কেন হয় অতটা ঈর্ষাকাতর, বোঝে না টোটন। নারী সত্যিই বড় বোকা। নিজের মূল্য ভুলে তুচ্ছকে অমূল্য করে তুলতে জুড়ি নেই তার। নইলে বেনু কী করে গ্লোরির প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়! কী করে টোটনের অনুভূতিটাকে তুচ্ছ করে অমন! গ্লোরি তার সীমাহীন নিঃসঙ্গতায় সামান্য একটু সঙ্গমাত্র, বছরের কটা দিনই বা দেশে থাকা হয় তার এখন, অার গ্লোরির সাথে কটা দিনই বা একসঙ্গে থাকা হয় তার! তবু মানুষ গালগপ্প বানাতে ওস্তাদ! শাহানা বেগমের কানেও কথাটা ঠিক এসে গেছে, এসে যে গেছে, শাহানা বেগমের কথার ধরণেই সেটা বুঝে নিয়েছে টোটন। কাল টোটনকে রাতে খেতে দিয়ে কাছে বসে সংসারধর্ম পালনটা যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ, সেটা বুঝাচ্ছিল শাহানা বেগম, সেটা থেকেই টোটন বুঝে নিয়েছে যা বোঝার।
জানালায় দাঁড়িয়ে বাগানের ভেতরকার ছোট্ট ছাতিমের ডালে বসন্তবৌরি অার মৌটুসির লুকোচুরি অার অারও হরেক পাখির খুনসুটি দেখতে দেখতে হারিয়ে যাওয়া শৈশবটা যেন নিজের চোখে দেখতে পেল টোটন। ছবির মতো ভাসতে লাগল দারুণ সময়গুলো, ফেলে অাসা সময়ের কথা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস গড়িয়ে গেল অজান্তেই। সময় ফুরিয়ে অাসছে, জীবন নামক ছোট্ট শিশিরবিন্দুটি টুপ করে ঝরে পড়ার ক্ষণ এসে যাচ্ছে খুব ধীরে, কেন যেন কথাটা মনে হল টোটনের, মনে হতেই খারাপ হল মনটা হঠাৎ। পেছনে শাহানা বেগমের কণ্ঠে চমক ভাঙল তার। কখন যে মা পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, টেরই পায়নি টোটন। মাকে দেখে একটু সরে দাঁড়াল টোটন, জায়গা করে দিল তাকে পাশে দাঁড়ানোর। মৃদুকণ্ঠে বলল, এখনও এত পাখি অাছে এদিকটায়! বহুদিন পর একসঙ্গে এত পাখি দেখছি! অার এই বসন্তবৌরিটা কী সুন্দর! কী মিষ্টি সুরে ডাকছে, শোনো!
শাহানা বেগম নরম সুরে বলল, কত পাখি যে অাসে অামাদের বাগানে প্রতিদিন! সকাল হলে পাখির ডাকে ভরে ওঠে বাগানটা। এখন তো গাছপালা কমে যাচ্ছে অনেক, পাখিদের বসার জায়গার বড় অভাব চারদিকে, এখানে খানিকটা বসার জায়গা পায়, তাই অাসে ওরা। সকালে পাখিদের দেখলে মনটাই ভালো হয়ে যায়।
হু। -অন্যমনস্কভাবে বলল টোটন। কত যে রঙিন ছিল শৈশবটা তাদের। এ তল্লাটের প্রায় পুরোটা ফাঁকা পড়েছিল তখন, হাতে গোণা দু চারটে বাড়ি ছিল, ধানী জমি অার জঙ্গলে ভরা ছিল এলাকাটা। দারুণ দুরন্ত শৈশবটা চোখের সামনে ভেসে উঠল তার। ঘোর লাগা গলায় বলল, অামাদের সময়ে অারও অনেকরকম পাখি অাসত বাগানে, ওদিকে, বেনুদের বাড়ির উল্টোদিকের বাগানে অামরা বিকেল হলে খেলতে যেতাম, পাখির কিচিরমিচিরে কানে প্রায় তালা লেগে যেত অামাদের। অার বেনুর বাপ গুলতি নিয়ে তেড়ে অাসতো, পাখি মেরে লোকটা কী অানন্দ পেত কে জানে!
সন্তর্পণে ছেলের মুখের দিকে একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নেয় শাহানা বেগম। টোটনের ঘোর লাগা কণ্ঠের স্মৃতিতর্পণে হঠাৎ বেনুর নাম শুনেই থমকে যায় সে। তার ছেলের জীবনটা কি এই মেয়েটার জন্যই এমন ভবঘুরে, বাউন্ডুলে হল শেষে? এমন ছন্নছাড়া, লক্ষ্মীছাড়ার জীবন হল কি এর কারণেই? বুকটা কেন টনটন করে শাহানার। টোটনের মুখের দিকে করুণ তাকিয়ে থাকে খানিক। স্খলিত, ক্লান্ত গলায় বলে, চল বাবা। অনেক বেলা হল, নাস্তা খাবি চল।
মার কথায় চমকে ঘড়ি দেখে টোটন। সবে সাড়ে অাট। তার এখন সবে সকাল। ছুটির দিনগুলোতে এ সময় তার ঘুমই ভাঙে না সচরাচর, যদি না কোনো কাজের তাড়া থাকে। কিন্তু শাহানার কথায় অাপত্তি করল না টোটন। মার ভোরে ওঠার অভ্যাস, জানে সে, অাটটার মধ্যে নাস্তা করে নেয় মা, অাজ টোটনের জন্য এখন অবদি না খেয়ে বসে অাছে। টোটন তাই বাধ্য ছেলের মতো তৈরি হয়ে নিল, মুখ-হাত ধুয়ে বসল এসে মার পাশে, অাগের মতোই বারান্দায় ডাইনিং টেবিল রাখা, সকালের মিষ্টি রোদ এসে পড়েছে সেখানে, টোটন বসতেই অারামদায়ক এক উষ্ণতা জড়িয়ে ধরল তাকে, ফুলকো লুচিতে কামড় দিতেই সেই হারানো স্বাদটা লেপ্টে গেল জিবে। অাহা। মা! মা মানেই মমতা, মায়ার এক অন্তহীন সমুদ্র! -মনে মনে ভাবল টোটন। ইচ্ছে হল সেই ছোট্টবেলার মতো জড়িয়ে ধরে মাকে, মার কোলের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে দারুণ অাহ্লাদে। কিন্তু শাহানা বেগম সেই পরিচিত ফর্মে তখনও। টোটনের প্লেটে অার দুটো লুচি-মাংস তুলে দিতে দিতে সে তখন বলে চলেছে, বাবা রে, সোনা অামার, এবার দেখে-শুনে একটা বিয়ে করো। অামি তোমার সংসার দেখে একটু শান্তিতে মরি। এমন ছন্নছাড়া অার কতদিন, ও বাপ! তুমি বলো তো পাত্রী দেখি অামি। অার নয়তো ঢাকায় তোমার যে বান্ধবী অাছে, গ্লোরি না কি যেন নাম, তুমি চাইলে না হয় তাকেই বিয়ে করো, অামার তাতে কোনো অাপত্তি নাই, তা-ও এমন বাউন্ডুলে জীবন ছাড়ো, অামার বাবা ভালো, কথা শোনো, ও বাপ!
মার কথায় ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড বিরক্ত হল টোটন। মুখে বলল না কিছু। খারাপও লাগে তার। মা তার জন্য চিন্তায় অধীর হয়, তার জন্য নির্ঘুম রাত জাগে, বোঝে টোটন। কিন্তু সংসার তার জন্য নয়। পথ তাকে ডাকে, ঘরে অাটকা পড়তে সে চায়নি কোনোদিন। অার মার কাছে কে যে গ্লোরির কথা বলেছে এসে, মা গ্লোরিকে টোটনের বউ হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে, ভেবেই হো হো হেসে ফেলল টোটন। খাবার মুখে অাটকে গেছিল অারেকটু হলেই। জলের গ্লাশটা বাড়িয়ে দিয়ে মুখ ভার করল শাহানা বেগম, খেয়াল করল টোটন, চোখ ছলছলে। সামলে নিল টোটন নিজেকে। হাসি থামিয়ে বলল, কেন যে অামাকে নিয়ে এত চিন্তা কর তুমি মা! বড় হয়েছি তো, এই দেখ, চুলে পাক ধরেছে, দেখেছ?
চুল পাকলেই কি মানুষ বুড়ো হয় রে পাগল! চুল মানুষের এমনিতেই পাকে, মাথা যাদের বেশি গরম, তাদের তাড়াতাড়ি পাকে।
মার কথায় এবার অারেকচোট হাসল টোটন। তারপর উঠে পড়ল। চুলে চিরুনি করতে করতে বলল, অামি একটু বেরোব মা। বহুদিন পর এলাম তো, বন্ধুদের সাথে একটু দেখা-টেখা করে অাসি, তুমি এদিকে পাত্রী দেখতে থাকো বরং ততক্ষণ। -বলে সদর দরজার দিকে পা বাড়াল টোটন। সেদিকে তাকিয়ে চোখ মুছল শাহানা বেগম। ছেলেটা কেন যে এত ছন্নছাড়া হল তার, এমন পাগল!
ক্রমশ…