• Uncategorized
  • 0

প্রবাসী মেলবন্ধনে সুষ্মিতা রায়চৌধুরী (নিউজার্সি)

নির্বাক ভাষাদিবস

“নতুন কিছু উপলব্ধি চাই এই ভাষাদিবসে,হেমনলিনী।শুধু মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ সম বললে ব্যাপারটা খাবে না।ব্যতিক্রমী কিছু ভাবো”,বেরনোর সময় দিগ্বিজয় চ্যাটার্জি আরেকবার মনে করিয়ে দেয় “প্রজেক্ট একুশে”।

“আপনার আর কি!কোনও ভাষাটাই তো আর পুরোপুরি রপ্ত করতে পারেননি।শুধু কায়দাবাজি”-মনে মনে ম্যানেজারের দিকে বিদ্রূপ করে হেমনলিনী।একটা নামকড়া বিজ্ঞাপন এজেন্সীর ক্রিয়েটিভ হেড সে।
সপ্তাহান্তে একরাশ বিরক্তি কর্পুরের মতন উবে যায় বাড়িতে ঢুকলেই।লালা ঝড়া মুখটা রোজ বসে থাকে এই সময়টার জন্য।হেমনলিনী ঘরে ঢুকতেই,তাকে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে হুইলচেয়ারটা।একটা নির্বোধ গোঙানিতে থাকে সিমাহীন ভালোবাসার ভাষা।সারা সপ্তাহ আয়া থাকে হিন্দোলের দেখাশোনা করার জন্য।সপ্তাহান্তে তার ছুটি।ওরা এসে বসে জানলার সামনে।গিটারটা হাতে নেয় হেমনলিনী।একের পর এক সুর তোলে বব ডিলান,পিঙ্ক ফ্লয়েড,বিটেলস।চোখ বন্ধ করে আমেজ নেয় হিন্দোল।কিন্তু যেই মুহুর্তে গিটারের স্ট্রীং-এ ঝড় তোলে বাংলা ব্যান্ড বা মানবেন্দ্র শ্যামলের যুগলবন্দী বা বাউল,পল্লীগীতির ঝংকার,চোখ খোলে হিন্দোল।তালহীন হাতদুটো দিয়েই টেবিলের ওপর সৃষ্টি হতে থাকে এক অবর্ণনীয় লয়।মাথা ঝাকিয়ে হেসে ওঠে দুটো উজ্জ্বল চোখ।অব্যক্ত ভাষায় বুঝিয়ে দিয়ে যায়, “সমস্ত প্রতিবন্ধকতা হেলায় হারিয়ে আমি গর্বিত আমি বাঙালি।”
“কি করে কানেক্ট করিস নিজেকে বাংলা গানের সাথে বলতো”,আদর করে জিজ্ঞেস করে ভাইকে হেমনলিনী।
মাথা ঘুড়িয়ে রাতের খাওয়ার প্লেটটা দেখিয়ে ইয়ার্কির ইঙ্গিত দেয় হিন্দোল।লালা গড়িয়ে পড়া মুখটা চোখ টেপে মজায়।
“আ্যা লুচি,ছোলার ডাল আর মিষ্টি তোকে বাংলাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে?”হেসে ওঠে দুজনেই।
রাত ঘনিয়ে আসে নির্বাক অভিব্যক্তির।ভাই ঘুমিয়ে পড়তেই ক্যামেরাটা নিয়ে বসে হেমনলিনী।সেদিন গাড়ির মর্মান্তিক দূর্ঘটনায় ভাইবোন অনাথ হলেও,হেমনলিনী হয়ে ওঠে “স্পেশাল চাইল্ড” হিন্দোলের মা।ক্যামেরাটায় রেকর্ড করা থাকে হিন্দোলের নতুন সব নির্বাক ভাষা।
ডাক্তারকাকু বলেন,হিন্দোলের মতন মানুষদের বোঝার এবং প্রকাশ করতে না পারার অক্ষমতার জন্য রাগ খুব বেশি হয়।তাই হেমনলিনীর পক্ষে একা সামলানো সম্ভব না হলে সে হিন্দোলকে রেখে আসতে পারে “স্পেশাল স্কুলে”।কিন্তু যেদিন পনেরো বছর বয়সে বাবামায়ের মৃতদেহ দেখে অবুঝ অনুন্নত হিন্দোল হেমনলিনীর হাতে হাত রেখেছিলো,তার বাক্যহীন ভাষাই শান্ত করেছিলো হেমনলিনীর হঠাৎ সব হারানোর আক্রোশ,জুগিয়েছিলো পাশে থাকার ভরসা।
শনিবার আর রবিবার বিকেলে বসে গল্পবৈঠক।একটা বই শেষ হতেই লেগে যায় একমাস।তাড়াতাড়ি পড়লে বুঝতে পারেনা হিন্দোল কিন্তু প্রত্যেকটা গল্পের পর তার নায়ক সাজতে ইচ্ছে করে।আগের মাসেই সে ছিলো চাঁদের পাহাড়ের শঙ্কর।হেমনলিনীর বন্ধুরা সেদিন নতুন একটা গানের জ্যামিং-এর জন্য এসছিলো,তারাই তখন হিন্দোলের ডিয়েগো আলভারেজ ।একটা টুপি পড়ে আর বন্দুক হাতে সে তখন বিশ্বজয়ী বাঙালী।

হেমনলিনী হিন্দোলের দিকে তাকিয়ে ভাবে,সে নিজেও তো তাই।বাংলাকে ভালোবেসে,সে সম্মান করে সমস্ত ভাষার সৃজনশীলতাকে।অস্তিত্ব যার বাংলা তাকে আলাদা করে প্রমাণ দিতে হয়না সে বাঙালী।হিন্দোলের অভিব্যক্তির লড়াই তাকে শিখিয়েছে ভাষার উচ্চমূল্য।একটা শিশু ভুমিষ্ঠ হওয়ার পর যেমন শরীরের গন্ধে চিনে নেয় মায়ের কোল,তেমনই শুধু কয়েকটি অস্ফুট ধ্বনি এবং অঙ্গভঙ্গি হয়ে ওঠে হিন্দোলের মতন মানুষদের উদ্বর্তন ভাষা।আসলে একাডেমী প্রাঙ্গণ,শিলকাটাও-এর ডাক থেকে বটতলা, চায়ের স্টল, ফুটপাত,দূর্বাঘাস,বাঁশির সুর,সবই এক একটা বর্ণমালা।আর সেই বর্ণমালার যেকোনো উপলব্ধি আমাদের ভাষা।তাই কথায় সাজানোর দরকার হয়না তার “প্রজেক্ট একুশে”,সে নিজেই তার উপঢৌকন।

শনিবার সকাল মানেই ময়দান বা গড়ের মাঠ।কোনওদিন কোনও খেলা বুঝতে পারেনা হিন্দোল তবুও তার অচল পাদুটো যেনো কেপে ওঠে ময়দানের ফুটবল দেখে।এগারোজনের সাথে তখন গোওওল বলে চিৎকার করছে আরও দুটো উত্তেজিত চোখ।সেই ভাষা বুঝতে পারে হেমনলিনী।
‘ইমেইল সেন্ট’ হয় ম্যানেজারের ইনবক্সে।ক্যামেরাবন্দি হয় এবারের একুশের বিষয়, “নির্বাক-নতুন ভাষাচিন্তার স্ফুরণ”॥

সমাপ্ত

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।