গল্পেরা জোনাকি -তে সহেলী রায়

বোধিবৃক্ষ

হলুদ প্রজাপতিগুলো খানিক দোল খেয়ে জটাধারী অশ্বত্থ গাছটায় মিলিয়ে গেল। ঠিক যে ডালটায় বাসন্তী ওড়নার প্যাঁচে দিদির শরীরটা দোল খাচ্ছিল। চামড়ায় গুটিবসন্তের মতো ফুটে ওঠা ফুল নিয়ে বালুদের চায়ের দোকানের কুকুরটা কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে গাছের ছায়ায়। বোধিও অবিকল নিজেকে ভাঁজ করে অমন করেই ওর পাশটিতে শুয়ে রইল। ডেঁয়ো পিঁপড়েগুলো মাটির গর্ভ থেকে কুচকাওয়াজ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে। ছেলেবেলায় এমন দৃশ্য দেখে মা বলতেন, ‘নিঘঘাৎ বৃষ্টি নামবে।’ বোধি লাল ডাঁটাওয়ালা পাতাগুলোর ফাঁকফোকর দিয়ে আকাশ দেখল। কিছুই স্পষ্ট হয় না। ঝাপসা ঝাপসা ঝুমকো ফুলের মতো দুলতে থাকে পালপাড়ার পুকুরঘাট, বুনিয়াদী স্কুলের ফুটবল মাঠ, গৌরীপুকুর বাই লেনের সরু গলি, চারতলার ন্যাড়া ছাদ আর কালি মাখা অন্ধকারে বুড়ি চাঁদও। যতই কবিতা বইয়ে, যুবতী চাঁদের সুতো ছিঁড়তে ছিঁড়তে নরম আঁশ বেরিয়ে আসুক না কেন, বোধি তাকে বার্ধক্যের রূপোলি মোড়কের মলাটে আলগোছে তুলে রাখে। পাত্রপক্ষ দেখতে এলে দিদি জানলার ওই লম্বা লম্বা গরাদ পেরনো গোলপানা জোছনাঘরের দিকে চেয়ে চেয়ে গাইত, ‘বনের বিধবা মেয়ে।’ সে কী দুলুনি। হাঁ করে গরাদ পানে চেয়ে বোধির মনে হোত ওতে ঢেউ উঠেছে যেন। কোঁকড়ানো চুলের মতো ঢেউ।
নিতাইয়ের মুদিখানা থেকে পঞ্চাশ নকুলদানা কিনে হাওয়াই চটিতে ফটাস ফটাস শব্দ তুলে ফিরত দু ভাই-বোনে। ‘হ্যাঁরে দিদি, ওই যে তুই গাস, বনের বেধবা, ও কে রে?’ বোধির কথা শুনে বিনি বায়োস্কোপের হিরোইনদের মতো মুখ টিপে হাসত। সাইকেলে চেপে আসত লোকটা। চৌকোনো বাক্স, তাতে আবার চাকার মধ্যে ফিতে ঘোরে। কানে যন্ত্র লাগিয়ে শুনতে হয়, চোখ এক্কেবারে বাক্সের গায়ে সাঁটিয়ে রাখলে তবে দেখা যায় বায়োস্কোপের মেয়েদের হাসি। বিনি, বোধিকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে আসত দোলতলার এই মাঠে। অশ্বত্থ গাছটায় তখনও যৌবনের ছিটেফোঁটা লেগে। বিনি আঙুল তুলে বলতো, ‘হাঁদুরাম ওই দ্যাখ, বোনের বেধবা।’ ওমা, ওতো রূপচাঁদের পিসি। চাঁদের কলঙ্কের মতো ছোপ লাগা সাদা থান কাপড় তার পরনে। কাপড়ের খুঁট দিয়ে মাছি ওড়ায়। কেউ ধারেপাশে এলে বিনুনি পাকানো সরু হাতদুটো পেতে দেয়। চোখদুটো ছলছল করে তার। রূপচাঁদরা দক্ষিণে ফ্ল্যাটবাড়িতে উঠে গেছে। বুড়ির সেখানে হিল্লে হয়নি। বিনির ভারি মায়া পিসির ওপর। মুড়িটা, বাতাসাটা বাড়ি থেকে সরিয়ে দিয়ে আসে। সন্ধেবেলা পালপাড়ার পুকুরঘাটে বসে দেখেছে বোধি, চাঁদ থেকে সিঁড়ি নেমে আসে জলের বুকে। রূপচাঁদের পিসি ওই সিঁড়ি বেয়ে একদিন উঠে গেল মেঘে ভেসে থাকা আধখানা নৌকোটিতে।
গৌরীপুকুর বাই লেনের প্রথম বাড়িটায় সিঁড়ির ঘরের আলো জ্বলছে না। অন্ধকারে বাড়ছে ছুঁচোবাজি। বটুকদা দোকান থেকে বালব কিনে এনে লাগিয়ে দিল। সামনের রোয়াকে বসে বসে দেখে বোধি।
‘মেলার মাঠে কে নেমেছে? ও বঁধূ, ও বঁধূ!
তোমায় দেখে যুবক যুবক কবিরা আপ্লুত-’
একতলার ঘরে আবৃত্তি শেখাচ্ছে দিদির প্রেমিক ভুবনদাদা। জানলার ফাঁক দিয়ে চোখ মেলাচ্ছে ঝিলিক, যাকে দেখলেই বোধির বুকের ভেতর ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডেকে ওঠে। ঝিলিক জানে সে কথা। তাইতো দুগগা ঠাকুরের মতো দৃষ্টিবাণে ক্ষত বিক্ষত করে যাচ্ছে বোধিকে। মেলার মাঠে কে নেমেছে? কে নেমেছে? আচ্ছা দিদি কি কবিতা লিখতে জানতো? নইলে জানলো কীভাবে রূপচাঁদের পিসিই সেই বোনের বেধবা মেয়ে। ভুবনডাঙায় তাই বুঝি অত যাতায়াত ছিল। সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিয়ে বালুর চায়ের দোকান, মোহন কাকার ভাতের হোটেল, হনুমান মন্দির, রেলগেট পেরিয়ে উলকাঁটায় সোজা উলটোয় মনের পশম বুনতে বুনতে বোধি পৌঁছে যায় দোলতলার মাঠে বুড়ো অশ্বত্থের কোলে। যেখানে হলুদ ওড়নায় ঢেকে দেওয়া হয়েছিল দিদির শরীর।
দিদি যাওয়ার পর থেকেই মায়ের চোখের কোণে কালবোশেখের মেঘ, হলদেটে ছোপ নখের কোণে। ভাতের হাঁড়ি থেকে ঘোড়ার খুরের শব্দ ভেসে আসে, ভেসে আসে ক্রমাগত মায়ের নাক টানার ফিসফাস। বাবা দুটো ফেলে ছড়িয়ে মুখে গুঁজে মোকাসিনো জুতোয় পা গলিয়ে ঝোলানো ব্যাগ কাঁধে রওনা দেন বুনিয়াদী স্কুলে। দু একটা প্রাথমিক শ্রেনীর ক্লাস নিয়ে পুরনো সব খাতাপত্তর ঘাঁটে অফিসঘরে বসে। নিজেকে ব্যস্ত রাখার ফন্দিফিকির খোঁজেন আসলে। সন্ধেবেলায় টিভি চালিয়ে চেয়ারে বসে ঘাড় এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। ঠোঁটদুটো বিড়বিড় করতে থাকে। চা জুড়োয়, মুড়ি মিইয়ে যায়। রাতে, খাবার ডাক এলে ঘুম ভাঙে। ঠোঁটের কোণে তখন গড়িয়ে যাওয়া লালা, কষটে হয়ে যায়। চোখে পিচুটিরা ঘর বাঁধে। কম ঝক্কি ছিল? পাড়া-প্রতিবেশি, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী, আত্মীয়-অনাত্মীয় বাড়ি উজিয়ে সোমত্থ মেয়ের জন্য পাত্রের সন্ধান দেন। কুটুমবাড়িতে যোগাযোগ করা, দেখাশোনার দিনক্ষণ ঠিক করে ঘরদোর পরিস্কার, মোহনকে বলে ভালো চপ কাটলেট ভেজে আনা, মিষ্টির জোগান, আত্মীয়স্বজনদের খবর দেওয়া। এত পরিশ্রমের পরও বিদায়বেলায় দরজায় দাঁড়িয়ে তৃপ্তির হাসি হাসতেন বাবা। ‘বিনিকে ওদের ঠিক পছন্দ হবে’। দিন, হপ্তা, মাস পেরিয়ে যেত। মায়ের হাসি মিলিয়ে বরফ জমত। আবার নতুন খোঁজ, নতুন উদ্যম। দিদিকে দেখতে মন্দ ছিল না। দীঘির কালো জলের মতো টলটলে দুটো চোখ। চোখের পাতা এত ঘন আর বড় বড় যেন কাজল দিয়ে ঘাট বাঁধানো তার। ছিপছিপে গড়ন। কোমর অব্দি পৌঁছত বেণী। শুধু গায়ের রঙখানা ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি আসার পূর্ববর্তী থমথমে মেঘের মতো। ওতেই বুঝি পিছলে যেত জনগণের মন। ওদিকে বোধির গায়ের রঙ দুধেল গাইয়ের মতো। স্কুলের মাঠে খেলতে গিয়ে ছেলেরা টিপ্পনী কাটত খালি। ‘ফর্সা, গুয়ের মালসা!’ কতবার দুপুরে দিদিকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে চোখ চেপে বন্ধ করে ঠাকুরকে ডেকেছে বোধি, দুজনের গায়ের রঙ যেন অদল বদল করে দেয় ঠাকুর।
গৌরীপুকুর বাই লেনের প্রথম বাড়িতে আবৃত্তি শিখতে যায় দিদি। বোধিও যায় পেছন পেছন। সামনের বাড়ির রোয়াকে বসে পা দোলায় সে।
‘মেঘ বলতে আপত্তি কি?
বেশ বলতে পারি…;
দিদিতে আর ভুবনদাদায় চলছে যুগলবন্দী। বাবা বুঝেছিলেন শুধু গানে আর হবে না। ও শ্যামলা ত্বক ঢাকতে স্নো পাউডারের সঙ্গে সঙ্গে আবৃত্তি, সেলাই ফোঁড়াই সব চায়। গানের মতোই কবিতার পারদও ওঠে নামে। দিদি ভুবন জুড়ে আসন পেতে বসে। ভুবনদাদাও সাইকেলের রডে দিদিকে বসিয়ে হুঁশ করে পেরিয়ে যায় রেলগেট। বোধিকে যেন ওরা খেয়ালই করে না। বোধি রোয়াকেই অপেক্ষা করে। সন্ধের মুখে ওখানেই ছেড়ে যায় ভুবনদাদা দিদিকে। দিদি বোধিকে দেখে ইয়া বড় জিভ কেটে বলে, ‘হাঁদুরাম বাড়ি যাসনি কেন? মা কিছু জানতে চাইলে বলবি তুই আর আমি দোলতলা গেসলাম।’ বোধির ভারি রাগ হয়, চোখ ছলছল করে। মনে হয় দিদিকে একা ফেলে এক ছুটে বাড়ি চলে যায়। পারে না ছেড়ে যেতে। সন্ধে হলেই পাড়ার কুকুরগুলো বড়ো ডাকাডাকি করে দাঁত খিচিয়ে। দিদি ভয় পায় যে। ছেড়ে যেতে পারে না বোধি। বাবা মায়ের দুশ্চিন্তা বাড়ে, দিদি আর সেসব গায়েই মাখে না। প্রজাপতির মতো উড়তে থাকে এদিক ওদিক। দিদির ত্বকে জৌলুষ বাড়ে। খুশির জৌলুষ। বোধির রাগ জল হয়ে মায়ায় পরিণত হয়।
সকাল সকাল দিদির অংক খাতার পাতা ছিঁড়ে নৌকো বানিয়ে পালপাড়ার পুকুরপাড়ে চলে আসে বোধি। নৌকোগুলো জলে ভাসিয়ে পেছন থেকে জল ঠেলে দেয়। শুকনো পাতার সরসর শব্দ আসে। বড় গাছটার পেছন থেকে সকালের প্রথম নরম রোদে ছায়াশরীর দুটো দুলে ওঠে। পুলুদের উঠোনে একবার দুটো সাপ একইভাবে পেঁচিয়ে ছিল একে ওপরকে। আশপাশের বাড়ির বারান্দা থেকে শাঁখ, উলুর সে কী আওয়াজ! পুলুর ঠাকুমা ঠাকুরের আসন থেকে লাল শালু এনে ছুঁইয়েছিলেন। সাপ দুটো চলে যাওয়ার পর সেই শালু কত টুকরো হয়ে এবাড়ি ওবাড়ি বিলিয়েছিল তার হিসেব নেই। বোধি হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি আসে। হারমোনিয়াম থেকে দিদিকে জোর করে তুলে টেনে আনে পুকুরপাড়ে। ভুবনদাদার শার্টের বোতাম আটকে দিচ্ছে তখন দিদির বন্ধু মল্লিকাদি। ভুবনদাদা মল্লিকাদির মাথাখানা চেপে আছে নিজের বুকের ওপর। বোধির জামার কলার ধরে বিনি অন্য গাছের আড়ালে চলে যায়। স্নো পাউডারে ধুলো জমে, হারমোনিয়াম বাক্সবন্দী, আবৃত্তি খাতার পাতাগুলো ছিঁড়ে বোধিকে পালতোলা নৌকো বানানো শেখায় বিনি। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই কেমন যেন উমনো ঝুমনো তার জীবন। সারারাত কেঁপে কেঁপে ওঠে তার শরীর। মা কেন জানি না রোজ বলেন, ‘মর মুখপুড়ি!’ দিদির কষ্টটুকু ছাড়া বাকিটা মন্দ লাগে না বোধির। আবার আগের মতো বোধির চুলে ঝুঁটি পাকিয়ে দেয়, ভাত মেখে খাইয়ে দেয়, দোলতলার মাঠে নিয়ে যায়। বোধি সাইকেল নিয়ে চক্কর কাটে মাঠটুকু। দিদি হাঁ করে তাকিয়ে থাকে অশ্বত্থ গাছটার দিকে।
‘আরেকটু আরেকটু তুলে ধর ভাই, লক্ষ্মী ভাই আমার আরেকটু তোল আমায়।’
বোধি প্রাণপনে চেষ্টা করে দিদিকে কোলে তুলে গাছের মগডালটায় পৌঁছে দেওয়ার। ছাপা সালোয়ার কামিজের সঙ্গের হলুদ ওড়নাটা আগেই পেঁচিয়েছে ওখানে। মগডালটা ধরে কোনরকমে গলায় ঢুকিয়ে দেয় ওড়নার ফাঁসে।
‘ব্যস শান্তি। এবার ছেড়ে দে হাঁদারাম। আমি দোল খাই, তুই দ্যাখ বসে বসে।’
গতরাতেই দিদি যখন কেঁদে কেঁদে শ্বাস নিতে পারছিল না, বোধি গিয়ে গায়ে মাথায় হাত বোলায়। ‘কষ্ট হচ্ছে দিদি?’ ‘হ্যাঁ রে ভাই। কাল অশ্বত্থ গাছে দোল খাব, কষ্ট কমে যাবে। তুলে দিবি আমায় গাছে?’ যাক কষ্ট তাহলে কমে যাবে। বোধি নিশ্চন্ত হয়। ‘হ্যাঁ দেব তবে।’
বোধি খিলখিল করে হাসছে। দিদি খুশিতে ছটফট করছে, পা ঝাপটাচ্ছে। প্রজাপতি উড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে। বোধিও ওদের পেছন পেছন তাড়া করছে। দিদি খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়েছে। বোধি ডাকাডাকি করে। পা ধরে দোলায়, সাড়া নেই।
‘ইশ হাবাগোবা, মানসিক প্রতিবন্ধী ছেলেটার এইবার কী হবে গো। মেয়েটাই যা দেখাশোনা করত। সাইকেল শেখাত মাঠে এনে, কত যত্নআত্তি করত গো।’
‘আরে না না, শুনলাম ওই ছড়াকাটা মাস্টারের সঙ্গে ওঠবোস ছিল, পেট ফেট বাঁধিয়েছিল কিনা দেখো।’
ভ্রমরের গুঞ্জরণে বাসন্তিকায় মুড়ে শুয়ে আছে দিদি। চাঁদের সিঁড়ি বেয়ে রূপচাঁদের পিসির কাছে চলে যাচ্ছে ও। বড় মায়া ছিল পিসির ওপর দিদির। বোধির খুব ঘুম পায় সারাদিন। জেগে থাকলেই বিশ্বব্রহ্মান্ড দোলে। কিছুতেই থামাতে পারে না সে চলন। কুঁকড়িয়ে শুয়ে থাকে বুড়ো গাছটার ঝুড়ির তলায়, হেলিকপ্টারের মতো ফড়িংয়ের পাখা ঘোরে।
ছায়া ছায়া বাতাস বয়ে যায় চোখের ওপর, কুয়াশার ঝড় ওঠে ঠিক ওখানে, যেখানে দিদির শরীরটা ঝুলছিল বাসন্তী ওড়নার দোলনায়।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।