সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে শম্পা রায় বোস (পর্ব – ২০)
by
·
Published
· Updated
আমার মেয়েবেলা
গান
আমার ক্লাসে আমরা তিনজন শম্পা ছিলাম। আমি ছিলাম খুব সাধারণ। আত্মভোলা আবার প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী, ছটফটে এবং অবশ্যই ঝগড়ুটে। মেয়েরা একটু ঝগড়ুটে হয়ই তবে অনেক মেয়ে আবার ভীষণ শান্ত ধীরস্থিরও হয়। তবে আমি বেশির ভাগের কথাই বলছি। তবে আমি কিন্তু খুবই ঝগড়ুটে ছিলাম ।
পড়াশোনায় খুবই সাধারণ। অঙ্ক মাথায় ঢুকত না। বলা যায় অঙ্কে মন ছিল না। অঙ্ক করতে বসলেই সব ওভার কনফিডেন্স নিমেষেই আকাশে উবে যেত । অঙ্ক ক্লাসে বাইরে তাকিয়ে থাকতাম। কটা পাখি বারান্দায় বসল কটা উড়ে গেল, আর কোন এল কিনা অথবা ওদের কিচিরমিচির বকমবকম, কাকাআআআ সবই খেয়াল রাখতাম। রাখতাম না শুধু অঙ্কের স্যার কী বলছেন। পাখিগুলো আমার চেনা হয়ে গিয়েছিল।
তারপর জল খাওয়ার নাম করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে স্কুলের মাঠে তাকিয়ে থাকতাম। অনেকটা দূরের কিছু একটা দেখার চেষ্টা করতাম । কী দেখতে চাইতাম তা জানি না । কিছু একটা । যা হোক করে সময়টা পার করতাম । আসলে অঙ্ক ক্লাসে আমি খুব একাকিত্বে ভুগতাম। কোনও সঙ্গী নেই। সবাই কত মন দিয়ে অঙ্ক করত । ওদের দেখতাম আর ভাবতাম কী যে আছে এটার মধ্যে বুঝি না বাবা। পচা একটা সাবজেক্ট। আমার হাড়মাস একেবারে কালি করে ছেড়ে দিল!
একদমই ভাল লাগত না আমার,, অত হিসেবনিকেশ দূর,,,,,,
####
এই দুই শম্পা অঙ্কে খুব ভালো ছিল। ওরা যখন ক্লাসে এস আর জি স্যারের কাছে খাতায় গুড পাচ্ছে, আমি তখন গুণগুণ করছি বৃন্দাবনী সারং এর সরগম। বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। আর আমি গাইছি,,,,,,, বরষণ বাদরি পিয়া ঘরে আয়ি। ঘনঘোওর জাতা জিয়া ঘবড়ায়ি,,,,,,,,
“দুপুর বেলা যখন মেঘ ডেকে খুব বৃষ্টি পড়ে তখন বৃন্দাবনী সারং গাইতে হয় বুঝলি চম্পা রাণী”,,,,,,,
মুহূর্তেই আমার গানের মাস্টার মশাই এর কথা মনে পড়ে যেত। আমায় আদর করে চম্পা বলতেন। ওনার মেয়ের নামও চম্পা ছিল। বলতেন আমার দুই চম্পা। কিন্তু নিজের মেয়ে কে যে কেন গান শেখান নি এটা মাথায় ঢোকেনি কোন দিন। খুব খারাপ লাগত ওকে দেখে। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনত আমাদের গান।
অত হিসেব করে ,গুছিয়ে পরিপাটি জীবন আমি কোন দিন পছন্দ করতাম না। পছন্দ করতাম না চাপিয়ে দেওয়া কিছু নিয়ম কানুন।
যখন যেটা মনে হত করতে ইচ্ছে করত। ব্যক্তিগত জীবনে আমি তখন খুবই পরাধীন ছিলাম। আমার মা মাত্রাতিরিক্ত শাসনে আমাকে একেবারে মুড়ে রেখেছিল। শাসনে শাসনে আমি জেরবার হয়ে গিয়েছিলাম। আমার নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের একমাত্র জায়গা ছিল এই স্কুলটা। এখানে আমি নিজের মতো করে বাঁচতাম। স্কুল ছুটি হলে মন খারাপ করে বাড়ি আসতাম। আবার কখন স্কুলে আসব শুধু এইটা মাথায় থাকত।
এক এক সময় মনে হতো হোক না একটা দিন শুধুই এলোমেলো। ক্লাস না করে
খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে ঘূর্ণি ঝড়ের ধুলো ওড়া দেখব। বাতাসের শন শন আওয়াজ শুনব। ঝড়ে বৃষ্টির ফোঁটা কেমন এলোমেলো হয়ে যায়! তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখব, এলোপাতারি পাতা উড়ে যাওয়া দেখব। কিংবা ভো কাট্টা ঘুড়ির সঙ্গে ছুটব। গঙ্গার উত্তাল জলের তোড়ে চিৎ সাঁতারে ভেসে যাব অনেকটা। বৃষ্টিতে ভিজব উদোম। জমে যাওয়া কাদাজলে লাফাব,,,
কিংবা বড়ো একটা হা করে বৃষ্টির জল খাব, বরফ খাব।
তখন আমাদের ফরাক্কায় মাঝে মাঝেই খুব শিলাবৃষ্টি হত। বড়ো শিল পড়লে মাথা বাঁচিয়ে একটা ছাতা নিয়ে শিল কুড়োতাম। আর ছোট শিল পড়লে মাঠের মাঝে মুখ উঁচু করে হা করে থাকতাম। ভাইকে বলতাম, দূর মাটি থেকে বরফ তুলে ধুতে ধুতেই তো ছোট হয়ে যায়। আরে ডাইরেক্ট খা ধোয়ার ঝামেলা নেই। টকাটক মুখে পড়বে।
ও ওও তাই করত। তখন আমাদের ফ্রিজ ছিল না। তাই বরফটা বেশ আকর্ষণীয় ছিল। ঠান্ডা বরফ জল,,, পাঁচ পয়সার আইসক্রিম খেতাম। ওটাই তখন দারুণ ব্যাপার। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা বরফের টুকরো মুখে দিতেই স্বর্গীয় অনুভূতি। আমাদের তখন গরমকালে মাটির কুঁজোতে জল খাওয়া হতো। আর গরম কেটে গেলে পেতলের কলসিতে।
####
যা বলছিলাম বৃষ্টি পড়লেই আমি হাওয়া। মার খাই খাব। মার তো আমি প্রতিদিনই খেতাম মায়ের হাতে। তাই ওটা কোন ব্যাপারই ছিল না আমার কাছে। মায়ের একটু মাথা গরম ছিল। সব কিছুতেই খুব পারফেকশন খুঁজত। আমি মাকে খুব ভয় পেতাম। মা কোনও দিন আমার বন্ধু ছিল না। আমার কোনও বোন বা দিদি ছিল না। স্কলের বাইরে কোন বন্ধু ছিল না। তাই আমি তখন থেকেই খুব একা ছিলাম।এবং এই একা থাকতে থাকতে ঐ ছোট্ট বয়েসে আমাকে মারাত্মক ভাবে একাকিত্ব গ্রাস করেছিল।
একটা প্লেট ধুতে গিয়ে যদি ভেঙে ফেলতাম মা খুব মারত। মাকে আমি দোষ দিই না। তিল তিল করে তার সংসারটা গড়েছিল। সংসারের প্রতিটি জিনিসের উপর অসম্ভব টান ছিল। তাই এর কোন একটা নষ্ট হয়ে গেলে অস্থির হয়ে উঠত। আমাকেও মা তার সংসারের একটা বস্তু ভাবত। সংসারের সব কিছুই যেমন পারফেক্ট। খাট বিছানা বালিশ কাঁথা কম্বল পর্দা বাসনকোসন চেয়ার টেবিল ঠাকুরের সিংহাসন উঠোন তুলসীমঞ্চ এবং আমি,,,,, সব যেন ঝকঝকে হওয়া চাই। মামনিকে খুব ভাল হতে হবে। তাই আমার মতো দুষ্টু বাউন্ডুলে মনের মেয়েকে মানুষ করতে হলে তো রোজ দু চার থাপ্পড় পিঠে পড়বেই। এটা তো স্বাভাবিক ব্যাপার। মা আমাকে একটা মেশিন ভাবত। যখন যেটা করতে বলত আমাকে সেটাই করতে হত। এক একদিন গানের মাস্টার মশাই রাত ১১ টা পর্যন্ত গান শেখাতেন। আমার ইচ্ছে না থাকলেও বসতে হত গান নিয়ে। কারণ মা চাইত সঙ্গে বাবাও। মাস্টার মশাই আসলেই ওরা বাইরে মাদুর পেতে বসত । আমার গান শুনতে খুব ভালোবাসত ওরা। আসলে মাস্টার মশাই আর আমার যুগলবন্দিতে আমাদের ছোট্ট কোয়ার্টারে তখন বেহাগ বাহার তিলং বসন্ত্ মালকোষেরা খেলতে আসত। তানপুরা, হারমোনিয়াম আর তবলার সঙ্গতে আমাদের বাইরের ঘরে তখন একটা কেমন যেন স্বর্গীয় পরিবেশ। বাল্বের হলুদ আলো, কুণ্ডলী পাকানো ধূপের ধোঁয়া,,, সুরের আবেগী মূর্ছনায় সারা ঘরে তখন পূর্ণিমার ভরা কোটাল,, সব কিছুকে যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাবে,, মাস্টার মশাই একটা সরগম বলছেন আমি সেটা বলছি,,একটা সপাট তান ছুঁড়লেন আমাকে উদ্দেশ্য করে,,,আমি তো শম্পা কম যাই? বিদ্যুতের ঝলকানি আমার সারা শরীরে মনে। উল্টে আমিও আর একটা তান ছুঁড়লাম তারের পঞ্চম থেকে,,,,,,
সে যে কী অসাধারণ অদ্ভুত সন্ধিক্ষণ!!!!!