সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে শম্পা রায় বোস (পর্ব – ৪)

আমার মেয়েবেলা

পয়লা বৈশাখ আমাদের কাছে বিরাট একটা উৎসব ছিল। একদম পুজোর মতো। বছরের এই দুটো সময় আমরা সবাই মিলে আনন্দে যেন মেতে উঠতাম।।
আমার একটা ঝকঝকে সকাল ছিল, আগেও বলেছি। পয়লা বৈশাখের সকালটা যেন আরও ঝকঝকে আরও সুন্দর হতো। ফরাক্কা টাউনশিপের সর্ব স্তরের মানুষের মধ্যে উৎসব মুখর একটা দিন। বেশ একটা খুশির বাতাবরণ। নতুন জামা কাপড়ের গন্ধ,,নতুন বাসন পত্রের ঝমঝম আওয়াজ। হাসি ঠাট্টার হট্টগোল, খেলনা বাটির রিণরিণ, ক্যারাম বোর্ডের টকটক ,,, আর বাবাদের তাসের ছোটখাটো কমপিটিশন। বাড়ির ভেতর থেকে ভুরভুর করে বেরিয়ে আসা মন আনচান করা ভালমন্দ রান্নার গন্ধ।
আগের দিন মা হাঁস পাখি ফুল আঁকা কাঁথা কাজের সাদা পাতলা আদ্যি কাপড়ের টেপজামা আর দুটো ছিটের জামা, দুটো ঘটি প্যান্ট আর ভাই এর জন্য একটা গেঞ্জি একটা প্যান্ট নিয়ে আসত। নিজের জন্য কিচ্ছু না। সারা বছর ভাঁড়ে পয়সা জমিয়ে দুটো লুঙ্গি কিনত বাবার জন্য। নীল চেক কাটা লুঙ্গি। মা কিন্তু সব লুকিয়ে রাখত। কাউকেই জানতে দিত না। সারপ্রাইজ দেওয়া মায়ের কাছে একটা অন্য রকমের ভালোলাগা ছিল। আমরা তিনজনেই জানতাম আমাদের জন্য মা কিছু না কিছু কিনেইছে । বাবা জানত মা নিজের জন্য কিচ্ছুটি কিনবে না। তাই নিজেই পছন্দ করে একটা ছাপা শাড়ি নিয়ে আসত। কি রঙিন সেই শাড়ি! এমন কোন রঙ নেই যে শাড়িটা তে থাকত না।আসলে চুপচাপ শান্তশিষ্ট বাবার মনটাতে যে কত রঙ খেলা করত তখন না বুঝলেও এখন বেশ বুঝতে পারি।
এইদিন আমাদের চারজন খুব ভালোভাবে বেশ একটা এডজাস্টমেন্ট মনোভাব নিয়ে থাকতাম। ভাই এর সঙ্গে মারামারি করতে গিয়েও থমকে যেতাম। মনে মনে বলতাম নাআআআআআ আজ খুব ভালোভাবে থাকতে হবে। তেমন বাবা মায়ের মধ্যেও দেখেছিলাম। বাবা যতক্ষণ বাড়িতে থাকত কল্পা কল্পা ডাকে বাড়িটা যেন গমগম করত। মায়ের নাম ছিল কল্পনা।
বাবা ভালোবেসেই মাকে বিয়ে করেছিল। আসলে মায়ের সম্বন্ধ হয়েছিল যার সঙ্গে তিনি মাকে পছন্দ না করে আমার মাসিকে পছন্দ করেছিলেন। আর ঐ মেশোর বন্ধু ছিল আমার বাবা। বাবা তার বন্ধুর সঙ্গে এসে মাকে দেখে খুব ভালো লেগেছিল। এইভাবেই দুই বন্ধুর সঙ্গে দুই বোনের বিয়ে হয়। দুজনেরই বাড়ি ছিল একই জায়গায় ।।
যাইহোক। ঝকঝকে সকাল।। সেদিন প্রথমেই মা স্নান করে পুজো করত। গীতা পড়ত। তুলসী তলায় দুটো কাঠির মাঝে একটা ছোট্ট ফুটো ওয়ালা মাটির ঘট বেঁধে ঝাড়া দিত। ঘটে গঙ্গা জল দিত। সেই জল ফোঁটা ফোঁটা করে তুলসি গাছের গোড়ায় থাকা শিব ঠাকুরের মাথায় পড়ত। একমাস চলত। আর এই একমাস আমি নিয়ম করে ঘটে জল দিতাম স্নানের পর।
পুজো সেরে
মা ভালো একটা ভাল জলখাবার বানাত। সেদিন আমরা লুচিই খেতাম। সঙ্গে সাদা সাদা আলু । কি যে ভাল লাগত। আর থাকত সতুকাকুর দোকানের ক্রিম চপ।
একবার মা এই রকমই নববর্ষের দিনে খুব সকাল বেলায় দারুণ একটা চমক দিয়েছিল।
সেই সময় ফরাক্কায় স্টিলের কাপ উঠেছে। বেশ বড়ো সড়ো। কিন্তু অত চা আঁটত না। দেখতেই বড়ো ছিল।। কিন্তু একটা মজার এবং আশ্চর্যের ব্যাপার হল স্টিলের কাপ অথচ গরম হয় না। কাপ ধরে চা খাও হাতে গরম লাগবে না।
মা সে বার চারটে একই রকম দেখতে কাপ নিয়ে এল পঁয়তাল্লিশ টাকায়। টাকাটা জানতে পেরেছিলাম কারণ আমার স্বভাব ছিল এখনও আছে, যেকোনো জিনিসের দাম জিজ্ঞেস করা। বাজার দর সম্পর্কে একটা ওয়াকিবহাল থাকা আরকি।। আমি এখনও অনেক জিনিস না কিনলেও দাম বলে দিতে পারি। বাজার দর কখন কিভাবে উঠা নামা করছে সেই সম্পর্কে একটা ধারণা রাখতে পছন্দ করি।
তো যাইহোক সেবার মা ঐ স্টিলের কাপ এনে হাজির। তখন দু এক জনের বাড়িতে সবে এসেছে ঐ কাপ। এই কাপ তখন আমাদের কাছে অত্যন্ত লোভনীয় এবং আকর্ষণীয়।
পয়লা বৈশাখের দিন যখন কাপগুলো বের করল। উফ্ কি যে আনন্দ আমাদের ! এমন কাপ আমাদের বাড়িতে!
বাবাকে বলল আজ এতেই চা খাওয়া হবে। মামনি সন্টুও খাবে। চারজনের জন্য চা কর।
সকালের চা টা বাবাই করত। বাবা খুব সকালে উঠত। দরজায় জল দেওয়া তারপর গাছে জল দেওয়া , হাঁস মুরগি , গরুদের খেতে দেওয়া,, চা করা এ সব কিছু বাবাই করত। কেন?
প্রথমতঃ বাবা খুব কর্মঠ ছিল। চুপ চাপ বসে থাকতে পারত না। ঘর গেরস্থালির কাজ করতেও খুব পছন্দ করত। মাকে খুব ভালোবাসত। মার কষ্ট একটু কম হবে বলে
এই সব কাজ শেষ করে মাকে চা দিয়ে নিজে খেয়ে অফিস চলে যেত।
বাবার দশটা পাঁচটা অফিস ছিল না। বাবাদের বেশি ফিল্ড ওয়ার্ক ছিল। যখন যে ডিভিশন এ বদলি হত। তখন সে রকম কাজ ছিল। আমি যখনকার কথা বলছি তখন বাবা ছিল হেড ওয়ার্কস্ এ। ব্যারেজ রক্ষণাবক্ষেণ এর দায়িত্ব এই হেড ওয়ার্কস্ ডিপার্টমেন্টের । সকালে বেরিয়ে একবার আসত। বাজার টা দিয়ে আবার চলে যেত। আবার দুপুরে খেতে আসত। দুপুরে খাওয়ার পর একটু ঘুমিয়ে আবার তিনটে নাগাদ যেত অফিসে। তারপর আবার বিকেল পাঁচটা সারে পাঁচটায় বাড়ি আসত একদম সিঙারা জিলিপি হাতে নিয়ে । দারুণ ছিল সতুকাকুর সিঙাড়া জিলিপি । খেলে একটুও অম্বল হতো না। আশ্চর্য!

বাবাকে একবার মায়ের আড়ালে জিজ্ঞেস করে ছিলাম। সকাল সকাল এত কাজ কর ভাল লাগেনা। তোমার তো কষ্ট হয়!

বাবা বলেছিল তোর মায়ের পুজো,,, গীতা পড়তে কত সময় যায় বল? কাজটা একটু এগিয়ে রাখি। আর তাছাড়া তোর মা কতক্ষণ ধরে রান্না করে বলত? উনুন ধরিয়ে স্টোভ জ্বেলে কত পরিশ্রম হয় কত কষ্ট হয়!
তোর ঠাকুমা কোনও দিন রান্না করেনি। আমার বৌদি রাও রান্না করে না। তোর মা ওখানে থাকলে(দাদুর বাড়ি ) কি রান্না করত? গরমের মধ্যে আহা কল্পার কত কষ্ট হয় ! বাবার কথা শুনে চোখ ভিজে যেত। মন ও। মেয়েদের কষ্ট যে বুঝতে পারত মানুষ টা!
তো যাইহোক সেবার পয়লা বৈশাখে আমরা ঐ স্টিলের কাপে চা খাওয়া হল। আমার আর ভাই এর প্রথম চা খাওয়া ভাবা যায়! আমাদের সময় বলা হত বড়োরা চা খায়। সেদিন আমার আর ভাই এর কি গর্ব ! যাক্ আমরা এবার তাহলে বড়ো হয়ে গেছি বাবা মার সঙ্গে বসে চা খাচ্ছি তাও এই হালফ্যাসানের স্টিলের কাপে!
আজও সেই দিনের সকাল টা বেশ মনে আছে আমার। বড়ো ঘরে মেঝেতে বসে চারজন গোল হয়ে বসে স্টিলের কাপে চা খাচ্ছি। সঙ্গে গোল গোল সস্তার বিস্কুট। চা তো খাচ্ছি,,,
কিন্তু চারজনেই ইনভেস্টিগেশন চালিয়ে যাচ্ছি। গল্প এক টাই,,, কি করে সম্ভব? কেমন ভাবে তৈরি? ভাই দু হাতে কাপ ধরে চা খাচ্ছে । মা কে তো বলেই বসল মা হাতে গরম লাগছে না। বাবা ও কেমন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কাপটা দেখছে।কাপটা হাত দিয়ে ভাল করে ধরে দেখছে কিছুতেই কাপ গরম হচ্ছে না। অথচ চা গরম। জিভেও ছ্যাঁকা লাগছে না। মার চোখে মুখে বিশ্বজয়ের হাসি। আমিও দেখছি নেড়েচেড়ে ।
ভাই এবার বলেই ফেলল, এবার থেকে এই কাপেই দুধ খাব। হাতে আর গরম লাগবে না। গ্লাস পচা। বাজে। গরমে আমার হাত পুড়ে যায় । দেখো কেমন হাত লাল হয়ে গেছে পুড়ে। মা বাবা হেসে উঠল। মা হাত টা ধরে বলল সত্যিই তো হাত টা কেমন পুড়ে গেছে আমার সোনার। ওর হাতের তলাটা ছিল হালকা লাল। এতটাই ফর্সা ছিল ও।। মায়ের সাপোর্টে আরও একটু সাহস পেয়ে গম্ভীর মুখে বলল,
এবার থেকে সকাল বেলা একটু করে চা দিও তো?
মা আমাকে বলেছিল চা খেলে কাল হয়ে যাবি। এই চা পাতার মতো। কালো রং একদম পছন্দ নয়। তাই আমি দুধেই থেকে গেলাম। তবে এবার থেকে এই কাপেই খাব এটা ডিক্লেয়ার করে দিলাম।
প্রতি বছর পয়লা বৈশাখের দিন এই চা খাওয়ার ঘটনাটা মনে পড়ে যায় । আনন্দ হয় আবার বুক ঠেলে এক দলা কান্না,,, দলা পাকিয়ে গলায় আটকে যায়। চোখদুটো জ্বালা করে।
সকাল হলেই ভাবি আজ থেকে শুরু করি গান গাওয়া। কিন্তু আর হয়ে ওঠে না।। তখন নিজেকে সামলাব নাকি গান করব।। ওদের তিনজনের একজন ও যদি থাকত একটু হালকা হওয়া যেত। কিন্তু,,,,,,,
কী যে আনন্দ হয়েছিল সেদিন আমাদের। জীবনের শ্রেষ্ঠ পয়লা বৈশাখ।।
এখন ভাবি কত অল্প তেই খুশি ছিলাম আমরা। তাই সুখীও ছিলাম।।
বাপের বাড়ির কোনও জিনিসই আমার কাছে নেই। আমার ছোট বেলার ছবি পর্যন্ত নেই আমার কাছে। কিন্তু আমি এই চারটে কাপ মায়ের থেকে চেয়ে নিয়েছিলাম। কোনও কোনও জিনিস হয়তো দাম দিয়ে বিচার করা যায় না। এই কাপগুলো আমার কাছে অমূল্য আজও।।
বাবার এই দিনে অনেক কাজ ছিল। ছুটির দিন তাই একটু বাড়তি সময় বাগানের কাজ করত। মা ঐ সময় আমাদের তেলহলুদ মাখিয়ে স্নান করিয়ে দিত। নতুন জামা পরে চুলটুল আঁচড়ে আমরা খেলা করতে যেতাম। এরপর মা রান্না করতে বসত। বাবা নিজে থেকেই মাকে মাংস ধুয়ে দিত। মাছ কেটে দিত।বিশেষ করে ছোট চিংড়ি বা সোনাখড়ি মাছ।। মা ছোট মাছ খেতে ভালবাসত। ভাই বাবা চিংড়ি মাছ।। মা রান্না করতে বসলে বাবা গল্প করতে বসত। শুধু শুধু বসে থাকত না কুটনোও কুটে দিত। আমার বেশ মনে আছে এঁচোড় এবং মোচা বাবাই সারাজীবন কেটে এসেছে।
তবে ভাই চলে যাওয়ার পর আমাদের সংসার টা আর সংসার ছিল না। একটা জ্বলন্ত শ্মশানে আমরা তিনজন একা একা পুরতাম। কেউ উফ্ করতে পারতাম না। আমরা তিনজনই তিনজনের কাছে কষ্টটা লুকোনোর চেষ্টা করতাম। বুকের মোচড়ানো যন্ত্রণা,, কষ্টের ঘা,, তার থেকে বেরিয়ে আসা পুঁজ রক্ত সব ঢেকে রাখতাম মেকি অভিনয় করে। বাবা এক এক সময় বুকের বাঁ দিকে হাত বুলিয়ে জোরে আহ্ করে উঠত।। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে বসতাম। তাতেও কী শান্তি পেতাম! যে দিকেই তাকাই শুধু স্মৃতি,,,আর স্মৃতি ।।
জানতাম স্মৃতি নাকি খুব সুখেরও হয়। কিন্তু আমার জীবনে কোনও সুখের স্মৃতি নেই। আজও ওদের কথা বলতে বলতে যন্ত্রণায় গলা ব্যথা করে। কেমন যেন গলাটায় কি একটা আটকে আছে। সন্টু চলে যাওয়ার পর আমি আর গান গাইতে পারি না। কষ্ট,, যন্ত্রণায় আমার গলাটা বুঁজে গিয়েছে। আগের মতো গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয় না।। কিন্তু ঐ,,, কোনও দিন তো হারতে শিখি নি। তাই যে করেই হোক সবাই কে ধোঁয়াসায় রেখে হাসিমুখে এগিয়ে চলেছি।। বলা যায় দিন গুলো কাটাচ্ছি। এই রঙ্গমঞ্চে আমার অভিনয় টুকু শেষ করার অপেক্ষায় চলেছি তরতরিয়ে।।
তো যাইহোক পয়লা বৈশাখের দিন মাছ মাংস দুটোই হতো। একটা চচ্চড়ি হতো। মা খুব ভালবাসত । ভাল রান্নাও করত। বাবার কাছ থেকে শিখে মা একদম এক্সপার্ট হয়ে গিয়েছিল । টক হত। আমরা চাটনি বলতাম না। কলাই এর ডাল আলুপোস্ত বাবা খুব ভালবাসত । বিশেষ করে পোস্তর বড়া। প্রতিদিন হতো আমাদের।।
দুপুরে বাবা মা ভাই ঘুমিয়ে পড়লে আমি ঢুকতাম খাটের তলায় আমার সংসার সামলাতে। ব্যাজর ব্যাজর করে কত কথা বলতাম। যা সারাদিন বাবা মা বলত সেটাই বলতাম। আসলে ওটাই তো শিখেছিলাম। একটা গামছা চুলে জড়িয়ে খোঁপা করে বলতাম হ্যাগো শুনছ? একটু বাজার যেতে হবে,,,
বিকেল বেলা একটা নতুন ছিটের জামা পরে যেতাম হাল খাতা করতে। ভাইও নতুন পরত। ভাই এর একটা জামা আর একটা প্যান্ট হত। মা বুঝিয়ে ছিল। ছেলেরা তো বেশির ভাগ সময় খালি গায়েই থাকে। মেয়েরা তো থাকে না তাই ওদের জামা কাপড় বেশি খরচ হয়। তাই দিদির জন্য দুটো জামা। ও ভীষণ বুঝত। খুবই ভাল মনের ছেলে ছিল। আমাকে এত ভালবাসত। কোনও দিন ঝগড়া করত না। আমিই করতাম। কিন্তু ও হেসে উড়িয়ে দিত। একটু অসুস্থ ও ছিল। ওর কথা আর একদিন বলব। ওর সব কথা। যে কথা এতদিন বুকের ভেতর স্বযত্নে গচ্ছিত রেখেছি। বলব একদিন শুধু ওর কথা।
যাই হোক বাবা স্নান করে গায়ত্রী মন্ত্র জপ করার পর বলত মামনি লুঙ্গি টা দে তো। মা ওমনি আলমারি থেকে নতুন লুঙ্গি টা বের করে দিত। উফ্ দুজনের চোখে মুখে ভালোবাসা উপচে পরে যেন গোটা ঘরদোর খুশিতে ভেসে যেত। বাবা লুঙ্গি টা হাতে নিয়ে বলত খুব সুন্দর হয়েছে। সেই একই লুঙ্গি । নীল চেক কাটা । তখন তো আজকের মতো এমন বাহারি লুঙ্গি ছিল না। একই ডিজাইনের লুঙ্গি সারা বছর পরার পর নতুন করে আবার খুব সুন্দর হয় কী করে বুঝতে পারতাম না। কিন্তু আজ বুঝি। একটা ছোট্ট সাধারণ উপহারের মধ্যেও কত ভালবাসা কত আপনত্ব লুকিয়ে থাকে।।
মা বিকেলে বাবার দেওয়া ছাপা শাড়িটা পরত। কোনও কোনও বছর শাড়ি হত না। একটা সস্তার লাল ব্লাউজ হত। সেটাই পরে মা হাল খাতা করতে যেত। লাল রঙ মায়ের খুব প্রিয় ছিল। বাবার ছিল সবুজ। লুঙ্গি টা পরতে পরতে বাবা বলত কেন যে ব্যাটা রা সবুজ লুঙ্গি করে না। শালা মোছলা গুলো নীল লুঙ্গি ছাড়া কিচ্ছু বুঝলই না।
মুর্শিদাবাদ মুসলিম প্রধান। তাই স্বাভাবিক ভাবে নীল চেক কাটা লুঙ্গিই বিক্রি হত বেশি।
বিয়ের পর কলকাতার শ্যামবাজার এ একটা লুঙ্গির দোকান দেখিয়ে ছিল বাবা। মুর্শিদাবাদ লুঙ্গি স্টোর । তারপর থেকে বাবার লুঙ্গি আমি ওখান থেকেই কিনতাম। বাবা চলে যাওয়ার পর(২০০৪) আমি আমার রাঙা কাকুর জন্য নানা রঙের লুঙ্গি কিনে আনি। কমলা লাল সবুজ খয়েরি কাল সাদার ওপর কলমকারি কত রঙের কত ডিজাইনের যে লুঙ্গি! বাবার কথা খুব মনে পড়ে। ঐ সময় আমি অত স্বাধীন ছিলাম না আর্থিক ভাবে। তাই ইচ্ছে থাকলেও কিনতে পারি নি। এখন আমি হাত খুলে কিনি। আমার রাঙা কাকুও (বাবার পরের ভাই, চার নম্বর কাকু) বসে থাকে আমার লুঙ্গির জন্য । প্রতিদিন স্নান করার পর লুঙ্গি পরতে পরতে বলবে মামনির মতো এমন সুন্দর লুঙ্গি কেউ কিনতে পারে না।।

সেজেগুজে মাথায় ক্লিপ আটকে বাবার হাত ধরে আর ভাই মায়ের হাত ধরে বাজারে যেতাম হাল খাতা করতে। মিষ্টির প্যাকেট ক্যালেন্ডার আমরা দুই ভাই বোনই নিতাম। বাজার টা তখন কি জমজমাট,, দারুণ সব গান বাজত। ।

সতু কাকুর দোকানে খুব ভীড় হত। তার ই মধ্যে গলা উঁচু করে বলত মামনি সন্টু আয় মিষ্টি খেয়ে যা। পদশ্রী থেকে জুতো কেনা হত। তাই সেখানে যেতাম। পূর্ণিমা ক্লথ স্টোর এর জামা পরে বড়ো হয়েছি। স্বপন কাকুর বোন পূর্ণিমা আমার সঙ্গে পড়ত। যাইহোক চারটে পাঁচটা মিষ্টির প্যাকেট ক্যালেন্ডার নিয়ে আমরা বাড়ি ফিরতাম। তখন সব দোকেনেই শরবত দেওয়া শুরু হয়েছে। দেখা হলেই সবাইকে শুভ নববর্ষ বলা,পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করা। এসব তো ছিলই।। শরবত আর মিষ্টি খেয়ে পেট ভর্তি করে বাড়ি আসতাম আমরা।
এরপর রাত আটটা সারে আটটায় গানের মাস্টার মশাই আসত। বাবা মা মাদুর পেতে বাগানে বসত আমার গান শুনবে বলে।আর ভাই তখন ঘুমিয়ে কাদা। সারাদিনে কম ঝকমারি তো হত না? বাপরে! শরবত মিষ্টি খেয়ে ওরও পেট ভর্তি । ঘুমিয়েই পড়ত বাড়ি ফিরেই।
শুরু হত গান। বেহাগ বসন্ত মালকোষের সুরের
মূর্ছনায় আমাদের সাধারণ ঘর গেরস্থালির সংসারে ,,,, আমাদের পাড়ায় তখন যেন কোজাগরী পূর্ণিমা,,,,,,,

 ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।