সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে শম্পা রায় বোস (পর্ব – ১২)
by
·
Published
· Updated
আমার মেয়েবেলা
(পূজোর কেনাকাটা)
পুজোর কেনাকাটার কথা মনে পড়লে আমার মেয়েবেলায় চলে যেতে ইচ্ছে করে। দারুণ সুন্দর ছিল দিনগুলো। মা বাবার হাত ধরে ভাইয়ের সঙ্গে পুজোর জামা কিনতে যেতাম। কি বলব যেদিন মা বলতো আজ তোদের জামা কিনতে যাব। উফ্ কী যে উত্তেজনা!! সারাদিন খুব ভালো ভাবে থাকার চেষ্টা করতাম আমরা। কোনও দুষ্টুমি নয়। কোনও ভাবেই মায়ের মাথাটা যেন গরম না হয়। তাহলে ই সব মাটি। আমাদের সময় বছরে দুবার জামা কাপড় কেনা হত। ১লা বৈশাখে আর পুজোয়।
বিকেলে বাজারে যেতাম। ছোট্ট মফস্বলের বাজার যেমন হয় আর কি। তিন /চারটে দোকান । তার মধ্যে থেকেই সেরা জামাটা নিতে হবে।দোকান গুলোতে খুব ভীড় হতো। বিশেষ করে পূর্ণিমা ক্লথ স্টোর। স্বপন কাকু হাসি হাসি মুখে বসে থাকত। গেলেই এক গাল হাসি নিয়ে বলত ওমা মামনি এসেছিস? দাঁড়া তোকে একটা দারুণ সুন্দর জামা দেখাই। তোর কথা ভেবেই কলকাতা থেকে এনেছি। তখন কলকাতা মানে আমার এবং আমাদের কাছে আমেরিকা, লন্ডন এর মতো। তো যাইহোক দোকানের সামনে লম্বা বেঞ্চ পাতা থাকতো আমরা কোন সময় বসার সুযোগ পেতাম, কোন সময় পেতাম না। খুব ভীড় হত। আসলে আশেপাশের গ্রামের লোকেরাও তো আসতো। বসার জায়গা না থাকলে আমরা বাবার হাত ধরে দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম।
দোকান মানে কোনও বড়সড় দোকান নয়। মাথায় টিনের ছাদ দেওয়া নড়বড়ে অতি সাধারণ ছোট দোকান । তো যাই হোক মা কোমরে কাপড় গুঁজে ভীড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ত সেরা জামাটা নেওয়ার জন্য । তবে সেটা দামেও সস্তা হওয়া চাই। লক্ষ্য করতাম, মা বেশি দামি জামার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। পাশে কোনও চেনা কাকিমা সেই জামাটা কিনলে, মা একবার ভীড় ঠেলে বেরিয়ে এসে আমার গায়ে ফেলে দেখতো, আমায় কেমন লাগে। আসলে বাবাকে সেই সময় অনেক আত্মীয় স্বজনকে জামা কাপড় দিতে হত । বাবা অতটা কুলিয়ে উঠতে পারত না। মা সারা বছর সংসার খরচের টাকা একটু একটু করে জমিয়ে রাখত। তাই আমাদের অত ভাল,,
মানে খুব দামি জামাকাপড় হোত না।
দোকানের কাকু বলতো, “নিন না বৌদি মামনি কে খুব সুন্দর লাগবে। একদম পরীর মতো। আমাকে না হয় মাসে মাসে টাকা দিয়ে শোধ করবেন? কী যে আন্তরিকতা ছিল ঐ কাকুর মধ্যে আজও ভুলতে পারি না।
আবার এমনও হতো একই জামা দুজন কাকিমা চেপে ধরেছে। আর অন্য পিস নেই। তারা হয়তো ভাল বন্ধু। কিন্তু তখন তাদের দুজনের মধ্যে অপত্যস্নেহ এতটাই কাজ করত যে জামা নিয়ে ঝগড়া বেঁধে যেত। দুজনেই দুজনের মেয়েকে পরী সাজাতে চায়। সে যে কী অবস্থা! বাবা এমন হাসত যে চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে যেত। বাবা একটু হাসলেই চোখে জল আসত। আমারও এমন হয়। যাইহোক ভাই একটু এগিয়ে দু হাত কোমরে রেখে হাঁ করে খুব মন দিয়ে ঝগড়া শুনত।
আমার মা ঘন্টা তিনেকের যুদ্ধ সেরে এবং জিতে যখন দোকান থেকে বেড়োত, সে কী বিধ্বস্ত অবস্থা! বাবা বলত চল এত যুদ্ধ করলে সতু দার দোকানের ক্রিম চপ খাবে চল।
কিন্তু আমার মা, অত ঘন্টা ভেবে চিন্তে দুটো জামা কিনে আনার পর সারারাত টেনশনে না ঘুমিয়ে, সকালে উঠেই সেই জামাই পাল্টাতে যেত। নিজের জমানো কিছু টাকা তার সঙ্গে যোগ করে শেষপর্যন্ত সাধ্যের বাইরে সেই (কাকিমার কেনা) দামি জামাটাই কিনে আনত এবং আমাকে পরী সাজানোর প্রতিযোগিতায় জিততে পেরে নিজেকে পৃথিবীর সর্ব শ্রেষ্ঠ বিজয়ী ভাবতো।
আজও মায়ের সেই মেয়েকে সাজানোর সুখের হাসিটা মনে পড়ে। বাবা অফিস থেকে বাড়ি এসে দেখত অন্য জামা। এবং মা কিভাবে এই অসম্ভব কান্ডটা করেছে সেটা বাবাকে খুব মন দিয়ে শুনতে হতো। কারন যে জামা নিয়ে কাড়াকাড়ি হবে না সেই জামা আবার ভাল নাকি? ভাইয়ের জামা প্যান্ট নিয়ে অত সমস্যা হতো না। আসলে পৃথিবীর সমস্ত সমস্যাই তো মেয়েদের কে নিয়েই। তো যাই হোক এবার জুতোর কথায় আসি। স্কুলের কালো জুতোই হতো আমাদের পুজোর জুতো। আলাদা করে আর জুতো হতো না। সাদা মোজা কেনা হতো। এবার সব কেনা হলে আমাদের দুই ভাইবোনের যে কী মানসিক অবস্থা হতো সে আর বলার নয়। কী উত্তেজনা! কবে পুজো আসবে, কবে নতুন জামা পরবো!
সকালে ঘুম থেকে উঠেই জুতো টা পরে একবার ঘরে হেঁটে নিতাম। বাবা বলত মামনি জুতোটা পরে হাঁট্। না হলে পুজোর সময় পায়ে ফোস্কা পরে যাবে। ফোস্কা পরতই। কারণ পুরোনো হয়ে যাওয়ার ভয়ে জুতো তো সেভাবে পরতামই না। ঘুম চোখে একটু পায়ে গলিয়ে আবার নিজের জামা দিয়েই মুছে টুছে পরম যত্নে জুতোর বাক্সে তুলে রাখতাম। সত্যি কি দিন ছিল। একটা নতুন জামা পরে পাড়ার পুজোর প্যাণ্ডেলে সারাদিন কাটিয়ে আবার সন্ধ্যায় বাবা মার সঙ্গে আর একটা জামা পরে সেই পুজোর প্যান্ডেলে ই আসতাম । সব নতুন মনে হতো। নতুন করে ঠাকুর দেখার আনন্দ পেতাম। কই একঘেয়ে লাগতো না তো? চারদিন ধরে দুটো জামা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে,, একই ঠাকুর দেখতাম। জানিনা এতো আনন্দ,, এতো উৎসাহ,, এতো উদ্দীপনা আমরা সেই ছোট্ট মফস্বলের ছেলে মেয়েরা কোথা থেকে পেতাম !!
আমাদের জামা কেনা শেষ হলে বাবা ঐ ভীড়ের মধ্যেই মাকে বলত এবার তোমার জন্য কিছু নাও? মা হেসে বলত সে পড়ে দেখা যাবে। তোমার জামা প্যান্ট এর পিস কিনে বানাতে দিতে হবে তো? বাবা বলত আমার তো আছে আমার জন্য কিনতে হবে না। মা বলত আমারও আছে। বাবা তখন বলত তোমার ঘরে পরার শাড়িটা ছিঁড়ে গেছে দুটো ছাপা শাড়িই নাহয় কেন।
এখন ভাবি মা বাবারও তো কত সখ ছিল হয়তো। কিন্তু কোন দিন তাদের কোনও দামি জামা কাপড় পরতে দেখি নি। আর আমার তো মনে হয় সব বাবারাই একই রকম। ওদের কিচ্ছু কেনার থাকে না।
আজ আর পুজোর কেনাকাটার সেই আনন্দ কেন পাই না কে জানে? কত দামি দামি শাড়ি হয় আমার! ম্যাচিং ব্যাগ জুতো!!কিন্তু কিছুতেই যেন কিছু ভাল লাগে না । সারাবছর কিনি বলে পুজোয় কেনার উত্তেজনা টাও কমে গিয়েছে। পুজো,,, তাই শপিং করতে হবে। ঠাকুর দেখতে হবে,, যেন একটা নিয়ম।
বাড়িতে পুজো হয় বলে বাইরে কোথাও যাওয়াই হয় না। তবু সন্ধ্যায় তো ঠাকুর দেখতে বেড়োতেই হয় মেয়েদের জন্য । কিন্তু সেটাও আর ভাল লাগে না। আসলে আমাকে যারা পরী সাজাতে চাইতো তাদের মধ্যে একজনও নেই,, আর সাজুগুজু করার পর যে আমায় বলতো ” আমার দিদি সব থেকে সুন্দরী” তার কথা বড্ড মনে পড়ে। সাজুগুজু করার পর আমি আর আয়না দেখিনা । মনে হয় ভাই যেন মিটিমিটি হেসে হাত দিয়ে ইশারায় বুঝিয়ে দিচ্ছে তার দিদি বেস্ট । পুজো বলে আমার কোনও এক্সট্রা আনন্দই হয় না। আমি একা একা কী আনন্দ করব! নতুন শাড়ি পরলে বাবার কথা মনে পড়ে। মা বলত বাহ্ তোকে তো বেশ মানিয়েছে রঙটা!
শাড়ি কিনতে গেলে কেউ আর বলে না,”মামনি তোর জন্য এটা তুলে রেখেছি। গায়ে ফেলে দ্যাখ্। খুব মানাবে তোকে” । এমন দোকানি কাকু তো আর দেখতে পাই না। কিছু কিনতে গেলে এমন আন্তরিক ব্যবহারও আর কোত্থাও পাই না। তখন বড্ড মনে পড়ে ফরাক্কার কথা।
পুজোর কেনাকাটার এখন নাম বদলে গেছে । আমরা এখন শপিং এ যাই কোনও শীততাপনিয়ন্ত্রিত মলে।কোনও ঠেলাঠেলি নেই। কচকচি নেই। আন্তরিকতা নেই। নিলে নাও ,,, না নিলে বাড়ি যাও। we don’t care at all………