সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে শম্পা রায় বোস (পর্ব – ১০)

আমার মেয়েবেলা

আমাদের জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যেগুলো কখনও বলে কয়ে আসে না। আনন্দ যদি বা আসে দুঃখ যন্ত্রণা গুলো কিন্তু আসে একদম আচমকাই।
খুব সকালে হঠাৎই কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে সবকিছু। একটা ভীষণ রকমের মন খারাপ করা,, একটা যেন যন্ত্রণার সকাল। তখন বড্ড অসহায় লাগে। কী করা উচিত সেই মুহূর্তে বা কেমন করে এই কষ্ট গুলো কে ভুলে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসা যায় এই নিয়ে কিন্তু আমাদের জল্পনার শেষ থাকে না। সবারই কোনও না কোনও সময় জীবনের হিসেব মেলাতে ইচ্ছে করে । এমন কোন ঘটনা বা অতি গোপন কথা নতুন করে ভাবতে ইচ্ছে করে কিংবা সাহস করে বলতে ইচ্ছে করে। এমন কাউকে যাকে আমি আমার থেকেও বিশ্বাস করি।
আমারও তো এমন ইচ্ছে করে। ভাবতে বসি ভাল লাগার কিছু ঘটনার ছোট ছোট কিছু মুহূর্ত। মনটা কে ফেরাতে ইচ্ছে করে। গাছের পাতায় নিজের সব খারাপ লাগাগুলো রেখে শিশিরে ঢেকে রাখতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে পাহাড়ের খাদে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখি,, সেই কথাটা বলি যা কোনও দিন কাউকে বলব বলেও বলা হয় নি। ইচ্ছে করে,, শুধু ইচ্ছে করে বৃষ্টি এলে উদোম ভিজি। বৃষ্টির জলের সঙ্গে আমার লুকোনো কষ্ট অভিমান অপমান গুলো কেমন চোখের জলের সঙ্গে মিলেমিশে আমার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। ধুয়ে যায় সব কিছু,,, অবহেলার চিনচিনে যন্ত্রণা, না বলতে পারা প্রথম ভালোবাসা, কিংবা জীবনের ভীষণ রকমের কোনও গোপন ঘটনা যা আমি ইচ্ছে করেই ভুলে যেতে চাই,,, সীমাহীন আপসোস!!—-
সব সাফ করে দিতে থাকি। কেউ জানতেই পারে না,,
খোলা আকাশে শুধু খুঁজে বেড়াই। হাতড়ে মরি আমার ভালোবাসার সেই স্বার্থপর বাজে লোকগুলো কে। যারা চলে গেছে মুখ ফিরিয়ে। যাদের জন্য আমি আমার গোটা একটা জীবন দিলাম। এক মুহূর্তের জন্য ও ভুলে থাকতে পারলাম না। আজও ছেড়ে থাকতে পারি না তাদের। আমার পুরো জীবনটাই মেয়েবেলার স্মৃতি আঁকড়ে একটা স্বপ্নের মধ্যে কেটে গেল। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। সেই আগের মতো। এই আশায় আশায় কখন যে শরীরে বার্ধক্য এসে কড়া নাড়ল বুঝতেই পারলাম না। হঠাত্ ই এক সকালে ডান পাশের দুটো সাদা চুল উঁকি দিয়ে বলল,,, বাঁচ। এবার তো বাঁচ? নিজের জন্য বাঁচ, নিজের কথা ভাব।
তারা কিন্তু আমার কথা একটুও ভাবে নি। একবারের জন্যও ভাবল না। কিভাবে এই এতবড় পৃথিবীতে আমি একা একা থাকব!
আমাদের তো সব ঠিক হয়ে গেলে, একসঙ্গে থাকার কথা ছিল। সেই আগের মতো একসঙ্গে হেসেখেলে ।
এক একসময় মিউজিক সিসটেম এর ভলিউম টা বাড়িয়ে দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠি। অভিমান অভিযোগ যন্ত্রণা
সব ঢাকা পড়ে যায়,,, আচ্ছা সত্যিই কি সব ঢাকা পড়ে? কই আমার মনের রক্তক্ষরণ তো বন্ধ হয় না!
আমার আপনজন দের মধ্যে সব থেকে কাছের জন ছিল আমার বাবা। হাসিখুশি মিশুকে বাবার ছিল একটা বড়ো হৃদয়। অত বড়ো দিল্ আমি কারোর দেখি নি। আমি মানছি বাবা আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যে রাখতে পারেনি। তারও তো একটা কারণ ছিল? কোনও মানসিক শান্তি দিতে পারে নি। বাবা কোনও দিন বুঝতেই পারে নি যে বাবা কষ্টে থাকলে, আমরাও তো কষ্টে থাকব। বাবার এক একটা ভুল পদক্ষেপ আমাদের জীবন কে,, আমাদের সংসার কে তছনছ করে দিয়েছিল। এত ভাল শিশুর মতো মনের মানুষ, এত সৎ, এত পরোপকারী মানুষ আর যা করুক বিয়ে করে সংসার করা উচিত্ ছিল না। যখন তখন নিজের জীবন কে বাজি ধরা লোকের অকৃতদার হওয়াই উচিত ছিল। আজ জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়ে এসে বাবার চরিত্রের খুঁটিনাটি বিশ্লষণ করতে ইচ্ছে করছে। ক্ষমা করে দেওয়ারও একটা শেষ থাকে? জানিনা এই লোক টাকে ভগবান কী দিয়ে তৈরি করেছিলেন। এত ক্ষমাও কাউকে করা যায়!
###
আমার বাবা ছিল ভীষণ রকমের পরোপকারী মানুষ। কত সময় মানুষের উপকার করতে গিয়ে বিপদে পড়েছে। তবু বাবা উপকার করবেই। কিছুতেই আটকানো যেত না বাবাকে।
বাবার এই গুণ টার জন্য সব্বাই খুব ভালোবাসত,, বিশ্বাস করত। বাবাকে নিয়ে আমারও অবশ্য গর্বের শেষ ছিল না।
আজ বাবার পরোপকারীতার কথা বলব।
আমার সব থেকে ভাল লাগত বাবার এই অপরের বিপদে আপদে ঝাঁপিয়ে পড়া ব্যাপারটা । এখনও যাঁরা বাবার সমসাময়িক বন্ধু বান্ধব আছেন, তারা জানেন। বাবার মতো পরোপকারী মানুষ সেই সময় ফরাক্কায় খুব কমই ছিল। আশ্চর্য হয়ে দেখতাম বাবাকে। নিজের জীবনকে কিভাবে বাজি রেখে বাবা অন্যের বিপদে পাশে দাঁড়াত। এক এক সময় বাবাকে বলতাম এত বাড়াবাড়ি করার কি আছে?
বাবা বলত—
“প্রতিদিন অন্তত একজন লোকের উপকার করবি। সাহায্য করবি। তারপর দেখবি নিজেরই কত ভাল লাগবে। এই ভাল লাগা শুধু নিজের জন্য। আরে বাবা,,, পৃথিবীতে এসেছিস কিছু তো করবি? নাকি এমন ভাবেই জীবন কাটিয়ে দিবি। মামনি সৎ পথে থাকবি মানুষের উপকার করবি, দেখবি ভগবানের আশীর্বাদ তোর মাথা ছুঁয়ে থাকবে।”
একটা ঘটনার কথা বলি:—-
১৯৭৬|৭৭ সালের কথা।। সবে আমাদের সংসারটা সেজে উঠছে, নেচে উঠছে। আমরা খুব শান্তিতে আছি। আমি ভাই একটু একটু করে বড়ো হচ্ছি বাবার গোলাপ আর মায়ের রঙ্গনা গাছের মতো। তখন বৃষ্টি পড়লে ফরাক্কায় খুব জল জমত। বাবা নৌকো বানিয়ে দিত। কত গল্প বলত, গান গাইত, ঘুমোনোর সময় কানে সুড়সুড়ি দিত। মাকে কত ভালবাসত। কত গল্প হত বাবাদের বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে রাতের পর রাত। কোয়ার্টারের সামনে বাগানে তখন যেন চাঁদ এসে পাশে বসত, আমরা জোছনায় ভেসে যেতাম।
আমাদের পাহাড় দেখা ছিল না সমুদ্রে দাপাদাপি ছিল না,,, ছিল না বড়ো কোয়ার্টারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা, এসি ছিল না টিভি ছিল না আলাদা পড়ার ঘর ছিল না দামি আসবাব ছিলনা। রোজ রোজ ভালমন্দ খাওয়া ছিল না। চাউমিন ছিল না, ছিল না কাঁটা চামচ,,,
কিন্তু তা সত্ত্বেও ছিল অনেক কিছু । আমাদের চারজনের শিউলি ফুলের গন্ধ ছিল। কোলে মাথা রেখে শুয়ে হা হা হি হি ছিল। গরম কালে ছাতু দিয়ে পেঁয়াজ কামড়ে পান্তা ভাত ছিল। রাত জেগে লুডো খেলা ছিল। ছুটির দিন দুপুরে ক্যারাম বোর্ড এর ঠকঠক আওয়াজ ছিল। আবার সন্ধ্যায় তাসের আড্ডার বৈঠক ছিল। কত কী ছিল!
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন লক্ষ্মীমন্ত একটা ঘর ছিল, সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালানো ছিল, একসঙ্গে মাটিতে বসে খাবার ভাগ করে নেওয়া ছিল। মা বাবার ভালোবাসার একটা ঘরকন্না ছিল। তার কোণায় কোণায় বাস করত ভালোবাসা,, বিশ্বাস একে অপরের প্রতি অসম্ভব টান আদর আদিখ্যেতা কী না ছিল! তখন ভাই,, মা এর চিকিৎসা ছিল। মার সুস্থ ভাবে সংসার করা ছিল, বাবার ফুটবল ছিল। আমার মেয়েবেলায় ভেসে যাওয়া ছিল।
ভাল ছিলাম সুখী ছিলাম আমরা। যাকে বলে ভরপুর সুখ যেন বাড়ির আনাচেকানাচে খেলে বেড়াত আমাদের মতোই।
কিন্তু সুখ পাওয়ারও তো একটা শেষ থাকে? সুখ দুঃখ নিয়েই তো জীবন। তখন এসব তো জানতাম না। সবে তখন মেয়েবেলার ভালোলাগা গুলো উপভোগ করতে শুরু করেছি। কিন্তু এত সুখ বোধহয় ভগবানেরও সহ্য হল না।।
এল সেই সময়।
৭৬|৭৭ সালে তখন ফরাক্কায় প্রচুর কোম্পানি আসছে। প্রচুর কাজ করছে। ফরাক্কায় তখন রমরমা ব্যাপার। তাদের মধ্যে একটি কোম্পানি বাবাকে টার্গেট করল। কোম্পানির নাম টা আর বললাম না। যে কথা বাবা কোনও দিন কাউকে বলেনি। সেই কোম্পানির প্রমোটার (ডিরেক্টর) কেও ক্ষমা করে দিয়েছে। আমি এতদিন পর তার নাম বলে বাবাকে আর অসম্মান করতে চাই না। বাবা তাকে বিশ্বাস করেছিল, ভালবেসে ছিল সেটা বাবার ভুল ছিল। কিন্তু এতদিন পর তার নামটা বলে বাবার সারা জীবনের গোপনীয়তা আমি কিছুতেই আর ভাঙতে চাই না। ইচ্ছে হয় বলি,,,বাবার সঙ্গে যে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, আমাদের সোনার সংসার টা তছনছ করে দিয়েছিল।বাবার সারা জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছিল। বলেই ফেলি তার নাম। বাবা ক্ষমা করলেও আমি কোনও দিন তাকে ক্ষমা করতে পারি নি।
তো যাইহোক সেই ভদ্রলোক আটঘাট বেঁধেই নেমেছিল। ব্যবসা করতে চায়। কনস্ট্রাকশনের কাজ।
কিছু টাকার দরকার। চড়া সুদে টাকা ফেরত দেওয়ার অঙ্গীকার করে বাবার নাম করে অনেকের কাছ থেকে টাকা নিতে থাকল। বাবাকে সবাই ভালবাসত। তাতু দা মানেই চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায় । যে যাই করুক তাতু দা কোনও দিন কারোর ক্ষতি করবে না। তাই সেই মানুষ টাকে শিখণ্ডী করে
বিশ্বাস করে,, তারাও চড়া সুদের আশায় টাকা দিয়ে দিল। ভদ্রলোক বিল পেলেই সব টাকা সুদ সমেত ফেরৎ দেবে। বাবাও বিশ্বাস করে অফিস থেকে লোন নিয়ে তাকে টাকা ধার দিল। এভাবেই চলল প্রায় দেড় দু বছর।
যথা সময়ে অফিস থেকে বিল পাস হল। লোকটি অফিসের বড়ো বাবু ,, বড়ো ইঞ্জিনিয়ার,, অফিসারদের খুশী করে মায়ের শরীর খারাপ এর অজুহাতে চলে গেল কলকাতায়। বাবা খবর পেয়ে কলকাতায় এল। কিন্তু যখন বুঝতে পারল তখন বাবার কাঁধে সুদে আসলে দশ লাখ টাকার ঋণের বোঝা। সোজা সরল একটা লোক পরম বিশ্বাসে মুখের কথায় টাকা তুলে দিয়েছিল। অত প্যাঁচপ্যুঁচ না বুঝলেও এটুকু বুঝেছিল কিচ্ছু করার নেই। নিজের টাকা যায় যাক। সম্মান বাঁচাতে হবে। যারা বিশ্বাস করেছে তাদের সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে হবে যেমন করেই হোক ।
বাবা ফরাক্কায় ফিরে চরম হতাশায় ডুবে গেল। সুদে আসলে বেড়ে দশ লাখ টাকা,, সেই সময় ঐ টাকা আজকের হিসেবে কত টাকা হতে পারে?
আমি জানি না। অঙ্কে আমি চিরকালই কাঁচা। বাবার শুরু হল অন্য জীবন। আমাদেরও। একটু একটু করে চেনা পৃথিবীটা সরে যাচ্ছে বুঝতে পারছি। ভাই একদিন বলল কী হল রে দিদি? এমন কেন হল?
আমাদের এ বেলা জোটে তো ও বেলা কি হবে জানি না। সেই সময় মাইনের ঐ কটা টাকা থেকে ঐ পরিমাণ ঋণ শোধ করা মুখের কথা ছিল না। বাবা কিন্তু অস্বীকার করে নি। কখনও তাদের বলে নি তোমরা তো সবাই সাবালক ছিলে কেন দিলে টাকা। তোমরা না দিলে তো সে জোর করে নিত না। আমার নাম করল আর দিয়ে দিলে?
না কোনও দিন বলে নি। মুখ বুঁজে শোধ করে গেছে। সুদ সমেত!
আমরা মাসের প্রথম বুঝতে পারতাম না। বাবা তখন টাকা শোধ করছে। বিকেলে বাবা একটা হোটেলের ম্যানেজারের কাজ নিল। যত তাড়াতাড়ি টাকা শোধ করা যায় আর কি। আস্তে আস্তে আমাদের বিকেল, সন্ধ্যে, রাত সব নষ্ট হতে থাকল। বাবার কেনা জমি বিক্রি হয়ে গেল। মায়ের কিছু গয়নাও গেল।
আমরা আর বাবাকে পেলাম না। হারিয়ে গেল আমাদের বাবা।
যে সময়ে আমাদের বাবাকে খুব দরকার ছিল, সেই সময় থেকেই আমরা তিনজন একাকিত্বে ভুগতে শুরু করলাম। কত রাতে বাবা বাড়ি ফিরত। আমি ভাই অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়েই পড়তাম। আমি কোন কোন দিন অবশ্য জেগে থাকতাম। কিন্তু ভাই ঘুমিয়ে যেত।
পরিচর্যার অভাবে বাবার বাগানের গাছগুলো শুকিয়ে যেতে আরম্ভ করল।। একবার মনে আছে আমাদের পুজোতে কোনও জামা কাপড়ই হল না। সেবার আর ঠাকুর মন্ডপে যাই নি। খুব কষ্ট হয়েছিল। মনের মধ্যে একটা পরিবর্তন এল। মা বলল কত গরিব মানুষ আছে যাদের কোনও দিন নতুন জামা ই হয় না। খেতেও পায় না ঠিকমতো। একবার নতুন জামা হয় নি বলে কষ্ট হচ্ছে আর যারা কোনও দিন পায় না তাদের কত কষ্ট হয় ভাব তো?
মায়ের কথা শুনে মনে একটা কী ভীষণ রকমের ঝাঁকুনি খেলাম। তারপর থেকে আর পুজো তে নতুন জামা কাপড় পরতে ইচ্ছে করে না। পরিও না। এখন পুজো উপলক্ষে কত দামি দামি শাড়ি হয়। কিন্তু দূর,, পরতেই ইচ্ছে করে না। পুরোনো গুলো পরেই চালিয়ে দি।
#####
এইভাবে চলতে শুরু করল আমাদের জীবন। তিল তিল করে আমরা ক্ষয়ে যাচ্ছিলাম। কি যে করব বুঝতে পারতাম না। গ্র্যাজুয়েশনের পর আমি আর পড়তে চাইলাম না। বাবাকে বললাম ভাই কে মানুষ কর। বাবা বলল এমন কথা বলিস না মামনি আমি যে তাহলে শেষ হয়ে যাব। আর কটা বছর। তারপর দেখবি সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। একদম আগের মতো। একটু অপেক্ষা কর। আর কটা দিন সময় দে।
সব ঠিকঠাক করতে করতে কত টা যে সময় চলে গেল বাবা সেটা বুঝতে ই পারে নি। আমরা বড়ো হয়ে গেলাম। আমাদের শৈশব কৈশোর হারিয়ে গেল। বাবা টাকা রোজগারের নেশায়, কিছু দেখার সুযোগই পেল না ।
আমাদের চাওয়ার মধ্যে কোনও দিন স্বাচ্ছন্দ্য শব্দ টা ছিল না। আমরা দুই ভাই বোন কোনও দিন বাবা মার কাছে কোনও রকম আবদার করি নি। ক্ষিদে পেয়েছে বলি নি। ভাল জামা কাপড় পরতে চাই নি।এমন কি খাতা পেন কেনার কথাও বলতে পারি নি। পুরোনো খাতার পাতা ছিঁড়ে আমি খাতা বানাতাম। নিজের জন্য ভাই এর জন্যও। কোনও দিন টিউশন এর কথাও বলি নি বাবাকে। আমরা শুধু বাবাকে কাছে পেতে চেয়েছিলাম । আগের মতো জীবন চেয়েছিলাম। যেটা পাওয়া আর কোন ভাবেই সম্ভব হয় নি ।
যা বলছিলাম গ্র্যাজুয়েশন এর পর বাবাকে বললাম এবার তোমাকে প্রশ্ন করাই যায়,, জিজ্ঞেস করে ছিলাম ,,, কেন এমন হল? কিছু তো হয়েছে? কারণ তোমার বন্ধুদের ছেলেমেয়ে দের মতো আমরা আমাদের জীবন কাটাতে পারলাম না কেন? এমন কেন হল বাবা?
কোনও এক শ্রাবণের নির্জন দুপুরে কথাটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে তরতাজা চার চারটে জীবন ,,, নিজের হাতে তৈরি সুখের সংসার সব ভেঙে গেল,, চোখ ভরতি জল নিয়ে ঋণে জর্জরিত ঝুঁকেপড়া মানুষ টা আরও ঝুঁকে তার ব্যর্থতার কথা, তার বিশ্বাসঘাতকতার কথা বলেছিল। যা আজ আমি বলে কিছুটা হালকা হলাম। হলাম কী? হয়তো! হয়তো নয়!
সেদিন বাবার এই কাহিনী শোনার পর ঘুমোতে পারিনি। কত খারাপ কথা ভেবেছি, বলেছি, সবাই বাবাকে ভুল বুঝেছে।
সবার মনেই একটা প্রশ্ন ছিল এত টাকা মাইনে পায় কিন্তু মাইনের টাকাটা নিয়ে করে কি?
বাবা যেদিন মাইনে পেত সার বেঁধে পরিচিত কাকুরা বাবার সামনে দাঁড়াত। বাবা হাসিমুখে চা খাইয়ে তাদের টাকা দিত। বাবা যাদের টাকা শোধ করত তাদের কে বলতে বারণ করে দিয়েছিল। তাই আমরা কেউ জানতেই পারিনি।
তারপর কত বছর চলে গেল এভাবেই। শেষ পর্যন্ত বাবা ঋণমুক্ত হয়েছিল। সম্মান বাঁচাতে পেরেছিল। যে সম্মান যে বিশ্বাস যে ভালোবাসা বাবার প্রাণের চেয়েও অধিক ছিল, শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পেরেছিল। সুদ সমেত সমস্ত টাকা বাবা শোধ করেছিল। অপরের নেওয়া টাকা। হ্যাঁ আমার বাবা শোধ করেছিল। বাবা বলেই পেরেছিল। অন্য কেউ হলে পারত না। করতও না।
কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল। ততদিনে ভাই চলে গিয়েছে না ফেরার দেশে। মা ও নানা রকম অসুখ বাধিয়ে ফেলেছে। আমিও তখন না মরে বেঁচে আছি। বাবা যখন ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য হাত বাড়ালো,, দেখল কেউ নেই,,,, কিচ্ছু নেই,, সেই সময় নেই,, সেই পরিস্থিতি নেই,, সেই ভালবাসা নেই ,, নেই সেই মানুষ গুলো,,,, এতগুলো বছরে সেই বিশ্বাসঘাতক টাও আর বাবার সঙ্গে কোনো রকম যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করে নি।
সব ঠিক করে দেওয়ার,,, কথা দেওয়া,, কথা না রাখার ভারে——এতগুলো “নেই” নিয়ে বাবার পক্ষে আর সুস্থ থাকা সম্ভব ছিল না। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল।
দিনটা ছিল ১৯৯৪ সালের ৬ই জুন।
হ্যাঁ সেই মানুষটা যে নেভি ব্লু কালারের গেঞ্জি পরে গোলবার সামলাত। যাকে ফাঁকি দিয়ে গোলবারের নেটে বল ঢোকানো প্রায় অসম্ভব ছিল। রাইটব্যাঙ্ক ডিভিশনের সেই ঝকঝকে গোলকিপার —-
তাতু রায় ওরফে দেবী প্রসাদ রায় ….

ক্রমশ….

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।