সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে শম্পা রায় বোস (পর্ব – ২৯)

আমার মেয়েবেলা

আমার প্রিয় শিক্ষিকা

আমার মেয়েবেলায়,
আমার স্কুলের সময়টা ছিল অসাধারণ। ঐ সময়টা আমি কী যে ভালো কাটাতাম সে আর বলে শেষ করতে পারি না।
প্রতিদিন প্রথম পিরিয়ডেই শাস্তি। অতটা রাস্তা হেঁটে এসে একটু যে বসব তার উপায় ছিল না। মনিটরের খাতায় প্রথমেই জ্বলজ্বল করত,, আমার নাম। এখনও বেশ মনে আছে ক্লাস সিক্সে পড়ি। আর বি দি (রেখা ভট্টাচার্য ) আমাদের ক্লাস টিচার। ইংরেজি পড়াতেন। পরিপাটি করে পাটভাঙা সব সুন্দর সুন্দর ছাপা শাড়ি পরে আসতেন। কোনদিন হলুদ কোনদিন সবুজ আবার কোন দিন খয়েরি ছোট হাতা ব্লাউজ পরতেন। মুখের প্রসাধন বলতে একটু হালকা পাউডার আর ঠোঁটে সামান্য গ্লিসারিন। ব্যাস্ আর কিচ্ছু না। টিপ কাজল কিচ্ছু না। বিয়ে করেন নি। ডানদিকে চিবুকের পাশে শ্বেতির দাগ। বয়স কত হবে ! এই ছাব্বিশ সাতাশ,,,বিয়ে করেন নি নাকি হয় নি সেটা জানার কথা কোনদিন মনেই আসে নি। আসলে সেইসময় আমরা সবাই একটু বেশিই সরল সাধাসিধে ছিলাম। কারোর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অত চিন্তা ভাবনা করার কথা মাথাতেই আসত না।
দিদিকে আমার খুব ভালো লাগত। খুব সুন্দর করে গুছিয়ে শাড়ি পরতেন! প্লিট করতেন না। আমি একদৃষ্টে ওনার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। সুন্দর উচ্চারণে পড়া শুনতে শুনতে আরো গভীরে গিয়ে ওনার ভেতরটা দেখার চেষ্টা করতাম। মানুষটাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করতাম। ওনার মনটা পড়তে চাইতাম। খুব সুন্দর বোঝাতেন। ক্লাসে বসেই পড়া তৈরি হয়ে যেত। কোন কোন দিন কিছুই পড়া শুনতাম না। আসলে শুনতাম কিন্তু মাথা পর্যন্ত যেত না,, ওনার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ওনার মধ্যে চলে যেতাম নিজেই বুঝতে পারতাম না।
মানুষের মন নিয়ে নাড়াচাড়া করতে আমার খুব ভালো লাগত। এখনও তাই। তাই তো কারোর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি তার মনটা পড়ে ফেলতে পারি আজও,,,আজও তাই কষ্ট পাই সেই ছেলেবেলার মতো।
সেদিন আমার বড়ো মেয়ে বলছিল মা তোমার থেকে আমার ম্যাচিউরিটি বেশি,, মনোবিদ মেয়ের কাছে আমি সেটা স্বীকার করতে একটুও লজ্জা পাই নি। কারন আমি জানি সেটা। আমি বড়ো হয়েছি,,স্কুল ছেড়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছি,,,আমার বয়স বেড়েছে স্বাভাবিক নিয়মে কিন্তু আমার মন সেই স্কুলেই আটকে রয়েছে। ছাড়ানোর যে চেষ্টা করিনি তা নয়,,, কিন্তু হয়নি। এখন এই ফেলে আসা স্মৃতি যাপনের মাধ্যমে আমি এত ভালো আছি যে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে আর মন চায় না।
যা বলছিলাম রেখা দি পড়াচ্ছেন,, আমরা কয়েকজন বাজে মেয়ে যাদের প্রতিদিন খাতায় নাম ওঠে,,,টকেটিভ,,,এত শাস্তি পায় তবুও, দিনের পর দিন ক্লাসে পড়া পারলেও দাঁড়িয়ে থাকে,,, তবুও কিছুতেই কথা যেন আর শেষ হয় না,,,প্রতিটি ক্লাসে কথা আর কথা,,,ক্লাস ডিস্টার্বিং,,, অবাধ্য,,,বেনিয়মে চলা যেন অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে,,,, একেবারে বাচাল,,,,,,
সেই আমি বাজে মেয়ে ক্লাসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বেশিরভাগ দিনই দিদির পড়া,,, দিদির কথা,, তন্ময় হয়ে শুনতে শুনতে কোথায়,,কোথায় যেন হারিয়ে যেতাম ,, দিদি যে শুধু বই পড়াতেন তা তো নয়। জীবন সম্বন্ধে বলতেন, জীবন বোধ নিয়ে খুঁটিনাটি আলোচনা করতেন,, জীবনের চাওয়া পাওয়ার হিসেব আমি প্রথম দিদির কাছ থেকেই শিখেছিলাম,, ভালোমন্দ চিনে ছিলাম দিদির কাছ থেকেই,,,এক একদিন পড়ার শেষে দিদির এই দু তিন মিনিটের ছোট ছোট জীবনের কথা,, জীবনকে চেনার কথা ,,, বৃহত্তর জীবনে বেঁচে থাকার লড়াই এর কথা শোনার জন্য আমি মুখিয়ে থাকতাম,,,
দিদি ছিলেন এক আদর্শ শিক্ষক। সারাজীবন মানুষ গড়ে তোলার কাজ নিঃশব্দে করে গেছেন,,অথচ বেশিরভাগই তাকে সেভাবে উপলব্ধিই করতে পারল না। হয়তো কেউ আছে আমারই মতো ,,, এখনও এই মধ্যবয়েসে জীবনের পথটা আটকে গেলে দিদির কথা মনে করে। দম আটকে গেলে মনটা ভালো করতে খোলা আকাশে এসে শ্বাস নেয়। অপমান অপবাদ অসম্মান কষ্ট যন্ত্রনা অভিযোগ অভিমানের নুড়িপাথর আস্তে আস্তে সরিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে চলে জীবনের পথে,,, মাথা উঁচু করে,,,,আমি জানি না তিনি বেঁচে আছেন কিনা,,, বারো ক্লাসের পর আর দেখা হয় নি,,, কিন্তু ঐ কটা বছর,,,যা পেয়েছি তা সম্বল করেই এতটা পথ আসতে পেরেছি,,,, এখন মাঝে মাঝেই খুব মনে পড়ে ওঁকে। অনেক কথা বলার ছিল,,, অনেককথা শোনারও ছিল,,, জীবনেরপথে চলতে চলতে দিশেহারা আমি যখন বড্ড এলোমেলো হয়ে যাই। বড়ো না হওয়া অভিভাবক হীন আমার মন তখন সারাক্ষণ অভিভাবকের নিশ্চিন্ত ছাতার তলায় থাকতে চায়। জীবনের পাঠ শুনতে চায়,, জীবনের চলারপথটা তো অত সহজ নয়,,, তারজন্য একজন ভালো শিক্ষক লাগে,,,যে আমায় হাত ধরে নিয়ে যাবে অনেকটা পথ,,,আর আমি পরম নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করে চলতে থাকব,চলতেই থাকব,,,,,,
জীবনের পথে,,,

দিদি আমাকে খুব বুঝতে পারতেন,,,তাই তো কোন কোন দিন পড়ানোর ফাঁকেই হাতের ইশারায় বসতে বলতেন,,,, আবার কোনো কোনো দিন ক্লাস শেষে,,, দাঁড়িয়ে থাকা পায়ের যন্ত্রনায় কাবু আমার কাতর মুখটার দিকে সবার অলক্ষ্যে তাকিয়ে চলে যেতেন। স্মার্টলি,,মাথা উঁচু করে,,,,
দিদির সঙ্গে আমার চোখে চোখে কথা হত। আমি জানতাম দিদি আমাকে বুঝতে পারতেন,,
তাইতো চোখের ঐ তাকানোতেই আমার যেন সব পা ব্যথা ভালো হয়ে যেত।
ব্যক্তিগত জীবনে আমার যে কিছু একটা সমস্যা রয়েছে একথা দিদি বুঝতেন,,, এ আমার অনুমান নয়,, বিশ্বাস।
আসলে বাড়িতে আমার সঙ্গে কথা বলার মতো কেউ ছিল না,, বড্ড শাসনে মানুষ হয়েছিলাম,,, একটু নিঃশ্বাস নিতে ছুটতে ছুটতে আসতাম এই স্কুলটায়,,, আনন্দ চেপে রাখতে পারতাম না,,, অনর্গল কথা বলতাম,,,আমার পাশে যে বসত তারও নাম উঠত। তবে বেশির ভাগ সময়টাই আমি শম্পুর পাশে বসতাম। আর ও ছিল আমাদের ক্লাস মনিটর। টিচারের টেবিলের সামনে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে ক্লাস দেখত। আমি কোন সময় পিছন ফিরে কথা বলতাম আর না হলে নিজের সঙ্গেই বিড়বিড় করতাম,,,
কেউই আমাকে নিয়মে বাঁধতে পারেনি। ক্লাস টেনে ফেডাপ শম্পু আর আমার নামই লিখত না। লিখলেও খাতা জমা দিত না। আজ এই শম্পুই আমার সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে। একদিন কথা না হলে মনে হয় কতদিন কিছু বলা হয় নি,,,শোনাও হয় নি কতকিছুই,,,
আমার আর এক বন্ধু স্বাতী প্রতিদিন আমার গলা শুনতে চায়, ও বলে আমার কথা না শুনলে তার নাকি দিনটাই কেমন কেজো হয়ে যায়,,,দিনে যে কতবার কথা হয় গল্প হয়,, কোথাও বেড়াতে গেলে আমাকে যেতেই হবে,,, আমার সব বন্ধুরা কথা বলা হৈচৈ করা সেই ছেলেবেলার টকেটিভ শম্পাকেই চায়,,, মনখারাপে চায়,,, আবার ভালো মনেও চায়,,, অভিমানে চায় আবার যন্ত্রনাতেও চায়,,,,
এখন আগের মতো আর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। দিনের কয়েক ঘন্টা একটু নিরিবিলিতে কাটানোর জায়গা খুঁজি,, কিন্তু সবাই আমাকে ঠিক সেইইইই আগের মতো দেখতে চায়,,আমাকে নাকি শান্তশিষ্ট অল্পকথায় মানায় না। আমার বন্ধু,আমার সিংহ মশাই স্বামীটি একসময় দশ পয়সা দিতে চেয়েছিল শুধুমাত্র কথা কম বলার জন্য। তার ও দেখি আজকাল অভিমান হয় এই ভেবে যে আমার নাকি সব কথাই বন্ধুদের সঙ্গে,,,,,আসলে কোন কথা বলার মতো আমার যে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই,,,সব কথা যে ফুরিয়ে গেছে সেকথা ওকে বোঝাতেই পারি না।

আমি এক এক সময় খুব দ্বিধায় পরে যাই,,
কোনটা ঠিক? সেদিনের সেই কথাবলা আমি নাকি আজকের এই বন্ধুদের প্রিয় কথাবলা আমি নাকি ফালতু কথা বলা আমি,,,কারন জীবন থেকে শিখেছি মেয়ে যখন কোন বাড়ির বৌ হয় ,, তখন তাকে অত কথা বলতে নেই। তার সব কথাই তখন ফালতুতে পরিণত হয়,,একটা যেন হেয় ভাব সবার চোখে মুখে প্রকাশ পায়,,, শ্বশুর বাড়িতে বুঝে,, মেপে কথা বলতে হয়। অত কথা বললে মান থাকে না। কেউ পাত্তা দেবে না। বেশি কথা বললে ব্যক্তিত্ব থাকে না। সংসারে ক্ষমতা, ব্যক্তিত্ব,
সম্মানটাই বড়ো কথা,,,
সংসার করতে হয় মস্তিষ্ক দিয়ে,, হৃদয় দিয়ে নয়,,,
বেশিক্ষণ বসে কিছু ভাবতে পারি না। সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যায়। ঠিক ভুলের হিসেব করতে করতেই মাথার চুল কবে যে রূপোলি হয়ে গেল টেরই পেলাম না।
আজকাল দিদির একটা কথা খুব মনে পড়ে,,ক্লাস টেনের শেষের দিক,, স্কুল জীবন শেষ হতে চলেছে,,,মন খুব খারাপ। সেদিন একটা পিরিয়ড শুধু গল্প করলেন।
‘বড়ো হয়ে একটু নিজের কথা ভেবো। ব্যস্ততায়,,
কর্তব্যের ভীড়ে নিজের ভালো লাগাগুলোকে মেরো ফেলো না। নিজেকে একটু সময় দেওয়ার চেষ্টা করো। আমার ছোট বেলায় খুব আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করত। কিন্তু প্রতিজ্ঞা করেছিলাম চাকরি পেলে তবেই আইসক্রিম খাবো। এখন চাকরি পেয়েছি কিন্তু আইসক্রিম খাওয়ার সেই মনটাই আর নেই’।
আমি বলেছিলাম যা মন চাইবে তাইই করব?
—– আমার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘না খারাপ কাজ অবশ্যই করবে না। একটা বয়েসে এসে ভালো খারাপের বোধ তো আসেই। নিজের অন্তরাত্মাই তোমাকে ঠিক ভুলটা বলে দেবে। আমি বলছি নিজের ভালো লাগা,, নিজেকে ভালো রাখতে,, ভালো থাকতে,,,যতটুকু করা যায়। নাহলে সারাজীবন আপসোস করতে হয়। যেমন আমি করেছি,,,,করছি,,,আমার ছোট ছোট ভালো লাগাকে আমি কোন দিন গুরুত্বই দিই নি,,,
আমায় কেউ শেখায় নি,,,,বলেও নি,,,, তোমাদের যাতে আপসোস করতে না হয় সেই জন্যই বললাম’,,
আজ বুঝি ,,,,, জীবনের অর্ধেকটা সময় পার করে আজ বুঝতে পারি দিদি কী অসাধারণ জীবনতত্বের কথা বলেছিলেন,,,,,

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।