ভ্রমণ সিরিজে শতদ্রু ঋক সেন – ১৬

দুই পা ফেলিয়া 

গুডনাইট স্যার… সাবধানে ড্রাইভ করবেন, রাস্তা কিন্তু পিছল হয়ে আছে… একগাল হেসে বিদায় সম্ভাষণ জানালো আমার অফিস সিকিউরিটি। তাকে গুডনাইট জানিয়ে যখন কোম্পানির গেটের বাইরে আমার বাইকের চাকা স্পর্শ করলো তখন রাত ১০.২০। চারদিক শুনশান হয়ে আছে। একে বৃষ্টি, তায় লকডাউন দুইয়ের যুগলবন্দীতে আজ অধিকাংশ মানুষ গৃহবন্দী। বাইক চালাতে চালাতে আমি ঠিক করলাম আজ বেশ খানিকক্ষণ ফাঁকা রাস্তায়, নিজের সাথে, বেশ কিছুটা সময় কাটাবো।চেটে পুটে আস্বাদন করবো আমার অতি চেনা শহরের অতি চেনা রাস্তার একাকী নির্জন রূপ।
মাঝেরহাট ব্রিজ কে এক পাশে রেখে যখন ডান দিকে গাড়ি ঘোরালাম, তখন এতক্ষণ সাথে চলা চাঁদ টি তখন কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম, একরাশ মেঘের আড়ালে, এক টুকরো চাঁদ। সারা আকাশ লাল হয়ে আছে, একটু পরেই বৃষ্টি নামবে।
হ্যালোজেন ভেপারের আলো, ভেজা নিঃঝুম পথঘাট, আর মাঝে মাঝে রাতের চাদর ফুঁড়ে তীব্র হেডলাইট জ্বালিয়ে একটি আধটি ট্রাক। ব্যস আর কেউ কোথাও নেই। এক কিওস্কের সামনে ঢূলছেন সারা দিন সফলভাবে লকডাউন চালানো সার্জেন্ট, মনে মনে শ্রদ্ধা জানিয়ে এগিয়ে চললাম। চেতলা ক্রস করে ভাবলাম, একবার মায়ের মন্দির দর্শন করে যাই। তার আগে ব্রিজের উপর বাইক দাঁড় করিয়ে চুপটি করে দাঁড়ালাম।নিস্তব্ধ চার দিক, কচিৎ একটি পরিযায়ী কুকুরের ডাক। চার বছর আগে লাদাখের নুব্রার রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে আধা ঘন্টা নিস্তব্ধতা কে শরীরের প্রতি টি রোমে চারিয়ে নিয়েছিলাম। আজ লাদাখ আর কোলকাতা, কোথায় যেন একাকার হয়ে গেলো।
মায়ের মন্দিরের সামনে আজ ফাঁকা, আশেপাশের গাড়ি বারান্দার তলায় কয়েকজন ঘুমাচ্ছে। সতীপীঠ দর্শন ভৈরবপীঠ দর্শন না করলে অসম্পূর্ণ থাকে, তাই নকুলেশ্বর তলা যাবো মনস্থির করলাম। আচ্ছা, একটু চা খেলে হত না? কাগজের কাপে স্বস্তা চা গুঁড়োর কড়া চা? আর তার সাথে একটা ফিল্টার ঊইলস? কিন্তু আজ বোধহয় এটা পাবো না, এই ভাবতে ভাবতে যখন নকুলেশ্বর তলা এসেছি, দেখি মন্দিরের সামনে একটা ঝুপড়ি দোকান খোলা। দাদা চা হবে? একটু দাঁড়ান, বানিয়ে দিচ্ছি। বাইক স্ট্যান্ড করে নামি। ছোট দোকান, এককোনে এক ভদ্রমহিলা রুটি বানাচ্ছেন, তার স্বামী ই আমার জন্য চা তৈরী করে দিচ্ছেন। এক পাশে একটি ছোট্ট মেয়ে একমনে বসে তার পুতুলকে শাড়ি পরাচ্ছে।
চা এলো। যেমনটি চেয়েছিলাম মনে মনে, ঠিক তেমনি। সাথে দুটি নিমকি বিস্কুট। পয়সা মিটিয়ে, সবে চা চুমুক দিচ্ছি, হঠাৎই কানে এলো… একটা খাবো, দুটো খাবো, সব ব্যাটাকে চিবিয়ে খাবো… উপেন্দ্রকিশোর!!! এতো দিন পর!!! দেখলাম ছোটো মেয়েটি খেলতে খেলতেই ছড়া বলছে। কি যে ভালো লাগলো কি বলবো। ডাকলাম কাছে, নাম বললো শর্মিষ্ঠা, কাছেই একটি স্কুলে ক্লাস ফোরে পড়ে। বললো এই গল্পটি পড়েছে, ভালো লাগে তাই মাঝে মাঝে নিজেই ছড়া করে বলে।
বড়ো ভালো লাগলো। আজ ও তাহলে কোনো বাঙালি বাচ্চা র কাছে উপেন্দ্রকিশোর প্রাসঙ্গিক। মনে মনে বললাম, মা রে তুই জানিস না আজ তুই আমায় কতো আনন্দ দিলি, আজ রাতের যে রুপকথা আমি মনে মনে ভাবছিলাম, সেই রূপকথায় নিজের অজান্তেই আজ জায়গা করে দিলি এক রূপকথার জাদুকর কে। ভালো থাক, অনেক বড়ো হয়ে ওঠ।
একরাশ আনন্দ ও তৃপ্তি নিয়ে, এই খানিক আগে, বাড়ি এসে ঢুকলাম।
লকডাউনের এক চিলতে অভিজ্ঞতা। আজ হঠাৎ করেই দেশের বেশ কয়েক জায়গায় লকডাউন আবার ফিরছে। তাই এই সংখ্যায় এই লেখাটি।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।