সকালের দুটো কাগজই চলে এসেছে। পরেশবাবু বারান্দার বেতের মোড়ায় বসে কাগজ পড়া শুরু করে দিয়েছেন। সুরমা চা করছেন। ছেলে বউমা নাতি ওরা কেউ এখনো ঘুম থেকে ওঠে নি। লকডাউনে ওদের রুটিন ঢিলেঢালা হয়ে গেছে। কিন্তু পরেশবাবু, সুরমার রুটিনে কোনও পরিবর্তন হয় নি। আজও দুজনেই ভোরে উঠে ছাদে একটু হেঁটে, টব থেকে ঠাকুরের ফুল তুলে নিচে নেমে আসেন একসাথে। তারপর সুরমা রান্নাঘরে চলে যান। চা করেন। আর কাগজ দুটো নিয়ে বসেন পরেশ বাবু। পড়া শেষ হলে পরেশবাবু সখ করে ফল, শাক-সবজি কেটে সাজিয়ে গুছিয়ে দেন প্রায় প্রতিদিনই।
করোনার কত রকমের খবর যে কাগজ জুড়ে পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে, সে সব খবর পড়তে পড়তে কেমন দিশাহীন মনে হয় জীবনটা। “আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল!”… গিরীশবাবুর নাটকের সংলাপটাই যেন একটু আওড়ে বলতে ইচ্ছে করে,” আমাদের সাজানো জীবনটা তছনছ হয়ে গেল!”…
বিশ্বজুড়ে করোনার এই আতঙ্কের মধ্যেও দুটো দেশ এখন যুদ্ধ করছে! করে চলেছে যুদ্ধ কত বছর ধরে। আজও থামে নি ওদের যুদ্ধ। কাগজের পাতায় এখবরটা ছবি সহ জ্বল জ্বল করছে, এক প্যালেস্তাইনি শিশুর মৃতদেহ কোলে নিয়ে ধ্বংসস্তূপে দাড়াঁনো একজন মানুষ! ছবিটা দেখে পরেশবাবু খুবই বিচলিত হয়ে পড়েন। আহা রে! খবরে লিখেছে, গাজায় ৫৫ জন শিশু ও ৩৩ জন মহিলা সহ মোট ১৯৭ জন নিহত হয়েছেন এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায়। নিখোঁজ ও আহতদের সংখ্যা আরও ৫০ এরও বেশি। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, প্যালেস্তাইনি জঙ্গি হামাসই প্রথম রকেট ছুড়ে আমাদের আক্রমণ করেছে। আমরা ওকে ছাড়ব না। গর্ত থেকে হলেও টেনে বের করব!… বাইডেন দুটো দেশের চিরকালীন সংঘর্ষের মীমাংসার জন্য একটা আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন। এই খবরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লেন পরেশবাবু। কোটি কোটি মানুষ সারা বিশ্বে ভাইরাসের সঙ্গে লড়ছে। আর ওরা লড়ছে এখনো ক্ষমতার জন্য দম্ভের লড়াই, দখলের লড়াই!….
এই খবরটার পাশেই আরও একটা খবর চোখে পড়ল পরেশবাবুর। পোপ প্রার্থনায় বসেছেন, মায়ানমারের সাধারণ গণতন্ত্রকামী নিহত মানুষদের জন্য। সেখানকার সেনা অভ্যুথানের ঘটনায় পোপ চিন্তিত! বিচলিত! শান্তি চান মহামান্য পোপ ফ্রান্সিস। তাঁর সাথে প্রার্থনায় যোগ দিয়েছেন মায়ানমারের ছাত্র ছাত্রী ও সন্ন্যাসিনীরা।
খবরের কাগজ দুটোয় পরেশবাবু ডুবে আছেন।সুরমা এসে চা দিয়ে বললেন,” আজ একটু মোচাটা ছাড়িয়ে দিও। আমি চিংড়ি মাছ বাছতে বসলাম।”
” দেব। দেব।” পরেশবাবু কাগজের পাতা থেকে চোখ না সরিয়ে কথাটা ভাসিয়ে দিলেন। এবারের খবরটা নিজের দেশের। একজন সাধারণ গৃহবধূ, কবি পারুল খাক্কার, একটা কবিতা লিখে রাষ্ট্রের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছেন। তাঁর কবিতার নাম “শববাহিনী গঙ্গা”। কবি প্রশ্ন করেছেন তাঁর কবিতায়, “রাজা তোমার কাপড় কোথায়?” সঙ্গে সঙ্গে উলঙ্গ রাজার রাজপেয়াদার দল ও স্তাবক বৃন্দরা রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়ে কবির নিন্দায়। কবিকে বুদ্ধিহীন, দেশদ্রোহী, চরিত্রহীনা বলে গাল দেওয়া শুরু করে দিয়েছে। একজন সাধারণ নারীর এই নির্ভীক উচ্চারণ পরেশবাবুকে নাড়িয়ে দিয়েছে। রাজা যে সত্যিই উলঙ্গ হয়ে পড়েছে এখন, সে কথা কেন বলা যাবে না? কেন জানতে চাইব না, আমাদের সন্তানদের প্রতিষেধক আপনি বিদেশে পাঠিয়ে দিলেন? কেন বলুন? জবাব দিন!…
দুটো কাগজই আজ পরেশবাবুর সকালটাকে একদম অন্যরকম করে দিল। ছেলে বারবার বলে, “বাবা, কাগজ এসময় বেশি পড়বে না। টি ভি দেখবে না। তোমার প্রেশার আছে। অহেতুক মনে চাপ নিয়ে শরীর নষ্ট করবে না।”…
পরেশবাবুর আশি ছুঁতে আর আঠারো দিন বাকি। ভালোই তো আছি। মনে মনে ভাবলেন। কোভিশিল্ডের দুটো ডোজই নেওয়া হয়ে গেছে। করোনা এখনো কাবু করতে পারে নি। দেশ-কাল, মানুষ, সমাজের এই সব খবর না পড়ে, না দেখে নির্বোধ একটা জীবন কাটানো যায় নাকি!…