“দে দে দে,চোর কোথাকার?দে”
বলে হাত থেকে পাঁউরুটিটা ছিনিয়ে নেয় দোকানদার।নেলোর চোখের জল আর নাকের পোটা দুটোই একসাথে মাখামাখি হয়ে ওর ছোট্ট গালে লেগে গেল।দোকানদারের মনে হচ্ছিল দ্যায় এক ঘা বসিয়ে কিন্তু ওকে দেখেই মনে হচ্ছে কত যুগ যে চান করেনি আর তাছাড়া সন্ধ্যার সময়টা বেশ ভিড় থাকে দোকানে।অফিস ফেরৎ বাবুরা বাড়ির জন্য চকলেট, পিজা,কেক নিয়ে যায়।তাদের গুবলুগাবলু ছেলেমেয়েরা স্টাডি টেবল থেকে উঠে বাবার হাতে প্যাকেট গুলো দেখে খুশি হয় ভীষন!ওদের মুখে সোনালী আলো ঝিলিক দিয়ে ওঠে!তাই এই ভিড়ে আর ঝামেলা বাড়ায় না দোকানী।
নেলো অবশ তাই ভেবেছিল, এই ফাঁকে একটা রুটি নিয়ে দৌড় দেবে!সকাল থেকে ভিক্ষে করার চেষ্টা করছে কিন্তু বৃষ্টিটা যেমন শত্তুর!ভিক্ষাও জোটেনি।সবে সন্ধ্যা বেলায় একটু থেমেছে।এদিকে সময় চলে যাচ্ছে যে!কিন্তু ধরা পড়ে যাওয়ায় আর রুটিটা নেওয়া হলো না।ভিড় করা খরিদ্দাররা বললো,”ছেড়ে দাও কালীদা। বাচ্চা মানুষ!”
অফিস ফেরৎ শুভাগতও ওই দোকানেই ছিল।ও নিজের প্যাকেটটা নিয়ে বেরোতে যাবে তার মধ্যেই এই কান্ড।বছর আটেকের বাচ্চা ছেলেটাকে চুরি করার চেষ্টা করতে দেখে হঠাৎ কি মনে হল জিজ্ঞাসা করে,”এই শোন!”নেলো ভাবলো,
“এই রে ,এই বাবুটা বোধহয় বকবে,আবার জ্ঞান ও দিতে পারে!বড়লোকেরা বড্ড জ্ঞান দেয় ,ভালো ভালো কথা বলে।
যেমন ফুটপাতে যে স্কুল বসতো ওখানে ও দিদিমণিরা বলতো,
” মিথ্যে বলবে না,চুরি করবে না,মারামারি করতে নেই!”
ওরা কি জানে খিদে পেলে পেটটা কেমন ব্যথা করে?ওরা কি জানে শীতে একটা পাতলা জামায় কত কষ্ট হয়?তাই এই ডাকটা নেলো এড়াতেই চাইলো।কিন্তু শুভাগত একটু দৌড়ে পালাতে যাওয়া নেলোর কনুই চেপে ধরে।
“এই চুরি করছিলি কেন?”
নেলো হাত মোচড় দিয়ে ছিটকে যেতে চায় কিন্তু শুভাগতর মুঠো বেশ শক্ত।
“বল,চুরি করছিলি কেন?”নেলো বুঝলো পালানো এত সহজ নয়।তাই একটু তেড়িয়া হয়েই জবাব দিল,
“ও এক ঠাকমার জন্য!”
“ঠাকুমা!তোর ঠাকুমা?”শুভাগতর গলা নরম হয়ে আসে!
“না,আমার ঠাকমা ফাকমা নেই।ওই ইস্টিশনে এক ঠাকমা, দুদিন নাকি খায়নি, একদম মরে যাবে মনে হয়!তাই!”
একটু যেন গলা ভিজে আসে নেলোর!শুভাগত হাতের প্যাকেটটা ওর হাতে দিয়ে বলে ,”এটা নিয়ে যা,ঠাকমাকে দে।আর শোন রোজ আমি এই স্টেশনে ট্রেনে উঠি।তুই রোজ নটার সময় এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের একেবারে সামনে দাঁড়াবি,আমি তোদের খাবার কিনে দেবো।”
“রোজ?”একটু অবিশ্বাস আর অবাক হবার ঘোর নেলোর গলায়।
“হ্যাঁ, রোজ!”বলে ওর নোংরা জট পড়া চুলে একটু হাত বুলিয়ে দেয় শুভাগত।ওমনি নেলোর মুখে ফুটে ওঠে সেই সোনালী আলো।ঝকমক করে চারিদিক।
“যা,ঠাকুমাকে গিয়ে খাওয়া”,একটু হেসে নেলো তীরের মত ছোটে স্টেশনের দিকে।
শুভাগত আবার দোকানের দিকে পা বাড়ায়।চোখে ভাসে চৌত্রিশ বছর আগের একটা ছবি,মা বাপ মরা ছেলেকে পেঁয়াজ লঙ্কা দিয়ে শেষ ভাতের কণাটা পর্যন্ত খাইয়ে এক বৃদ্ধা এক ঘটি জল খেয়ে পেট ভরালো।নিজের অজান্তেই হাতটা চোখের কোণে উঠে আসে শুভাগতর।