• Uncategorized
  • 0

হৈচৈ ছোটগল্পে সুব্রত সরকার

ছোটদের গল্প নাইট শেল্টার

ঝড় আসছে। ভয়ংকর এক ঘূর্ণিঝড়। ঝড়ের নাম ইয়াস।
নীলদের বাড়িতে খুব তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। বাবা-মা, দাদু দিদা, জেঠু সবাই সব গুছিয়ে রাখা শুরু করে দিয়েছে। নীলও ওঁদের সাথে সাথে কাজ করছে। মোমবাতি, দেশলাই কাঠি, হাতপাখা, টর্চ, জলের বোতলগুলো গুছিয়ে ঠিক ঠিক জায়গায় রেখে দিচ্ছে।
গতবছর ঠিক এইসময় এসেছিল এমনই এক মহাঝড়, সব লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল। সেই ঝড়ের নাম ছিল আম্ফান। চারদিন নীলদের বাড়িতে কারেন্ট ছিল না। সেই চারদিনের কষ্ট নীল ভুলতে পারে নি। জল ফুরিয়ে গিয়েছিল। চার্জ দেওয়া যাচ্ছিল না ফোনে, ল্যাপটপে। ইনভার্টারের চার্জও শেষ হয়ে ঘরে ভূতুড়ে অন্ধকার নেমে এসেছিল। ফ্রিজ চলে নি। কত খাবার নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। উফ্ আর কি গরম, কি গরম ছিল তখন। কত রাত পর্যন্ত সবাই ছাদে বসে থাকত। ঘুম হয় নি ভালো করে। এবার তাই আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাভাস পেয়েই নীলদের বাড়িতে একদম হৈ হৈ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে!…
“নীল! নীল! তুই কোথায়?” দাদু হঠাৎ খুব জোরে ডাকতে শুরু করে দিয়েছে।
নীল রান্নাঘরে মায়ের সাথে একটু কাজ করছিল। কাজ মানে মুড়ি, চিঁড়ে, বিস্কুট, চিনি, ছাতুর প্যাকেটগুলো গুছিয়ে দিচ্ছিল মাকে। মা দাদুর ডাকটা শুনতে পেয়ে বলল,”দেখ তো দাদু তোকে ডাকছে কেন?”
“তুমি ডাকছো দাদু?” নীল এসে দাঁড়াল দাদুর সামনে।
দাদু হাতের খবরের কাগজটা দেখিয়ে চোখের হাই পাওয়ার চশমাটা খুলে বললেন,” এই দেখ কাগজে কি লিখেছে!”
“কি লিখেছে দাদু?”
“আমরাই কি শুধু ঝড়ের ভয়ে সব গোছাতে শুরু করে দিয়েছি! দেখ চিড়িয়াখানার পশু-পাখিদের জন্যও কত সব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
“কি করা হচ্ছে ওদের জন্য দাদু?”
“কাগজের এই রির্পোটটা পড়ে জানলাম, চিড়িয়াখানার সব জন্তু জানোয়াররা যাতে ঝড়ে ভয় পেয়ে নিজেদের না কোনও ক্ষতি করে ফেলে, তার জন্য আগাম কত ব্যবস্থা করছে কর্তৃপক্ষ।”
” দাদু, বলবে তো কি করছে!”
“এই প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ভয় পেয়ে ওরা যেন ছোটাছুটি না করতে পারে, তার জন্য নাইট শেল্টারে আটকে রাখা হবে।”
” নাইট শেল্টার কি দাদু?”
“পশু পাখিদের সরিয়ে সেফ হোমে নিয়ে যাওয়া- তারই নাম নাইট শেল্টার। ”
” বাহ্। দারুণ তো!” নীল বেশ খুশি হয় দাদুর মুখে এই নতুন কথা শুনে।
“রেপটাইল হাউজের সাপগুলোকে বড় বড় বাক্সে ভরে রাখা হবে। অ্যানাকোন্ডাগুলোকেও রাখবে এমন শেল্টারে।”
“তাই! ঐ মস্ত বড় ইয়া মোটা মোটা অ্যানাকোন্ডারাও ভয় পাবে এই ঝড়কে!” নীল চোখ বড় বড় করে বলল।
” আর হাতিদের পায়ে শিকল বেঁধে রাখা হবে নাইট শেল্টারে। ঝড়ে বৃষ্টিতে ওদের যেন কোনও আঘাত না লাগে তার জন্য কত সুন্দর সব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
“আর কি লিখেছে দাদু?”
“লম্বা গলা জিরাফদের রাখা হবে অনেক উঁচু উঁচু তিনটে ঘরে।”
” জিরাফ দেখতে আমার খুব ভালো লাগে!” নীল এবার হেসে হেসে বলল,” দাদু, চলো না সবাই মিলে চিড়িয়াখানায় যাই?”
” কি করে যাবে! আগে পৃথিবী থেকে করোনা দূর হোক। তারপর তো আবার সব জায়গায় যেতে পারবে।”
” দাদু তুমি শুনেছো, করোনার থার্ড ওয়েভ নাকি আসছে!”
” শুনেছি তো। তিন কেন, চার, পাঁচও আসবে! আরও দু’তিনবছর পৃথিবীটা এমন ছন্নছাড়া হয়েই থাকবে।”
“দাদু, পাখি, হরিণ, ময়ূর, কুমীর ওদের কথা কিছু লেখে নি?”
“হ্যাঁ, লিখেছে তো। ওদের জন্যও অনেক কিছু করা হচ্ছে। কোনও পশু পাখিরই যেন কোনও ক্ষতি না হয় তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা হচ্ছে। “
হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া এসে গেল। তার সাথে বৃষ্টি। একদম ঝোরো বৃষ্টি! বাবা খুব চিন্তিত হয়ে বলল,” এবার গ্যারেজে জল ঢুকে যাবে। গাড়িটার বড্ড ক্ষতি হবে!”
দাদু বললেন, “ভাই, মাকে গিয়ে বল ঠাকুর ঘরের জানালা দুটো বন্ধ করে দিয়ে আসতে। তোর দিদা হয়তো ভুলেই গেছে।”
নীল দাদুর ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে যেতে গিয়ে হঠাৎ ওর কানে ভেসে এল ‘মিঁউ মিঁউ ‘একটা শব্দ। গ্যারাজের দিক থেকেই শব্দটা আসছে। নীল গুটি গুটি পায়ে গ্যারাজের কাছে গিয়ে অবাক হয়ে দেখল, বাবার গাড়ির বনেটের ওপর একটা মোটকা হুলো বেড়াল তার তিনটে ছানাপোনা নিয়ে চুপটি করে শুয়ে বসে আছে। বাইরে এখন জোর বৃষ্টি আর হাওয়া শুরু হয়ে গেছে। হু হু করে বৃষ্টির জল ঢুকে গাড়ির চাকাগুলোকে ডুবিয়ে দিল। হুলোটা নীলকে দেখে কেমন ভয়ে ভয়ে করুণ চোখে চাইল, ও যেন বলতে চাইছে, “আমায় তাড়িয়ে দিও না। ওরা আমার বাচ্চা। ঝড় বৃষ্টি কমলে আমি ওদের নিয়ে চলে যাব।”
বিড়াল একদম পছন্দ করে না নীল। ভয় ও ঘেন্না পায়। তাই বিড়াল দেখলেই ও তাড়া করে ভাগিয়ে দেয়। কিন্তু এখন আর তা করতে পারল না। চুপ করে ওদের দিকে চেয়ে থাকল। মনে মনে বলল,” গাড়ির বনেটটাই হোক আজ ওদের সেফ হোম- নাইট শেল্টার। ভয় পাস না হুলো, আমি আজ তোদের তাড়িয়ে দেব না।”
” নীল! নীল!” বাবা সিঁড়ি দিয়ে নামছে। গ্যারাজের কাছে এসে পড়বে!
নীল দৌড়ে গিয়ে বাবার পথ আটকে বলল,” কিছু বলবে?”
” মা তোকে ডাকছে।”
” যাচ্ছি। তুমি আজকের পেপারটা পড়েছো?”
” না। দাদুর পড়া হয়েছে কি?”
” হয়ে গেছে দাদুর পড়া। তুমি ওপরে যাও। আমি দিয়ে আসছি কাগজটা।”
দাদুর থেকে খবরের কাগজটা নিয়ে নীল ওপরে যাওয়ার আগে আরও একবার চুপিচুপি গ্যারাজে এসে হুলোকে বলল,” শোন, বেশি মিঁউ মিঁউ করবি না। চুপ করে শুয়ে বসে থাক। আমি চুপিচুপি তোদের খাবার দিয়ে যাব এসে।”
বাইরে ঝড় ও বৃষ্টি সমানে হয়ে যাচ্ছে। নীল ভাবছে, চিড়িয়াখানার নাইট শেল্টারটা একবার যদি দেখতে যেতে পারতাম!…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।