সাপ্তাহিক অণু উপন্যাসে সুব্রত সরকার (পর্ব – ৪)

বনবাসের বর্ণমালা

চার

শ্যাম পোখরির চারপাশে ঘন জঙ্গল। এই গভীর নিবিড় জঙ্গলে জানা অজানা কত বড় বড় সব গাছ রয়েছে। কিছু গাছকে শুভ্র চিনতে পারছে, কিছু গাছকে শুধুই দেখছে। নাম জানে না, চেনে না। কত কালের প্রাচীন সব গাছ। একটা বন্য সৌন্দর্যে জায়গাটা বেশ অন্যরকম। একটু গা ছম ছম করছে। আবার ভালোও লাগছে এই নিরিবিলি, এই অপার নির্জনতা।
আজ সকালে নাস্তা করে নিছকই ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শুভ্র চলে এসেছে এই শ্যাম পোখরিতে। রাইবস্তি থেকে শ্যাম পোখরি পায়ে হেঁটে প্রায় চল্লিশ মিনিট লাগল। জঙ্গলের পথ। চড়াই নেই। হাঁটতে বেশ লেগেছে। এই পোখরির লৌকিক-অলৌকিক অনেক গল্পকথা হরির কাছে শুনে শুভ্রর খুব ইচ্ছে হয়েছিল ঘুরে দেখার। হরি সঙ্গে আসবে বলেছিল, কিন্তু বাড়ির জলের পাইপ ফেটে গেছে, সেই পাইপ সারাতে হরি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাই শুভ্র একাই চলে এসেছে।
শ্যাম পোখরি এই পাহাড়ের মানুষজনদের কাছে খুব পবিত্র এক তীর্থস্থান। সারা বছর পোখরিতে জল থাকে। জলের রঙ ছায়া সবুজ। জলে অনেক মাছ আছে। এই মাছও পবিত্র মাছ। ওরা কেউ এই সব মাছকে হত্যা করে না। দেবতা জ্ঞানে পুজো করে। কত যত্ন করে মাছকে খাওয়ার দেয়।
প্রতিবছর ফাগুন মাসের পূর্ণিমায় পোখরিতে উৎসব হয়। সেদিন এখানকার মানুষজনরা খুব নাচ-গান, আনন্দে মেতে ওঠে। ঘরে ঘরে হুল্লোড় চলে। ছাং, রক্সি খেয়ে হৈ হৈ করে কাটিয়ে দেয় এই উৎসবের দিনটা।
শ্যাম পোখরিতে এসে শুভ্রর খুব ভালো লাগছে। এই পাহাড়, জঙ্গল এমনিই খুব শান্ত, নির্জন। শ্যাম পোখরি যেন নির্জনতম। পোখরির জল ছায়ায় ঢাকা থাকে সব সময়। এখানকার মানুষ পোখরিকে পাঁচবার প্রদক্ষিণ করে পোখরির জলে ফুল ভাসিয়ে দিয়ে পুজো করে। মনবাসনার গোপন কথা ফিস ফিস করে পোখরিকে বলে। সে বাসনা পূরণ হলে, পোখরিতে এসে আবার পুজো দিয়ে যায়।
শুভ্র শ্যাম পোখরির চারপাশ একবার ঘুরে দেখে এসে গাছের ছায়ায় বসল। খুব চেনা গাছ চিকরাশি। ঝিরি ঝিরি পাতায় হাওয়া বইছে। এখানে বসে দু’একটা স্কেচ করার খুব ইচ্ছে। কাগজ, পেন্সিল বের করল। চোখ থেকে রোদ চশমাটা খুলে ঘাসের ওপর রাখল। তারপর পোখরির দিকে চেয়ে চুপ করে বসে থাকল কিছুক্ষণ। শিল্পীর চোখে চারপাশকে একবার আলতো করে দেখে নেওয়া! যেন স্কেচ শুরু করার এটা একটা প্রস্তুতি।
স্কেচ শুরু করতে যাবে হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠল। চারপাশের শান্ত নীরবতায় মোবাইলের রিংটোনটা কেমন বেমানান মনে হল। শুভ্র একটু বিরক্ত হয়েই ফোন হাতে নিয়ে দেখল, ফোন করেছে মণিকুন্তলা।
“হ্যাঁ, বল…”
“তুই কোথায় এখন?”
“খুব সুন্দর একটা পোখরির পাশে বসে আছি।”
“পোখরি! সেটা আবার কি?”
“ছোট্ট জলাশয়। পাহাড়-জঙ্গলের মাঝখানে এ এক দারুণ সুন্দর জায়গা।”
“তুই লকডাউনে আটকে গিয়ে দিব্যি আছিস দেখছি।”
“কি করব বল? ফেরার তো আর উপায় নেই এখন!”
“তা নেই। কিন্তু তোর ফেরার ইচ্ছে আছে বলেও তো মনে হচ্ছে না।”
“তুই তো ত্রিকালদর্শী সাধিকা, মানুষের মনের সব কথা বুঝতে পারিস!”
“কেমন রাগিয়ে দিলাম দেখলি তো! হা হা হা…”
“ফোন করেছিস কেন বল? আমি এখন স্কেচ শুরু করব।”
“তাই! তাহলে থাক পরে কথা বলব।”
“আরে বাবা বল না কি বলবি!”
“তুই একটু ফোন তো করতে পারিস। লকডাউন এর পর আজ চারদিন হয়ে গেল। সেই প্রথমদিন একটু কথা হয়েছিল তোর সাথে!”
“আমার ফোন পেলে তোর কি ভালো লাগে নাকি!”
“হঠাৎ এসব কথা বলছিস?”
“মনে হল তাই বললাম।”
মণিকুন্তলা ফোনটা কেটে দিল। নিশ্চয়ই খুব রেগে গেছে ও। শুভ্র একটু অবাক হলেও ঘাবড়াল না। মনে মনে ভাবল, এখন ফোন করলেও মণিকুন্তলা ধরবে না। খুব অভিমানি মেয়ে। বরং রাগটা কমুক, পরে নয় কথা বলা যাবে।
স্কেচ শুরু করল শুভ্র। খুব মন দিয়ে স্কেচ করছে। শ্যাম পোখরির জল, চারপাশের গভীর জঙ্গল, মাথার ওপর নীল আকাশ, পাখি, প্রজাপতি সব কিছুকে স্কেচের আলতো ছোঁয়ায় ফুটিয়ে তুলতে চাইছে শুভ্র।
আর্ট কলেজে যখন ও পড়ত, তখনও ওর স্কেচের খুব তারিফ করত বন্ধুরা। পাস করে বেরিয়ে আসার পর কর্মজীবনে আর স্কেচের সুযোগ বেশি পায় না। সারাদিন বিজ্ঞাপনের লেআউট আর কনটেন্ট রাইটিং করতে করতেই ক্লান্ত হয়ে যায়। অবসর পেলে শুভ্র মনের আনন্দে পেন্সিল স্কেচ করে। বেড়াতে বেরলে সবচেয়ে বেশি করে। ওর বেড়ানো আবার ‘একলা চলো রে’…
এবারও বেড়াতে আসার সময় মা খুব চিন্তা করছিল। বারবার বলছিল, “তুই এমন একা একা বেড়াতে যাস, আমার খুব দুশ্চিন্তা হয় রে। সঙ্গে কাউকে নিয়ে যেতে তো পারিস। কেউ সঙ্গে থাকলে দুটো কথা বলা যায়, গল্প করা যায়। আপদে বিপদে কাজেও লাগে।”
শুভ্র মাকে আর কিছু বোঝানোর চেষ্টা করে নি। এই একলা ভ্রমণের যে কি মজা তা শুভ্রই জানে। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে…’ শুভ্র এমন ভেবে একলা চলা শুরু করে নি। ওর একলা চলাতেই যেন আনন্দ। তাই ওর গান, ‘আমার একলা চলা করব রমণীয়…’
বেড়াতে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে একবার বেরিয়ে পড়তে পারলে শুভ্রর আর কখনোই মনে হয় না একলা যাচ্ছি। পথে পথেই পেয়ে যায় কত বন্ধু। ‘কত অজানারে জানাইলে তুমি, কত ঘরে দিলে ঠাঁই/ দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু, পরকে করিলে ভাই।’
তাই তো এই লকডাউনের অপ্রত্যাশিত অঘটনের মধ্যে পড়েও শুভ্রর ঠাই খুঁজে পেতে কোনো অসুবিধা হল না। রাইবস্তির হরিশংকর থাপা দরাজ গলায় বলেছে, “ভাইয়া লকডাউন যব তক রহেগে, তুম আরামসে রহো মেরে পাস। কোই দিক্কত নেহি হোগা। তুমি আমার মেহমান আছো!”
শুভ্র একবার খুব দ্বিধা কুণ্ঠা নিয়ে বলেছিল, “হরি ভাইয়া আমাকে এখন থাকা-খাওয়ার জন্য কত দিতে হবে তুমি বলবে। লজ্জা করবে না।”
হরি কথা থামিয়ে দিয়ে বলেছিল, “তুমি তো এখন আর টুরিস্ট নও। প্যায়সে কি বাত নহি করো।”
শুভ্র আর কথা বাড়ায় নি। ও মনে মনে ঠিক করে নেয়, হরিশংকরের এই আবেগ, এই আন্তরিকতাকে এখন নীরবে সম্মান জানানোই উচিত। লকডাউন মিটে গেলে পর ফেরার সময় হরির হাতে উপহারের মত কিছু অর্থ দিয়ে যাবে। টাকা পয়সা সঙ্গে আছে। ডেবিট কার্ডও আছে। অসুবিধা হবে না।
হঠাৎ হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠে জানান দেয়, আমি আছি! নাহলে শুভ্রর তেমন মনে থাকে না যে সে আছে। ঘাসের ওপর পরে থাকা ‘সে’ বেজে উঠেছে। স্কেচটা প্রায় শেষ করে ফেলেছে শুভ্র। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখল আননোন নাম্বার। ধরবে কিনা ভাবছে। শুভ্র স্কেচটা শেষ করতেই ব্যস্ত। ফোন বেজে বেজে থেমে গেল।
শুভ্রর এখন খুব আনন্দ হচ্ছে স্কেচটা শেষ করে। একটা পরিতৃপ্তির আনন্দ। বারবার স্কেচটার দিকে তাকাচ্ছে আর ভাবছে, এই পাহাড় জঙ্গলে যতদিন থাকব, শুধুই স্কেচ করে যাব। তারপর এই সব স্কেচ গুলোর একটা সিরিজ বানিয়ে কলকাতায় ফিরে কোথাও একটা প্রদর্শনী করলে বেশ হবে।
ফোন আবার বাজছে। অচেনা নাম্বার। মনে হল, আগের কলটাই আবার এল। শুভ্র এবার কল রিসিভ করে বলল, “হ্যালো, কে বলছেন?”
“আই এম আরাধনা। হোয়ার আর ইউ?”
শুভ্র অবাক হয়ে চুপ করে থাকে একটু। ফোন নাম্বারটা বিনিময় হয়েছিল দু’দিন আগেই। কিন্তু নামটা সেভ করতে ভুলে গিয়েছিল। তাই বেশ লজ্জা দ্বিধা নিয়ে বলল, “সরি, আই কুড নট আন্ডারস্ট্যান্ড।”
“নো। নো প্রবলেম। আপনি এখন কোথায়?”
“শ্যাম পোখরিতে এসেছি।”
“শ্যাম পোখরি! আরিব্বাস! একেলাই চোলে গেছেন?”
“হ্যাঁ, একলাই চলে এসেছি।”
“আর বেশি দূর যাবেন না। ওপাশের জঙ্গলে হাতি আছে।”
“তাই! ঠিক আছে আর যাব না। থ্যাঙ্ক ইউ।”
“আপনি আর্টিস্ট আছেন। টিনা আমাকে বলেছে, আপনার ড্রয়িং ভেরি বিউটিফুল!”
শুভ্র এ কথা শুনে একটু লজ্জা পেয়ে চুপ করে থাকে। কদিন আগে টিনা ভাবীর ছোট্ট মেয়ে প্রীতির একটা স্কেচ করে দিয়েছিল শুভ্র। ভাবী নিশ্চয়ই সে কথা বলেছে আরাধনাকে। ফোনের ও প্রান্ত থেকে এবার ভেসে এল, “একটা রিকোয়েস্ট করব? ডোন্ট সে নো!”
শুভ্র কিছু বুঝতে না পেরে দ্বিধা জড়ানো গলায় বলে, “বলুন না কি রিকোয়েস্ট?”
“আমার পাপা-মাম্মির একটা স্কেচ করে দেবেন? দে আর সিনিয়র সিটিজেনস। ওঁদের এই স্টেজের একটা ছবি আমি করে রাখতে চাই। প্লিজ, ইফ ইউ ডু দ্যা স্কেচ, আই উইল বি গ্রেটফুল টু ইউ।”
শুভ্র খুব খুশি হয়ে এবার বলে, “নিশ্চয়ই দেব। আমারও খুব ভালো লাগবে এই স্কেচটা করতে পারলে।” তারপর একটু থেমে মজা করে বলল, “বাট একটা কন্ডিশন আছে!”
“হোয়াট কন্ডিশন?” অনুরাধা অবাক হয়েই বলল।
“মোমো আর কফি খাওয়াতে হবে।”
“হো হো হো… সিওর!” আরাধনা প্রাণ খুলে হাসল। হাসতে হাসতে বলল, “আপনি ফিরে আসুন। আর বেশি দেরি করবেন না। আজ বিকালে আপনার সাথে দেখা করতে যেতে পারি। থাকবেন তো?”
“কোথায় আর যাব! থাকব।” শুভ্র একটা হাল্কা দীর্ঘশ্বাস মিশিয়ে কথাটা বলল।
“ওকে। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ। বাই!”
“বাই। দেখা হবে বিকালে।”
এক ঝাঁক টিয়া পাখি কোথা থেকে যেন হঠাৎ উড়ে এল। পোখরির চার পাশের নীরবতাকে ভেঙ্গে দিয়ে ওরা গলা ছেড়ে কিচিরমিচির শুরু করে দিল। সে কি মুখরতা, কলতান! কখনো-সখনো এমন শান্ত গভীর নীরবতাকে ভেঙ্গে হঠাৎ এই কোলাহল, হৈ চৈ বেশ লাগে। আর তা যদি আবার এক ঝাঁক টিয়া পাখির হুল্লোড় হয়, সেতো ভালো লাগবেই!
শুভ্র এবার ফিরে আসছে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে জঙ্গলের রঙ ও রুপ কেমন বদলে যায়। রৌদ্র-ছায়ায় জঙ্গল অন্যরকম রঙিন হয়ে ওঠে। পাহাড়-জঙ্গলের এই রঙ ও রূপের শোভায় শুভ্র মুগ্ধ হয়ে হাঁটতে শুরু করেছে। এই মুগ্ধতারও কি কোন রঙ হয় !…

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।