গল্প গাথায় সুব্রত সরকার

সুশান্ত

দুটো, চারটে, সাতটা, নটা, বারোটা, সতেরোটা, উনিশটা স্লিপিং পিল হাতের মুঠোয় এখন সুশান্তর। এই নিয়ে চারবার গোনা হল। আজই জীবনের শেষ রাত। নিজেকে শেষ করে দেবে সুশান্ত। এই উনিশটা স্লিপিং পিল খেয়েও যদি না শেষ করতে পারে নিজেকে, সুশান্ত দু’বোতল কেরোসিন তেলও এনে রেখেছে। গায়ে আগুন ধরাতে গিয়ে যদি শেষ পর্যন্ত না পারে, তাহলে হাতের শিরাগুলো কেটে রক্তাক্ত হয়ে মরতে চায় সুশান্ত। তার জন্য বেশ ধারালো একটা ছুরি বালিশের তলায় লুকিয়ে রেখেছে। আরও একটা জিনিস সুশান্ত রেখেছে হাতের কাছে, তা হল শক্ত একগোছা দড়ি। গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়বে। মারবেই আজ ও নিজেকে। আত্মহত্যা করবেই!…
এই জীবন নিয়ে আর বেঁচে থাকার কোনও অর্থই হয় না। বিষাদ, অবসাদ, হতাশা, ক্লান্তি গত তিন-চার মাস ধরে সুশান্তকে গিলে নিয়েছে। সব সময় ওর মনে হয়, আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। কি হবে বেঁচে থেকে? কেন বেঁচে থাকব?
লকডাউন শুরু হতেই সুশান্ত চারশো স্কোয়ার ফিটের এই ভাড়া ফ্ল্যাটটায় বন্দী হয়ে পড়েছে। ফিরে যেতে পারেনি নিজের বাড়ি, জন্মভূমির সেই সবুজ ভূখণ্ডে – উত্তরবঙ্গের অখ্যাত এক গ্রামের ছেলে সুশান্ত। পাহাড়, নদী, চা বাগানে ঘেরা ওর উত্তরবঙ্গ থেকে কলকাতা শহরে চলে এসেছিল কাজের জন্য। চাকরিটা নেহাত মন্দ ছিল না। মাস গেলেই মোটা টাকা ব্যাঙ্কে ট্র্যান্সফার হয় স্যালারি বাবদ। কিন্তু সে অফিস এখন বন্ধ। লকডাউন এর পর প্রথম মাসে স্যালারি কাট হয় থারটি পারসেন্ট। পরের মাসে ফরটি পারসেন্ট। এমাসে কোম্পানির মেসেজ এসেছে আরও কাট হয়ে হবে সিক্সটি পারসেন্ট।
সুশান্ত ছটফট করছে, অসহ্য একটা কষ্ট হচ্ছে ওর। সন্ধে থেকে আর ভালো লাগছে না। দুপুরের খাওয়ারও খায় নি। বিকালের চা খায় নি। অনেক কষ্টে অনেক টাকা বেশি দিয়ে দু’বোতল হুইস্কি কিনেছিল এক সপ্তাহ আগে। তাও আর নেই। এখন কি যে করবে বুঝতে পারছে না। একটু মদ খেতে পারলে যেন ভালো হত। কিন্তু নিজে গিয়ে মদ কিনে এনে খাওয়ার কথা এখন ভাবতেই পারছে না। একটা ফোন করলে ঘরে এসে মাল দিয়ে যাওয়ার মালও আছে। কিন্তু সে মালকে টিপস দিতে হবে! সুশান্ত আবার ভাবল, ধুস মাতাল হয়ে আত্মহত্যা করা যায় নাকি!…
বিকালে মায়ের সাথে শেষ বারের মত ফোনে কথা বলে নিয়েছে। মাকে একদম বুঝতে দেয় নি সুশান্ত ও যে আজ আত্মহত্যা করতে চলেছে। শান্ত ভাবে দাদা, বৌদি, ভাইঝি তোর্সার খবর নিয়েছে। বাড়ির চাষের খবরও নিয়েছে। ধান তোলা হয়ে গেলে জমিতে কি লাগানো হবে তাও জানতে চেয়েছে। মা খুব খুশি হয়েছে তখন ,শহরে চলে গিয়েও সুশান্ত যে এমন জমি, চাষবাস নিয়ে কথা বলে তাতে খুব ভালো লেগেছে মায়ের। মা বারবার বলছিল, “অত বড় শহরে একা থাকিস খুব চিন্তা হয় রে আমার। সাবধানে থাকবি। নিজের খেয়াল রাখবি। খাওয়া দাওয়া করবি ঠিক মত। হ্যাঁ রে, তোর পাইলসের ব্যাথাটা আর হয় না তো? বড় ডাক্তার একবার দেখিয়ে নিস। অপারেশান করাতে হলে করাবি। আমাকে জানাবি, আমি চলে যাব তোর কাছে”।
পাইলসের যন্ত্রণায় সুশান্ত ভুগছে আজ বহুদিন হল। অনেক ওষুধ খেয়েছে। কাজ হয় নি। মাঝে মাঝে ব্যাথা থেমে যায়, রক্ত পড়া বন্ধ হয়। কিন্তু আবার হঠাৎ করে ফিরে আসে লুকিয়ে থাকা এই জটিল ব্যাধি।
সুজাতা খুব বিরক্ত হয় পাইলসের কথাটা শুনলে। সম্পর্কটা তৈরি হওয়ার সময় তো আর কেউ বলে না, আমার পাইলস আছে, আমার হাজা আছে, আমার মুখে গন্ধ আছে, আমার মাইনে এত টাকা!… সম্পর্কটা তৈরি হয় পরস্পর পরস্পরকে ভাললাগা থেকেই। একদিন সুজাতার সাথে সেভাবেই সম্পর্কটা তৈরি হয়েছিল সুশান্তর। বেশ চলছিল বন্ধুত্ব। প্রেম। কফি শপে আড্ডা। সুযোগ পেলেই চুমু খাওয়া। কিন্তু যেদিন প্রথম জানতে পারল সুশান্তর পাইলস আছে, সেদিন থেকেই সুজাতা আশ্চর্য রকম পাল্টে গেল। খালি বলে, ওর এক মামারও আছে এই রোগ। খুব বাজে রোগ। সারাজীবন ভোগাবে।
সুজাতার সাথে সম্পর্কটা কিছুতেই আষ্ঠেপৃষ্ঠে মধুর হল না। ভালোবেসেও ঠিক যেন ভালোবাসা পেল না। তাই এই গভীর হতাশা, গোপন এই মনবেদনা সুশান্তকে ভিতরে ভিতরে তছনছ করে দিয়েছে।
এই আনলক পর্বে এখন যা স্যালারি পাচ্ছে তাতে ফ্ল্যাট ভাড়া, ল্যাপটপের ই এম আই, কাজের মাসির মাইনে, হোম ডেলিভারি খাওয়ারের মাসিক টাকা, বাইকে তেল ভরার পর হাতে আর প্রায় কিছুই থাকছে না। এমাসেও মাকে কোনও টাকা পাঠাতে পারেনি। সুজাতা এটা নিয়েও বলেছে, “কি চাকরি করলে এতদিন, দু’মাস মাইনে কম পেতেই ভিখিরি হয়ে গেলে?” হ্যাঁ সুজাতা ‘ভিখিরি’ কথাটা এমন সহজ ভাবেই বলে সেদিন সুশান্তকে আঘাত দিয়েছিল। সুশান্তও তাই একদিন এই রাগের প্রতিশোধ নিয়েছিল সুযোগ মত পেয়ে প্রায় জোরজবরদস্তি করে ও চুমুর পর চুমু খেয়ে সুজাতাকে রাগিয়ে দিয়েছিল। সুজাতা প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বলেছিল, “ছিঃ। তুমি কি পার্ভাট? এভাবে কেউ অসভ্যতা করে? ছিঃ ছিঃ!..”
সুশান্ত সেদিন মুখ নিচু করে বসেছিল। বলতে পারে নি, “আমার খুব রাগ হয়েছে, আমি খুব অপমানিত হয়েছি তোমার কথায়। তাই ইচ্ছে করেই তোমায় এমন করে আমার রাগের জ্বালা মেটালাম!”s
সুজাতা হারিয়ে যাবেই একদিন। সুশান্ত তার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়েই ছিল। কিন্তু আজ আত্মহত্যা করে ফেলতে পারলেই সুজাতাকে হারাবার এই ভয় জয় হয়ে যাবে সুশান্তর !…
রাত দশটা। একটু একটু করে নিঝুম হয়ে আসছে চারপাশ। সুশান্ত তৈরি হচ্ছে। ঘুমের ওষুধগুলো সাজিয়ে নিল একবার। উনিশটা স্লিপিং পিল হাতের মুঠোয়। বোতল থেকে জল ঢেলে মুখে নিল, কিন্তু পিলগুলো আর মুখে পুড়ে দিতে পারল না। মুঠো থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল ঘরের মেঝেতে। সুশান্ত ভাবল, এভাবে শান্ত সহজ আত্মহত্যা হবে না। বালিশের তলা থেকে ধারালো ছুরিটা বের করল। একবার গলার নলির কাছে নিয়ে গেল। একবার হাতের শিরায় শিরায় বোলাল ধারালো চকচকে ছুরিটাকে। পারছে না সুশান্ত! সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একসময় বীতশ্রদ্ধ হয়ে ধারালো ছুরিটাকে আচমকা গেঁথে ধরলো বালিশটার পেটে, বালিশ ফেঁসে তুলো বেরিয়ে পরল। ফ্যানের হাওয়ায় সাদা তুলোগুলো ঘরময় উড়ে বেরাতে লাগল।
প্রবল ঘেমে গেছে সুশান্ত। কাঁপছে ও তখন। কেমন টলতে টলতে বাথরুমে ঢুকে বেসিনের কল খুলে চোখে মুখে জল দিল। তবু যেন শান্তি পাচ্ছে না। হঠাৎ মনে হল তলপেটটা কামড়াচ্ছে। কমোডে গিয়ে বসে পড়ল। পেট পরিষ্কার করে আজ রক্তহীন পায়খানা হল। সুশান্ত অবাক হয়ে গেল! ফ্লাশ করে চোখে মুখে জল দিয়ে ঘরে এসে বসল। ভালো লাগছে না। কোনওভাবেই শান্তি পাচ্ছে না।
কেরোসিন তেলের বোতলটা বের করলো। কিন্তু দেশলাই বাক্সটা খুঁজে না পেয়ে চিৎকার করে উঠল, “আমার অ্যাটেম্পট টু সুইসাইড সাকসেস হচ্ছে না কেন”?
সুশান্ত ঝর ঝর করে কাঁদছে। নিঃসঙ্গ একাকি মানুষের মত কাঁদছে। রাত এখন গভীর। নিস্তব্ধ শুনশান চারপাশ। সুশান্ত নিজেকে হত্যা করে উঠতে পারে নি। বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। বাইরের বাতাস খুব মনোরম। অশান্ত বিধ্বস্ত শরীরটা জুড়িয়ে আসছে। সুশান্ত ঘর থেকে একটা চেয়ার নিয়ে এসে বসল বারান্দায়।
আকাশে এখন অনেক নক্ষত্র। তারাদের ভিড়ে চাঁদকে কেমন মায়াবি লাগছে। ছোটবেলায় ও তারাদের দিকে চেয়ে থাকতে খুব ভালোবাসত। মহাকাশ, নক্ষত্র এসব ব্যাপারে ভীষণ আগ্রহ ছিল। গ্রামের বাড়ির উঠোনে চাঁদের আলোয় বসে সবাই কি সুন্দর গল্প করত। মা, বাবা, দাদা, দিদি, ঠাকুমা সবার কথা মনে পড়ছে। সেই ছেলেবেলার সুন্দর দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে। বাড়ির কাছে কালজানি নদী। সেই নদীর জলে বন্ধুদের সাথে স্নান করা, জাল ফেলে বোরলি মাছ ধরা, নৌকো করে জোয়ারের জলে ভাসার সব দিনগুলো মনে পড়ছে। জ্যোতির কথা মনে হল হঠাৎ। ওর ছেলেবেলার প্রিয় বন্ধু। জ্যোতি চাকরি করে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে। গত বছর বিয়ে হল জ্যোতির। সুশান্ত প্রিয় বন্ধুর বিয়েতে যেতে পারেনি। খুব কাজের চাপ ছিল অফিসে। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয় জ্যোতির সাথে। জ্যোতি খুব ভাবুক মনের ছেলে। জ্যোতির একটা কথা মনে পড়ল এখন, “জানিস জীবনের সবচেয়ে আনন্দের কি বল তো? বেঁচে থাকা ! আমরা যে এই পৃথিবীতে আছি এটাই একটা পরম পাওয়া। মানব জনম আর কি পাব ফিরে জানি না। তাই একবার যখন পেয়েছি, তখন বেঁচে থাকাটাকে উপভোগ করতেই হবে”।
রাত ফুরিয়ে এসেছে। ঘুম ঘোরে আচ্ছন্ন, ক্লান্ত সুশান্ত কেমন শান্ত হয়ে গেছে। বারান্দায় চুপ করে বসেই আছে। ভোরের আকাশ,বাতাস আজ কি বেশি সুন্দর মনে হচ্ছে সুশান্তর ! পুব আকাশে শুকতারা হাসছে। সুশান্ত শুকতারার হাসি দেখতে দেখতে ভাবল, এবার একটু ঘুমিয়ে নিই। কাল তো অফিস ছুটি। দেরি করেই নয় উঠব।…
ঘুম ভাঙ্গল মোবাইলের আওয়াজে। অরুপের ফোন। অফিস কলিগ অরুপ ফোন করে বলছে, “ফ্রি আছিস এখন”?
“কেন বল তো”?
“যাবি আমাদের সাথে”?
“কোথায়”?
“সুন্দরবনে যাচ্ছি আম্ফান ঝড়ের রিলিফ নিয়ে। হঠাৎ তোর কথা মনে হল, তাই বলছি, যাবি তো চল”।
সুশান্ত অসম্ভব ব্যস্ততায় তৈরি হতে শুরু করেছে। ও অরুপের সাথে যাবে সুন্দরবনে।
অরুপ আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই গাড়ি নিয়ে এসে সুশান্তকে তুলে নেবে।
ফোন আবার বেজে উঠলো। সুজাতার কল। সুশান্ত কলটা না ধরে নিজেকে তৈরি করতে ব্যাস্ত। কলটা কেটে গিয়ে আবার বেজে উঠল। এবার বাদলের ফোন। কলকাতায় এসে মেসে থাকার প্রথম বন্ধু। অনেকদিন পর বাদল ফোন করেছে। সুশান্ত তাড়াহুড়োর মধ্যেই ফোনটা ধরে হেসে বলল, “বল রে…”
“কেমন আছিস তুই”?
“লকডাউনে একদম ঘেঁটে ঘ হয়ে গেছে জীবন”!
“ঠিক বলেছিস। আমারও সেই অবস্থা। এখন কি করছিস”?
“একটু বেরব রে। আমার এক অফিস কলিগের সাথে সুন্দরবনে যাব। ওরা রিলিফের জিনিস নিয়ে যাচ্ছে, তাই আমিও যাচ্ছি ওদের সাথে”
“বাঃ, খুব ভালো তো! শুনেছিস একটা খবর”?
“কি বল তো”?
“একটু আগে সুশান্ত সিং রাজপুত সুইসাইড করেছে”!
“কি বলছিস তুই! ‘কাই পো চে’ র সেই দুরন্ত অভিনেতা সুশান্ত!”
“হ্যাঁ রে, সেই সুশান্ত সিং রাজপুত”!
“কদিন আগেই আমি ল্যাপটপে ওর ‘ছিছোরে’ দেখলাম! ঈশ…”
“আমিও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, ভেরি স্যাড! আমাদের মতোই তো বয়স হবে বল”।
সুশান্ত চুপ। ভাবতেই পারছে না এটা যে একটা সত্যি খবর!
কাল রাতে সুশান্তও ভেবেছিল নিজেকে হত্যা করবেই। অনেক চেষ্টা করেও ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারে নি। অসম্ভব এক কষ্টে, দুঃখে ভয়ংকর রাতটাকে অতিক্রম করে আজ ভোরের শুকতারার কাছে ও জীবন ফিরে পেয়েছে। একটাই তো জীবন। এই পৃথিবীতে আবার আসতে পারব কি না জানি না! তাই আর কোনদিন এভাবে ভাবব না। নিজেকে নিজেই ভালবাসতে শিখতে হবে।
“কি রে কি ভাবছিস”?
“আহারে সুশান্ত চলে গেল এভাবে! বড় কষ্ট হচ্ছে খবরটা জেনে”।
“শোন, রাখছি রে এখন। তোর দেরী হয়ে যাবে। পরে কথা হবে”
সুশান্ত সিং রাজপুত জীবন ছেড়ে চলে গেছে! সুশান্ত রায় বন্ধুর ডাকে এখন যাচ্ছে জীবনের কাছে!…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।