আজকের লেখায় শতদ্রু ঋক সেন

আজ প্রতিপদ।দেবীপক্ষের প্রথম দিন। পুজো তো এসেই গেলো প্রায়। করোনা গ্রাস কবলিত পৃথিবীর বুকে,এক চিলতে রৌদ্রের মতো, মায়ের বাড়ি আসা। কয়েকটি কাজ সেরে একটু আগে বাড়ি ফিরছিলাম,দেখলাম অনেক জায়গা আলোর সাজে সজ্জিত হয়েছে।অন্যবার এর মতো ভিড় না হলেও বেশ কয়েকজন জটলা করছে, এমন অনেক জায়গায় দেখলাম। আমার যেখানে বাড়ি,সেই কালীঘাট পটুয়াপাড়াও দেখলাম শেষ কয়েকমাসের গ্লানি কাটিয়ে অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে।বড়ো প্রতিমা না থাকলেও ছোটো ও মাঝারি প্রতিমা ঘিরে শেষ মুহূর্তের কর্মব্যস্ততা।কিন্তু ওরা কোথায়?যাদের উপস্থিতি এই সময় পটুয়াপাড়া কে সরগরম করে তোলে? যারা সেই শিশুকাল থেকে আমার মধ্যে গ্রাম সম্বন্ধে আগ্রহ জাগিয়েছে?এবার কি ওরা আসবেনা?
ওরা অর্থাৎ, গ্রামের চাষী, বা দিনমজুর শ্রেনীর লোক। প্রতি বছর পুজোর আগে ওরা ভিড় করে আসে পটুয়াপাড়া আর কুমোরটুলি তে। এ গলি, সে গলির মধ্যে আস্তানা গেড়ে থাকে। ওদের কাজ হলো বড়ো বড়ো প্রতিমা লরি তে তুলে দেওয়া নির্মাণস্থল থেকে বয়ে নিয়ে গিয়ে। কেউ কেউ আবার লরি করে উজিয়ে গিয়ে প্যান্ডেলেও মূর্তি বসিয়ে দিয়ে আসে। এই কাজে মজুরি খুব বেশি না হলেও পদে পদে গালি গালাজ অসম্মানের হাতছানি। কোনোভাবে মূর্তির গায়ে খোঁচা লেগে গেলে পটুয়া থেকে কর্মকর্তা সবাই ওদের দোষ দেন। এছাড়াও পাপের ভয় তো আছেই। তবুও ওরা আসে। উপরির এই সামান্য টাকায় বিজয়া দশমীর মেলা থেকে কেনে বৌয়ের জন্য সস্তা গয়না, বা ছেলে মেয়ের খেলনা সামগ্রী। ঐটুকুতেই তাদের পরিতৃপ্তি। দশমীর মেলা শেষে যখন বৌ ছেলেমেয়েদের হাত ধরে যে যার ঘরে ফেরে, তখন ঘরের লোকেদের হাসি মুখ দেখে তারা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানায়, মনে মনে বলে, আসছে বছর আবার হবে।
ছোটো থেকেই এদের সাথে আমার বন্ধুত্ব। দিনের পড়া শেষ করে আমাদের গলির মধ্যে এদের সঙ্গে আড্ডা জমাতুম। আজন্ম শহুরে পরিবেশে বড়ো হয়ে ওঠা আমার সাথে গ্রামের মাটির দাওয়া, কয়লার উনুন, মাঠ ঘাট আলেয়া সবকিছুর সাথে পরিচয় করিয়েছিল ওরাই, গল্পের মাধ্যমে। ওদের কোনো জাত ধর্ম ছিলো না, একই প্রতিমার চালিকে গাড়িতে তুলতে দেখেছি রফিক আর পরেশ কে। তখন অবশ্য আমি এসব বুঝতাম ও না, ওদের ও যে এসব ব্যাপারে কোনো হেলদোল ছিলো না, সেটা ওদের গলাগলির ছবি মনে করলে এখন বেশ বুঝতে পারি।ওরা এই সময় দিন রাত খাটতো,তারপর কাছের কোনো সস্তা হোটেলে খেয়ে নিয়ে তাস খেলতো, নিজেদের মধ্যে আবার কখনো আমার সাথে গল্প জুড়তো।কেউ কেউ কাজ শেষে বাঁশি বাজাতো,আমি একাত্ম হয়ে শুনতাম। প্রতি বার যাবার আগে আমাকে বলে যেতো তাদের বাড়িতে যাবার জন্য, আমি ঘাড় হেলাতাম, যদিও যাওয়া হতো না কখনোই। তবু মনে মনে কল্পনা করতাম, সবুজ মাঠ ও ধানখেতের মাঝে রাঙা মাটির রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছে গেছি ওদের উঠানে। তারপর মাটির তকতকে দাওয়ায় বসে মুড়ি, গুড় ও কুয়োর ঠান্ডা জল দিয়ে জলযোগ সেরে গল্প জমিয়েছি সবার সাথে। কিন্তু কিছু কল্পনা যেমন কখনোই বাস্তবে হয় না, কিন্তু মনের মাঝে রয়ে যায়, এটিও ছিলো সেরকম একটি।তবু এই কল্পনা কে সাথে করে অপেক্ষা করতাম পরের বছর এই বন্ধুদের দেখা পাবার আশায়।এরকম প্রতি বছর কেউ না কেউ আসতো, তাদের সাথে মিলে মিশে বড়ো হয়ে উঠলাম আমি।
গতবছর অবধিও ওদের আসতে দেখেছি। কিন্তু আজ প্রতিপদের দিনেও ওদের দেখা আমি পাই নি।একে তো বড়ো ঠাকুর নেই, তায় এবার ট্রেন ও বন্ধ।আসবে কি করে ওরা? আমার জানালার পাশের শূন্য গলি, যেখানে ওরা প্রতি বছর এসে থাকে,নীরবে ওদের আশা কামনা করছে সেও। তবু মা আসবেন। আমরা সবাই মিলে প্রার্থনা করি, যাতে সামনের বার আবার সব ঠিক হয়ে যায়, সবাই যেন সমানভাবে মা কে নিয়ে আনন্দে মেতে উঠতে পারে।
মা নিশ্চয়ই আমাদের প্রার্থনা শুনবেন।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।