• Uncategorized
  • 0

গদ্যানুশীলনে শম্পা সাহা

খিদে

সামনে ভোট, সব রাজনৈতিক দলই ভীষণ ব্যস্ত তাদের পার্টির প্রচারে। নাওয়া খাওয়া ভুলে কালু, হ্যাবল, ঘোঁতন অমুক দা, তমুক দার পিছনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটাই তো করে কম্মে খাওয়ার সময়! এই যে সারা বছর ধরে ওরা ওদের পেট চালায়, সে তো এই দাদাদেরই জন্য। এনারা ক্ষমতায় না থাকলে যে এদের কারো পিঠের চামড়া আস্ত থাকবে না, সে ওরা ভালোই জানে।তাই তো ওরা এই ভোটের সময় জান লড়িয়ে দেয়। এই পাঁচ বছরে এক বার ইনভেস্টমেন্ট, তার পর পাঁচ পাঁচটি বছরের জন্য নিশ্চিন্দি।
শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত চারিদিক, ঝান্ডা, মিটিং, মিছিলে বাজার একেবারে সরগরম । রাস্তা ঘাট প্রায় সময়ই থমথমে, কখনো হাতকাটা লালু বোমা ফেলছে কানকাটা ভুলোর দলের উপর আবার কখনো কালুয়া বেধড়ক পিটিয়ে দিল অপর পক্ষের নাটুয়া কে। এই রঙ্গে বঙ্গ বাজার একেবারে হাউসফুল।
মানিকতলা বাজার, ঘিঞ্জি বস্তি, এরই এক খুপরিতে নেপাল আর তার পরিবারের বাস। ঘর নয়,কর্পোরেশনের জায়গায় কটা বাঁশ আর কালো প্লাস্টিক, দু একটা ইট দিয়ে ওদের আস্তানা। জল কল বলতে বারোয়ারি টাইমকল,আর প্রাতঃকালীন নিত্যকর্ম সারার জন্য ভরসা রাস্তার পাশের সরকারি সুলভ কমপ্লেক্স।
ঐ খুপরির বাসিন্দা নেপাল, তার বৌ কাকলী, দুই ছেলে, ঘন্টু আর মন্টু। ভালো নাম হয়তো আছে কিন্তু সে আর কে জানে?
আগে ওরা গোসাবা না বাসন্তী কোথায় একটা যেন থাকতো। আইলাতে সব ভেসে গেলে, গ্রামের আর দুএকজনের সঙ্গে নেপালও তার পরিবার নিয়ে কলকাতার বাসিন্দা।
এখানে এসে মোট বয়ে, কাকলী দু বাড়ি কাজ করে মন্দ ছিল না, কিন্তু সব গোলমাল হলো করোণা এসে। মোট বওয়া বন্ধ, কাকলী কেও কাজের বাড়ি থেকে ছাড়িয়ে দিল।ব্যস ছেলেপিলে নিয়ে একেবারে না খেয়ে মরার সামিল! তবু ভাগ্যিস বাবুরা এসে পাড়ায় পাড়ায় লঙ্গর খুলেছিল, তাই সেখানে কিছুদিন চলল। সরকার থেকে নাকি চাল, ডাল কি সব দিয়েছিল! কিন্তু ওদের তো রেশন কার্ড ও নেই! ছিল ঐ গোসাবায় , আইলা শুধু যে ওদের ঘর কেড়েছে তা নয়, সে মানুষ গুলোর মানুষ হবার অধিকার ও কেড়ে নিয়েছে।
কোনো রকমে লকডাউনটা উঠতেই আবার শিয়ালদহ মার্কেটের আশেপাশে ঘোরা শুরু নেপালের। মাল বয়ে, কুলি মজুরি করে আবার জোড়াতালি দিয়ে সংসার শুরু কাকলী নেপালের। যদিও বেশ প্রতিযোগিতা কারণ জবলেস, মানে সোজা বাংলায় যাকে বলে বেকার তার সংখ্যা বেড়ে গেল এক ধাক্কায় অনেক গুণ। যে অর্থনৈতিক মন্দা সাড়া বিশ্ব কে মাটিতে পেড়ে ফেলেছে তাতে এই সব গরীব গুর্বো মানুষ গুলোর যে নাভিশ্বাস উঠবে তাতে আর আশ্চর্য কি!
সেদিন সকাল সকাল, নেপাল পেঁয়াজ পান্তা খেয়ে কাজে বেরোয়। সেদিন কোন একটা পার্টির নাকি বিরাট মিছিল,তাই সকাল সকাল কাজে বেরোয়,যত তাড়াতাড়ি কিছু রোজগার পরের দিনের জন্য।
কাকলীকে আর ওর মণিব কাজে ফিরিয়ে নেয় নি, এখনো নাকি করোণা পুরোপুরি কমে নি, তাই ওরা আর লোক রাখবে না! কাকলী একবার তবু বলেছিল, “বৌদি, আমি ঘরে ঢুকবো না, শুধু বাইরের কাজটুকু না হয়…. “, ওর কথা শেষ হবার আগেই বৌদি মুখ ঝামটা দেয়, ” না, না, আমাদের লাগবে না”, ব্যস। ও খানেই সব কথা বার্তা শেষ। কাকলীর কথা শোনার আর দরকার নেই কাকলীর বৌদির।
কাকলী তারপর থেকে কাগজ কুড়ানি।নেপাল বেরোলেই ও নিজে দুমুঠো পেটে দেয় আর ছেলেদের ও, তারপর একটা বড় থলে কাঁধে বের হয়। যত রাজ্যের নোংরা প্লাস্টিক, কাগজ, কাঁচের বোতল, পেরেক, লোহার টুকরো ঐ বড় বস্তাটায় ভরে দিয়ে আসে ভাঙাচোরার দোকানে।যা কুড়ি তিরিশ টাকা আসে, কপাল ভালো থাকলে পেয়ে যায় ফেলে যাওয়া মদের বোতল, কোনও পিকনিক পার্টির।সেদিন কিছু বেশি জোটে।
আজকাল ঘন্টু মন্টুও যায় মায়ের সঙ্গে। ওরাও কুড়ায় ছেঁড়া, নোংরা কাগজ, ন্যাকড়া, প্লাস্টিক। ওদের সঙ্গের ছোট ছোট থলেও ভরে ওঠে রাজ্যের আবর্জনায়, যা ওদের বর্তমান রুটি রুজি।এতে করে যা দু পয়সা বেশি আসে তাই ভালো।
তবে সমস্যা যে হয় না তা নয়। এই তো কদিন আগে একটা কাঁচের টুকরো মন্টুর পায়ে ঢুকে রক্তারক্তি কান্ড। কি ব্যথা কি ব্যথা! ফুলেও ছিল বেশ, শেষে হসপিটালে গিয়ে ওষুধ ইঞ্জেকশন করে সারে। তবে কম ধকল পোহাতে হয়নি কাকলী কে। নেপাল ও বেচারা ছেলের পেছনে কত রাত জেগেছে!একে সারা দিন মাল বওয়া তার ওপর রাত জাগা, তবু সন্তান বলে কথা, বুক তো পোড়ে!
এভাবেই জড়িয়ে গড়িয়ে চলে যাচ্ছিল। সন্ধ্যা বেলা সবাই একসাথে ফিরে বেশ আনন্দ। কাকলী তিনটে ইট পেতে ভাঙা কালি পড়া হাঁড়িতে ভাত ফুটিয়ে লঙ্কা পোড়া, নুন, আলু সেদ্ধ আর কাঁচা তেল। এক একদিন ডিম ও থাকে।খেয়ে দেয়ে ক্লান্তির ঘুম। এভাবেই চলছিল ওদের ফুটপাতের সংসার। হোক ফুটপাত তবু তো সংসার।
ওদের বংশ পরিচয় ওরা দেখাতে পারবে না, হয়তো নেপাল বাবার নাম ছাড়া, পরিচয় হিসাবে বলতে পারবে না কিছু ই, যদিও ওদের জীবন তথাকথিত মানুষের জীবন নয়, যদিও টাটা বিড়লাদের ছেলেদের চাহিদা আর ওদের চাহিদা মেলানো হাস্যকর, হয়তো ওদের ভদ্রলোকের ভাষায় মানুষ ও বলে না, কিন্তু ওদের ও দুঃখ আছে, রাগ আছে, অভিমান আছে পশুদের মত খিদে ঘুম মৈথুন ছাড়াও। যতই ওদের তথাকথিত এলিট শ্রেণী ছোটলোক বলুক, যতই তথাকথিত জনদরদী সরকার ওদের অনুপ্রবেশকারীর তকমা দিক ওরা যে মানুষ, আর সবার মতই মানুষ। সমাজ যাদের মুছে দিতে চাইলেও মোছা যায় না, ওরা যে সব সব জায়গায়!
সেদিন সকালটাও আর পাঁচটা দিনের মতই। তবে যেহেতু মিছিল তাড়াতাড়ি বেরিয়ে ছিল নেপাল । সবে মাত্র দুপুর দেড়টা, কয়েক ক্ষেপ মাল তুলে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল । হাতের গামছাটায় বার কয়েক ঘাম মুছে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাওয়া খাচ্ছিল, এই মাঘের শেষ তবু পরিশ্রমের ঘাম বিন্দু বিন্দু নেপালের কপালে।
মিছিলটা মৌলালী হয়ে এগিয়ে আসছিল বেশ ধীরে, শ্লোগানে শ্লোগানে যেন কেঁপে উঠছিল চারি দিক। নেপাল কৌতুহলী চোখে দেখে, বেশ ভদ্দরলোক আছে কজন তবে তারা শুধু সামনে আর মিছিলের পিছনে সব নেপালেরই মত, গাল তোবড়ানো, কন্ঠার হাড় বের করা। নেপাল জানে ওরা কলকাতা দেখবে আজ, “বিরানি” পাবে এক প্লেট, সঙ্গে পঞ্চাশ টা টাকা। আর “ফিরিতে” বাসে বা লড়িতে চেপে ফিরে যাওয়া যার যার ঠিকানায়।আগে গাঁয়ে থাকতে ও ক’বার নিজেও এসেছে।
প্রথম মিছিলটা চলে যাবার পর আবার শিয়ালদহ বাজার মেরুদণ্ড সোজা করছে কাজে ফিরবে বলে, দূর থেকে চলে যাওয়া ঝান্ডা তখনো দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। আবার একটা শ্লোগানের গুঞ্জন, আবার চারিদিক কাঁপিয়ে অন্য একটা রং এর ঝান্ডা হাতে সমর্থক। নেপাল অবাক হয়ে দেখে এই মিছিলটাও একেবারে আগের মিছিলটার মত, সামনে বড়লোক, পেছনে ওদের মত গরীব গুর্বো রা। শুধু ঝান্ডার রং আলাদা। নেপাল ভাবে সবই যদি একধরনের মানুষ তবে ঝান্ডা আলাদা কেন? বক্তব্য ও তো সবারই এক, “জবাব চাই, জবাব দাও, মানছি না, মানবো না,”, সব সব এক তাহলে ঝান্ডার রং কেন আলাদা?
মিছিলটা সবে হাসপাতাল টার সামনে, ডানদিকে বেঁকে, হঠাৎই একটা ভারী শোরগোল, চিৎকার, চেঁচামেচি, হৈ হুল্লোড়, দৌড়াদৌড়ি।প্রচন্ড জোরে শব্দ, বোম পড়লো। কারা যেন মারামারি লাগিয়েছে ! ইট, সোডার বোতল, কাঁচ, লাঠি, সব মিলিয়ে এক ধুন্ধুমার অবস্থা। দিশেহারা নেপাল, কাঁধের বস্তাটা নামিয়ে আগলে রাখতে যায়, এ অবস্থায় আর যাওয়া যাবে না, কিন্তু মাল তো বাঁচাতে হবে?
দিকবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে ছুটছে সবাই, নীচু হয়ে বস্তাটা রাখছে নেপাল, সামনেই ধস্তাধস্তির মধ্যে হঠাৎই দুম, তীব্র শব্দে কানে তালা লেগে যায়, নেপালের আর কিছু মনে নেই, চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা শুধু মাথায় তীব্র একটা যন্ত্রণা।
নেপাল আর আসে না ফিরে, রাত গড়িয়ে পরদিন ভোর। কাকলী পাগলের মত গফুর চাচা, নেতাই দা, ফাজিল ভাই সবার কাছেই ছোটে। সেদিন ঘন্টু মন্টুর রাতের সেদ্ধ ভাত ও বন্ধ। বাবা আসে নি, মা কাঁদছে, ওদেরও ভীষণ ভীষণ কষ্ট হচ্ছে কিন্তু খিদে যে পেটে মোচড় দিচ্ছে, সে ব্যথা যে ওদের জন্য আরো কষ্টের ,খুবই কষ্টকর।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।