সাপ্তাহিক অণু উপন্যাসে সুব্রত সরকার (পর্ব – ১)

বনবাসের বর্ণমালা

লালিগুরাসের এই ঝুল বারান্দাটার মায়া আজ ত্যাগ করে চলে যেতে হবে শুভ্রকে!
পাহাড়চূড়ায় শান্ত নির্জন গ্রাম সোনাখাঁ। আরও নির্জন হল এই লালিগুরাস হোম স্টে।
নেপালি ও ডুকপাদের আটটা পরিবার নিয়ে গড়ে উঠেছে সোনাখাঁ। হোম স্টে এখানে এই একটাই। নেপালি যুবক সুদেব ছেত্রি নিজের বাড়ির দুটো ঘরকে সুন্দর সাজিয়ে গুছিয়ে কাঠের একটা লম্বা ঝুল বারান্দা বানিয়ে অপরূপ করে তুলেছে লালিগুরাসকে।
ভোরের প্রথম আলো এসে লুটিয়ে পড়ে লালিগুরাসের লম্বা ঝুল বারান্দাটায়। শুভ্র গত চারদিনই এই নরম আলোয় বারান্দায় বসে নির্জন সোনাখাঁকে প্রাণভরে উপভোগ করেছে।
পুব আকাশে রক্তিম হয়ে যখন সূর্য ওঠে, সে সময় দূরের পাহাড়ি নদী লালপানি রঙের খেলায় বড় সুন্দর হয়ে ওঠে। সোনাখাঁর চারপাশে চারটে নদী। সোনাখাঁর হিলটপ থেকে চারটে নদীকেই দেখা যায়। পুবে লালপানি, পশ্চিমে পাগলা খোলা, উত্তরে চুইচুই, দক্ষিণে পাথরচাটা।
সূর্যাস্তের মায়াবি আলোয় পাগলা খোলাকেও মুগ্ধ হয়ে দেখতে হয়। শুভ্র এই পাগলা খোলার জলে একদিন হাতির পাল দেখতে পেয়েছে। লালিগুরাসের সুদেব সেদিন সন্ধে নামার মুখে দূরের পাগলা খোলার দিকে চেয়ে হঠাৎ বলে উঠেছিল, “দাদা, দাদা ঐ দেখো হাতিরা জল খেতে এসেছে নদীতে।”
শুভ্র বারান্দায় বসে স্কেচ করছিল খাতায়। হাতির কথা শুনে ও চমকে উঠে তাকিয়ে দেখে বহুদূরের পাগলা খোলার জলে হাতির পাল শুঁড় ডুবিয়ে ডুবিয়ে জলখেলা করছে। জল খাচ্ছে। সুদেব ছুটে গিয়ে বাইনোকুলার এনে শুভ্রর চোখের সামনে ধরে বলল, “ভালো করে দেখো দাদা, কটা হাতি আছে সব গুনে বলতে পারবে।”
বাইনোকুলারটা খুব ভালো। একদম স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে হাতির পালকে। শুভ্র একটা একটা করে গুনে বলল, “সুদেব, আটটা বড় হাতি, আর দুটো ছোট হাতি দেখতে পাচ্ছি এই দলে। একটা হাতির আবার লম্বা দাঁত।” একসাথে দশটা বুনো হাতির জল খাওয়ার দৃশ্য দেখে শুভ্র মোহিত হয়ে গিয়েছিল!
গাছের পাতায় পাতায় সকালের ঝলমলে রোদ্দুর। একটু দূরে একটা ঝাঁকড়া চিলৌনি গাছ। সুদেব বলেছিল, জঙ্গলের এই চিলৌনি গাছকে ওরা বলে কুকাঠ। জ্বালানি ছাড়া আর কোনও কাজে লাগে না এই গাছের ডালপালা। সেই চিলৌনি গাছের ডালে দুটো নাম না জানা পাখি এসে বসল। ডালে বসেই দুটোতে খুব খুনসুটি জুড়ে দিল। বেশ লাগছে নির্জন শান্ত সকালে দুটো পাখির ঠোঁটে ঠোঁটে ঠোকরানো আর খুনসুটিপনা দেখতে। শুভ্র মনে মনে ভাবছে, পাখিদের রাজ্যে এরা দুটো নিশ্চয়ই প্রেমিক প্রেমিকা ! ওরা কি সুন্দর এমন একটা সকালে প্রেমের খেলায় মেতে উঠে প্রকৃতিকে আরও সুন্দর করে তুলেছে!
সুদেব বড় এক কাপ চা দিয়ে বলে গেল, “দাদা, নাস্তা বানাচ্ছি। নাস্তা খেয়ে যাবে।”
শুভ্র সকালের প্রথম চা টা হাতে নিয়ে বলল, “নীচে নেমে গিয়েই তো নাস্তা করলে ভালো হোত। ভিক্টোরিয়ার মোমো খেতাম।”
সোনাখাঁ থেকে দু’কিমি নীচে নেমেই পড়বে পাহাড়ি ছোট্ট গ্রাম মনমাতিয়া। সত্যিই এ গ্রাম দেখলে মন মেতে যায়। মাত্র চারটে পাহাড়ি পরিবার নিয়ে আঁকা ছবির মত মন মাতানো গ্রাম মনমাতিয়া। এই গ্রামেই রয়েছে ঘর লাগোয়া একমাত্র দোকান, মোমো থেকে মোমবাতি সব পাওয়া যায়। মালকিন ডুকপা সুন্দরী ভিক্টোরিয়া ডুকপা। ফর্সা হাসিমুখি এই ভিক্টোরিয়ার মোমো চারদিন আগে ট্রেক করে সোনাখাঁয় ওঠার সময় খেয়েছিল শুভ্র। এত সুন্দর ভেজ মোমো সেদিন ভিক্টোরিয়া ওকে খাইয়েছিল যে শুভ্র তার স্বাদ ভুলতে পারে নি। সেদিনই হাসতে হাসতে শুভ্র বলেছিল, “আমি চারদিন পর এই পথ দিয়েই ফিরব। সেদিন আবার মোমো খেয়ে যাব।”
ভিক্টোরিয়া দারুণ খুশি হয়ে হেসে বলেছিল, “থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। আমি সেদিন আউর আচ্ছাসে বনায়ে দিব।”
শুভ্র চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। বেশ সুগন্ধী লিকার চা। সুদেব সেবাযত্নে খুবই পর্যটন বান্ধব। রুচিও তারিফ করার মত। হাতের রান্নায় খুশবু ছড়ায় দারুণ। স্কোয়াশ কোনওদিন শুভ্র পছন্দ করত না। কিন্তু সোনাখাঁয় এসে সুদেবের হাতে আলু-স্কোয়াশের তরকারি খেয়ে শুভ্র এখন স্কোয়াশ বিলাসী!
লালিগুরাসের খুব কাছে এক টুকরো সবুজ সমতলে একটা ছোট্ট গুম্ফা আছে। প্রাচীন এই গুম্ফায় এখানকার মানুষরা প্রার্থনা করে। গুম্ফার চারপাশে ধর্মপতাকা, লুংদার হাওয়ায় হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে। শুভ্র তাকিয়ে আছে সেই ধর্মপতাকাগুলোর দিকে। এই সব পতাকায় বৌদ্ধ ধর্মের কত উপদেশ, বাণী রয়েছে।
রঙ বেরঙের এই পতাকাগুলো সহ গুম্ফার একটা স্কেচ করেছিল শুভ্র, সেটা সুদেবের এত পছন্দ হয়েছিল যে শুভ্র উপহার হিসাবে তখনই সুদেবকে দিয়ে দেয়। সুদেব অপ্রত্যাশিত সেই উপহার পেয়ে কি খুশি যে হয়েছিল, ওর চোখে মুখে আলোর ছটা দেখে শুভ্র তা বুঝতে পেরেছিল।
সোনাখাঁ থেকে নেমে রাইবস্তিতে শুভ্র থামবে। দুপুরের খাওয়া আজ রাইবস্তির হরিশংকর থাপার হোম স্টেতে। কলকাতা থেকে দশ দিন আগে বেরিয়ে শুভ্র প্রথম এসে উঠেছিল রাইবস্তিতে। হরিশংকরের কাছে তিনদিন ছিল। মূল লাগেজ ওর জিম্মায় রেখে শুভ্র উঠে এসেছিল আরও উঁচুতে এই সোনাখাঁয়।
হরিশংকরের কাছে দুপুরে খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে মূল লাগেজ সহ একদম নীচে নেমে যাবে ফুলবস্তিতে। আজ হাট আছে ফুলবস্তিতে। হাট ঘুরে, দেখে একটু আড়াল খুঁজে কোথাও বসে দু’একটা পেন্সিল স্কেচ করবে। তারপর চা খেয়ে চারটের সওয়ারি জিপে সোজা মদনপুর হয়ে দরিয়াদুয়ার জংশন। ট্রেন বিকাল পাঁচটা পাঁচে। রিজার্ভেশন করা আছে। কাল সকালে পৌঁছে যাবে নিজের শহর কলকাতাতে!
আজ আলু পরোটা আর ঘরে বানানো আচার দিয়ে নাস্তা সাজিয়েছে সুদেব। সঙ্গে ডিমের অমলেট ও নুন চা। সুদেবের নিমক চা কদিন ধরে খেয়ে শুভ্রর বেশ লেগেছে। পাহাড়ি মানুষরা নুন চা খুব পছন্দ করে। শুভ্র পাহাড়ে এসে পাহাড়ের এই নুন চা খেয়ে ওঁদের সাথে বেশ একাত্ম হয়েছিল কটাদিন।
শুভ্র নাস্তা খেতে খেতে সুদেবের সাথে শেষ সময়ের টুকিটাকি গল্প করছে। আর একটু পরেই বিদায় নিয়ে চলে যেতে হবে। বিষণ্ণতা কথায় গল্পে জড়িয়ে যাচ্ছে। সুদেব বলল, “দাদা, আমাদের গাঁও আচ্ছা লেগেছে তো? কোনও পরিশানি হয় নি তো!”
শুভ্র অমলেট কাটতে কাটতে বলল, “খুব ভালো লেগেছে সোনাখাঁ। আবার আসব। এবার তো ঐ ন্যাড়া পাহাড়ে যেতে পারলাম না। চুইচুই নদীর জলে চান করা হল না। পরের বার যাব ওসব জায়গায়।”
“আসবেন দাদা। আমি আপনাকে আরও ঘুরিয়ে দিব। গভীর জঙ্গলে নিয়ে যাব। হাতির ডেরা দিখাব। হর্নবিল দিখাব। ডিম দিখাব ময়ূরের!”
শুভ্র ছোট্ট লাগেজটা গুছিয়ে পিঠে বেঁধে নেওয়ার আগে সুদেবের মুখোমুখি হয়ে বলল, “বেশ। এবার যাই তাহলে।”
সুদেব নীরব। শুভ্র ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আবার আসব। দেখা হবে। ভালো থেকো।”
লালিগুরাসের লম্বা বারান্দাটা হেঁটে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এল শুভ্র। পিছনে পিছনে এল সুদেব। করমর্দন সেরে হাঁটা শুরু করার সময় সুদেব হাসিমুখে বলল, “গুডবাই দাদা। আবার আসবেন।”

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।