‘কফি পাহাড়ের রাজা’ সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে তুষ্টি ভট্টাচার্য (পর্ব – ৩ ।। খন্ড – ১৬)

কফি পাহাড়ের রাজা

তৃতীয় পর্ব:

১৬)
আগুন লাগার আগেই বোধহয় তার গন্ধ ছড়াতে শুরু করে। পশুপাখিরা তো পায়ই। বিপদের গন্ধ আগে থেকে পেয়ে ওরা সতর্ক হয়, অন্যদের সতর্ক করে। আর মানুষও নিশ্চই পায় বা পেত একসময়ে। পৃথিবীর তাবৎ প্রাণীকুলের মধ্যেই যেহেতু তারা পড়ে। কিন্তু নিজেরাই কৃত্রিমতার জেরে সেই বোধ হারিয়েছে বোধহয়। কুগান পেয়েছিল সেভাবেই। জঙ্গলের বাঁদরগুলোর ত্রস্ত লাফালাফি আর ডাকাডাকি, হরিণ জাতীয় প্রাণীদের ঊর্ধ্বশ্বাস ছুটে যাওয়া দেখে পাহাড়ের বাসিন্দারা আঁচ পেয়েছিল কিছুটা। প্রায় প্রতি বছরের মতো এবারেও বোধহয় নিস্তার পাওয়া গেল না। রাতে আতঙ্ক নিয়ে শুতে গেছিল কোরাবারা। কুগান একবার মাঝরাতে বাইরে বেড়িয়ে চোখ বুলিয়ে এসেছিল আকাশের দিকে। নাহ! কোথাও কিছু নেই। পরিষ্কার আকাশে তারাদের আলোয় জ্বলজ্বল করছে চারপাশ। আর বিদ্যার ঘরে তখনও আলো জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। কী আশ্বাস দেবে বিদ্যাকে কুগান? তার নিজেরই সীমিত ক্ষমতা। মানসিক স্থিতি নেই যার নিজেরই, সে কী করে অন্যকে ভরসা দেবে? ঘুমোতে চলে গেল কুগান আর দেরি না করে।
গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন অবস্থায় কুগানের মনে হল কে যেন ডাকছে ওকে ওর নাম ধরে, জোরে জোরে। স্বপ্নের ঘোর ভেবে পাশ ফিরে শুতে যাচ্ছিল কুগান। হঠাতই যেন এক তীব্র চিৎকারে ঘুম ফালা ফালা হয়ে গেল ওর। খুব কষ্টে চোখ খুলে দেখে, সামনে এক নারীর অবয়ব। চোখ টেনে খুলল কুগান। এবার চিনতে পারল। সামনে ভয়ার্ত বিদ্যা দাঁড়িয়ে। ওর মুখেচোখে আতঙ্ক, ত্রাস। ধড়মড় করে উঠে বসল কুগান। বিদ্যা শুধু এটুকু বলতে পারল—আগুন! ছুটে বাইরে বেরল কুগান। আবছা আলো ফুটেছে আকাশে। সেই আলোকে ছাপিয়ে আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে লেলিহান শিখা। কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী একেকবার ঢেকে দিচ্ছে লাল আলোকে, পরক্ষণেই আগুন ফুঁসে উঠে ধঁয়াকে ম্লান করে দিচ্ছে আবারও। এইরকম মুহূর্তে, এই ভয়ানক সুন্দরের কাছে মানুষ কেমন অসহায় হয়ে পড়ে আর তার শিকার হয়ে যায়। কিংকর্ত্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কুগান আকাশের দিকে তাকিয়ে। আবার সম্বিত ফিরল বিদ্যার চিৎকারে। জলের ব্যবস্থা কর শিগগিরি। লোকজনদের ডেকে তোল, জাগিয়ে দাও সবাইকে। দুজনে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটল এবার।
কাউকে জাগাতে হয় না বিপদের দিনে। বিপদের আঁচে গা সেঁকে নিচ্ছে আক্ষরিক ভাবে মানুষ। তবে জঙ্গলের একটা অংশে আগুন লেগেছে, এদিকে এগিয়ে আসেনি এখনও, এই যা। কিন্তু জঙ্গলের যেটুকু পুড়ে যাচ্ছে, বাকিটুকু তো বাঁচাতে হবে তাদেরই। ধীরে ধীরে রোদের তেজ বেড়েছে। সঙ্গে বাইরের লোকজনের আনাগোনাও। মিডিয়ার লোকজন আসছে একে একে। পুলিশ, দমকল, সবাই হাজির। সবাইকে জঙ্গলে যেতে বারণ করা হচ্ছে। যদিও স্পষ্টভাবে জঙ্গলকে বাঁচানোর উপায় কারুরই জানা নেই। জল স্প্রে চালু করেছে দমকল বিভাগ। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি। শুকনো জঙ্গল কেটে ফেলতে হবে মাঝখান থেকে। ফাঁকা করে দিতে হবে একটা অঞ্চল, যাতে আগুন না ছড়ায়। বিদ্যা আর কুগান শুকনো মুখে বাগানের দিকে গেল। দলে দলে আতঙ্কিত লোকের জটলা চারিদিকে। পোড়া জঙ্গলের গন্ধে ছেয়ে আছে চারিদিক। বাগানের কাজ তো বন্ধই রয়েছে সাময়িক, তবু লোকেরা এসেছে, কিছুটা উৎকণ্ঠায় কিছুটা বা কৌতূহলে।
বিপদের গন্ধ মুরুগানের নাকেও এসেছিল। কাগজ খুলেই চোখে পড়ল আগুনের খবর। হৃদপিণ্ড লাফ দিয়ে গলায় উঠে এলো ওর। কী করবে বুঝে উঠতে পারল না সেই মুহূর্তে। নিজেই বা কী করবে বা করছে, সচেতনে খেয়াল রইল না। আশেপাশের লোকেরা দেখল জন নামের কনফেকশনারির লোকটা সাতসকালে পড়িমরি করে বড় রাস্তার দিকে এগোচ্ছে। প্রায় ঘন্টাখানেক বাদে মুরুগান বুঝলো, ও একটা গাড়ি ভাড়া করে পাহাড়ের দিকে চলেছে। পকেট হাতড়ে দেখল, মানিব্যাগ এনেছে। অল্প কিছু টাকা তাতে, আর ফ্ল্যাটের চাবিটা অবশ্য আছে ওখানে। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, ‘আর কতক্ষণ লাগবে পৌঁছতে?’ ড্রাইভার উত্তর দিল দুঘন্টা তো বটেই। মুরুগান খুব ভালো করে জানে, এখন রাস্তা ফাঁকা রয়েছে। এভাবে গেলে দুঘন্টারও কমে ও পৌঁছে যাবে। কিন্তু ট্র্যাফিক বাড়লে সেটা তিন ঘন্টাও লেগে যেতে পারে। কিছুক্ষণ বাদেই বেলা চড়তে না চড়তে একের পর এক প্রেসের গাড়ি, পুলিশের হুটার লাগানো গাড়ি, মন্ত্রী, আমলাদের গাড়ির ভিড় বাড়ল রাস্তায়। ফলে তার গাড়িকে সাইড দিতে হচ্ছিল বারবার। আর দেরিও হচ্ছিল। অন্য সময়ে হলে অস্থির হয়ে উঠত মুরুগান। কিন্তু আজ যেন ওর কোন তাড়া নেই। ওর প্রিয় জঙ্গল পুড়ে যাচ্ছে, কফিবাগানেরই বা কী হল, কিছুই জানে না। জানার তাগিদও নেই যেন আর একটুও। অথচ ওই সকালে খবরটা পড়ে এক মুহূর্ত আর দেরি করতে পারেনি। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল ওর তখন। আর এখন? পুরো উলটো! মাথার ভেতরে একটা ফাঁকা বোধ, শরীরটাও নির্ভার হয়ে আছে। কোথাও গিয়ে পৌঁছনোর নেই আর তার। যেতে হয় যাচ্ছে, যেহেতু যাওয়াটাই যেন একমাত্র গন্তব্য। পৌঁছনোটা নয়। দেখতে দেখতে পাহাড়ের কাছে চলে এসেছে ওর গাড়ি। মুরুগানের শরীর শিথিল হয়ে আসছে আরও। যেন প্রাণহীন এক জড় বস্তু ও। গাড়ি থামল একসময়ে। ড্রাইভারের কথায় নামল কোনরকমে গাড়ি থেকে। এরই মধ্যে মুরুগান ওকে বলল, ‘তুমি বরং এখানেই থাক আপাতত। খালি গাড়ি নিয়ে ফিরবে কেন? যদি ভাড়া পেয়ে যাও ভালো, নইলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ কর’।
কত দিন নাকি কত যুগ বাদে মুরুগান এই চেনা রাস্তায়, এই চেনা মহল্লায় তার কাঠের পা ফেলল? এখনও কেউ চিনতে পারেনি ওকে। কেউ খেয়াল করেনি। এদের মন থেকে প্রায় মুছে গেছে এতদিনে হয়ত। ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো ও বাগানের কাছে। ওই তো প্ল্যান্টহাউস, ওই, ওই তো প্রসেসিং ঘর, আর দূরে তার সাজানো অফিসের ব্যালকনি। একবার যাবে নাকি ওখানে? বিদ্যার বাগানে পা দেবে একবার? যেতে গিয়েও গেল না ওদিকে। ডানদিকে বেঁকে গেল, যেদিক দিয়ে গেলে ওর বাড়ি পড়ে। বাড়ি? নিজস্ব ঘরটাও কেমন যেন আবছা হয়ে রয়েছে ওর স্মৃতিতে। কোনদিন কি তাকিয়ে দেখেছিল মুরুগান ঘরবাড়ির দিকে? বিদ্যার দিকে? মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করেছিল ওদের একদিনও? এইসব ভাবতে ভাবতে এসেই পড়ল ও বাড়ির কাছে। এলাকায় কিছু অচেনা মানুষদের দেখল, বাইরে থেকে এসেছে এমন মনে হল না, হয়ত এখানেই থাকছে এরা। নইলে যেমন ছেড়ে গেছিল, তেমনই আছে তার ঘরবাড়ি, পাহাড়, জঙ্গল। বাড়ির কাছে আসতেই কুকুরগুলো একসঙ্গে ডেকে উঠল তারস্বরে। সম্ভবত কাজের লোকের কেউ ওদের এমন চেঁচিয়ে ওঠার কারণ খুঁজতে এসে দেখে একজন দীর্ঘদেহী লোক গেট খুলে ঢুকে মাটিতে শুয়ে আছে আর চারটে কুকুর তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সে বেচারি লোকটাকে চোরছ্যাঁচড় বা ভবঘুরে ভেবে তাড়িয়ে দিতে ছুটে এলো, ভাবল কুকুরগুলো বুঝি লোকটাকে কামড়েই শেষ করে দিল! কাছে এসে দেখে সেই লোক কুকুরগুলোর ভালোবাসার অত্যাচার সহ্য করছে চুপ করে…সে নিজেই চেঁচিয়ে উঠল মালিককে দেখে। চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করল সে এবার। কুগান দৌড়ে এসেছে কাকার কাছে। আর বিদ্যা বারান্দায় চিত্রার্পিত, স্থির…
আগুনের হল্কা ক্রমশ বাড়ছে। কাঠ ফাটছে সশব্দে। জঙ্গল থেকে ছিটকে আসছে পোড়া জন্তুজানোয়ার আর গাছের ডাল। কিছুতেই আগুন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আজ তিনদিন হল, কমার বদলে আগুনের তেজ বাড়ছে হুহু করে। জল স্প্রে করে কোন কাজ হয়নি। জঙ্গল কাটার চেষ্টাও আর করা যাচ্ছে না। মুরুগানের বাগানের দিকেই হয়ত এবার এসে যাবে আগুন! সব শেষ দেখার জন্যই কি ও ফিরে এলো? এই প্রশ্ন করেছিল বিদ্যা এতদিন বাদে ওকে সাক্ষাতের পর। আর এভাবেই, সরাসরি নয়, ভাববাচ্যে। বাগানের হালচাল নিয়ে কিছু জানতে চায়নি মুরুগান। শুনতেও চায়নি, থামিয়ে দিয়েছে কুগানকে। এলাচসখির সঙ্গে দেখা করে এসেছিল একবার, দূর থেকেই। কাছে গিয়ে তাকে আদর করেনি আগের মতো। আজ রাতে এলাকার কারুর চোখেই ঘুম আসবে না। তবু তো বিছানায় যেতে হবে। বিদ্যা নিজের ঘরে যাওয়ার সময় কুগানকে বলে গেল, ‘খেয়াল রাখবি, ও যেন বাইরে না যায়!’ কে, কার খেয়াল করবে আর এই সময়ে। তবুও কুগানের উচিত ছিল সেদিন মুরুগানকে চোখে চোখে রাখার। আর সেদিনই মরণ-ঘুম এসে ওর চোখে থাবা গেড়েছিল। এত অঘোরে ঘুমিয়েছিল যে, হইচই শুনেও ঘুম ভাঙেনি ওর।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।