দোকানে এসেই ডেলিভারি বয় খুব মেজাজ দেখিয়ে ওকে বলল, ‘তোমার ফোন বন্ধ কেন? মালিক চ্যাঁচামেচি করছিল তোমাকে না পেয়ে। আমার ওপর ঝাল ঝাড়ল। পেমেন্ট দেবে কবে? কিছু মালের দাম বেড়েছে, তুমি নিজেই কথা বলে জেনে নিও’। ছেলেটা চলে যাওয়ার পর মুরুগানের হুঁশ ফিরল। সত্যিই তো! এই সমাজে বাস করতে গেলে একটা মোবাইল না হলে তো চলবে না। আর বুথ থেকে ফোন করে নেবে—এও মুরুগানের দ্বারা হবে না, কারণ কোন নম্বরই ওর কাছে লিখে রাখা নেই। ওই মোবাইলেই যা ছিল। অগত্যা উপায়? বিকেলে আজকের মতো ছেলেদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করতে হল। মোবাইল সারানোর দোকান খুঁজতে বেরোল মুরুগান। কাছেপিঠেই পাওয়া গেল একজনকে। কিন্তু তিনদিন বাদে সে সারিয়ে দিতে পারবে। এছাড়া আর কীই বা করার আছে মুরুগানের। এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে এলো সে। ওর নিজের যে মোবাইল খুব একটা প্রয়োজনে লাগে, তাও নয়। কিন্তু ডিলার ক্ষেপে ব্যোম হয়ে যাবে। ছেলেটাকে কিছু অগ্রিম দিয়ে দিতে হবে হাতে। মোবাইল ভেঙেছে, এটাও জানিয়ে দিতে হবে। এই সব ভাবনার মধ্যে ছেলেটা চলে এলো তেতো মুখ নিয়ে। ও কিছু বলার আগেই ওকে সম্ভাব্য পেমেন্ট দিয়ে দিল, আর ওর ফোন থেকেই ডিলারকে জানিয়ে দিল পুরো ঘটনা। আপাতত এদিকটা মিটল এই ভেবে দোকান বন্ধ করার তোড়জোড় শুরু করল মুরুগান। প্রায় সাড়ে আটটা বাজে তখন। হঠাৎ শোকেসের কাচ মুছতে গিয়ে ভেতর থেকে দেখতে পেল দুজন ওর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে। মাথা তুলে চমকে গেল। গৌতম এসেছে ওর মায়ের সঙ্গে! হৈহৈ করে উঠল মুরুগান। আরে! কী খবর তোমাদের? কেমন আছ? গৌতমী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল। আর গৌতম ওর নিজের ভাষায় একরাশ অভিমান, ক্ষোভ উগড়ে দিল মুরুগানের ওপর। কেন আংকেল আসে না আর ওদের বাড়ি! ওকে আদর করল গায়ে হাত বুলিয়ে। নিজেকে এবার সত্যি এক অপরাধীর মতো লাগছিল মুরুগানের। গৌতমীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘সব খবর ভাল তো?’ গৌতমী ম্লান হেসে মাথা নাড়ল। তারপর মৃদু স্বরে বলল, দুদিন রাতে ছেলেটা খায়নি কিচ্ছু। আপনি না এলে ও আজও খাবে না বলছে। তাই কিছুটা বাধ্য হয়ে আসতে হল এখানে। ও নিজেই ওর আংকেলকে নিয়ে আসবে বলে জেদ ধরেছে…এছাড়া আমার আর উপায় ছিল না। কিছু মনে করবেন না। আজকের দিনটা ম্যানেজ করে দিন ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে। কাল থেকে আমি সামলে নেব’। একসঙ্গে এতগুলো কথা বলে গৌতমী যেন হাঁফিয়ে উঠেছিল। অন্য দিকে মুখ ফেরাল ও। ওর চোখ কি ছলছল করছিল? নাকি মুরুগানই ভুল দেখল? এরপর আর কিছু করার ছিল না ওর। ওদের বাড়ি পাঠিয়ে দোকান বন্ধ করে ওদের বাড়ির দিকে রওনা হল সে।
যেতে যেতে ভাবছিল, মানুষ কি এভাবেই বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে? এরা কারা তার? কোথা থেকেই বা এলো তার জীবনে? আর এক অজানা ভালোবাসার বাঁধনে বেঁধে ফেলল কয়েকদিনে! এ কি ওপরওলার চালাকি নয়? মানুষ বড় বোকা। ওঁর কৌশলের কাছে মানুষ এক পুতুল মাত্র। তার ওঠাবসা, নড়াচড়া, থাকা বা না-থাকা, সবই উনি নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন অলক্ষ্যে। প্রাপ্তির ঝুলিও কি ভরে না মানুষের? নিশ্চই ভরে। এই প্রায় বৃদ্ধ বয়সে এক অসম্পূর্ণ কিশোর এসে ওকে পিতৃত্বের স্বাদ দিয়ে পূর্ণ করেছে। এও কি কম কিছু প্রাপ্তি ওর? মনটা মায়ায় ভরে উঠল মুরুগানের। গেটের কাছে পৌঁছেই দেখল গৌতম দাঁড়িয়ে ওর অপেক্ষায়। যথারীতি সেদিন আনন্দে, খুশিতে কেটে গেল। রাতের খাওয়াও ওখানে খেয়ে আসতে হল মুরুগান। ফেরার সময়ে গৌতমী দরজার কাছে এলে, মুরুগান নিজে থেকেই বলল, ‘কাল আসব। চিন্তা কর না। নেহাত মোবাইলটা ভেঙে গেছে, তাই খবর দিতে পারিনি। এই বাড়ি আমাকে টানে সন্ধের পর থেকেই। আসতে আমাকে হবেই যে!’ গৌতমীর মুখটা আলোর উদ্ভাসে জ্বলজ্বল করছিল সেই মুহূর্তে। আবেগে গলা বুজে এসেছিল ওর। মুখ নামিয়ে নিল ও। দরজার পাল্লা ধরে থাকা গৌতমীর এক হাত স্পর্শ করল মুরগান। কেঁপে উঠল কি গৌতমী? কী ঠান্ডা হাত ওর! মানুষের হাত এত ঠান্ডা হয়? না জানি কতদিন ভালবাসার স্পর্শরহিত হয়ে আছে সে!