• Uncategorized
  • 0

গল্পবাজে তীর্থঙ্কর ভট্টাচার্য

প্রতিশোধ

তিয়াত্তর বছরের ভূবিখ্যাত ডাক্তার অমরনাথ বাবু বিধ্বস্ত অবস্থায় নিজের ঘরে ক্লান্ত পায়ে টলতে টলতে এসে পড়লেন। ঘর্মাক্ত ললাট, দু চোখে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। ধপ করে বসে পড়লেন খাটের ওপর। তারপরে জুতো পরেই শুয়ে পড়লেন গা এলিয়ে দিয়ে।
এই সময়ে তিনি বাড়িতে একা। কাজের লোকেরা থাকে না। নিজের হাসপাতাল থেকে শারীরিক অসুস্থতার অছিলায় তিনি আজ চলে এসেছেন বাড়ি। এখন তিনি সত্যিই নিতান্ত পরিশ্রান্ত।
নিজের নাড়ির গতি একবার পরীক্ষা করে নিলেন অমরনাথ বাবু। হৃৎপিণ্ড ছুটন্ত ট্রেনের ইঞ্জিনের মত উত্তেজিত। টেবিলের দিকে হাত বাড়িয়ে ওষুধের পাতাটা খামচে নিলেন। পাশে রাখা জলের জাগ।
ওষুধটা খেয়ে আবার গা এলিয়ে দিলেন অমরনাথ বাবু। জুতোটা খুলে নিয়েছেন। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন কোনোক্রমে। বারবার কপাল মুছছেন।
একটা একটা করে পুরনো ছবি ভেসে যাচ্ছে যেন চোখের সামনে। নিজের ছেলের মৃত্যুর ঘটনা। উনি নিজে তখন বিদেশে। কয়েক বছর উনি বিদেশে ছিলেন তখন। নিজের ছেলের মৃত্যু রুখতে পারেননি ডাক্তার হয়েও। ওঁর কলেজের বন্ধু ডঃ ঘোষাল প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন বাঁচাতে ওঁর ছেলেকে-কিন্তু কোনোভাবে শেষ রক্ষা হল না। যতক্ষণে তিনি নিজে ফিরেছেন দেশে, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে-সময় নেই।
নিজের ছেলের অন্তিম লগ্নের দৃশ্যটা ভেসে উঠল অমরনাথ বাবুর মানসচক্ষে। প্রায়ই ওঠে ভেসে- যখনই উনি কোনো মরণাপন্ন রোগীর শিয়রে থাকেন অথবা লিখতে হয় কারো ডেথ সার্টিফিকেট।
দাঁতে দাঁত চেপে নিলেন তিনি। তাকালেন ছেলের বইয়ের আলমারিটার দিকে। কেটে গেছে অনেকগুলো বছর এর মধ্যে।
এতগুলো বছরের একটা চাপা অদম্য ক্ষোভ ওঁকে দগ্ধ করে যাচ্ছিল। যতক্ষণ না একটা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে পারছেন, শান্তি হচ্ছিল না। আজ থেকে ঠিক তিন দিন আগে বন্ধু ঘোষাল কে ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন ‘ ঘোষাল, তুই কী নিশ্চিত তোর সেই কথাটায়?’
-‘হ্যাঁ রে ভাই, আমি নিশ্চিত আজও’। সুকৌশলে কৃত আর্সেনিক পয়জনিং।’
আরেকবার যেন অমরনাথ বাবুর মাথার রক্ত চড়ে গিয়েছিল। প্রতিহিংসার এক অদম্য জিঘাংসা তাঁকে পাশবিক করে দিয়েছিল। ঘোষাল বলেছিল ‘ তুই কি ভাবছিস? তুই কি …’
-‘ইয়েস ইয়েস, ঠিকই ধরেছিস তুই। আমি ছাড়ব না-‘
-‘পাগলামি করছিস? ভুলে যাস না তুই একজন চিকিৎসক। তুই, আমি আমরা সবাই এই পেশার প্রতি, এই সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ।’
কোনো জবাব দিতে পারেন নি অমরনাথ বাবু। চুপচাপ থেকে আস্তে করে রেখে দিয়েছিলেন ফোনটা। দু হাজার তিরিশ সালের ডাক্তারি পাশ একসাথে দুজনের। কেটে গেছে পঁয়তাল্লিশটা বছর তারপরে।
আজ অমরনাথ বাবু সফল চিকিৎসক। পৃথিবী জোড়া তাঁর নাম। স্নায়বিক রোগের চিকিৎসায় তিনি এনেছেন যুগান্তর। তাঁর আবিষ্কৃত মাইক্রোরোবোট মানুষের মস্তিষ্কের মাইক্রোবোটিক নিউরো চিকিৎসা করে দিচ্ছে সারা পৃথিবীতে।মস্তিষ্কের মাইক্রোবোটিক নিউরো সার্জারি সারা পৃথিবীতে তিনিই করতে পারেন একমাত্র। এ চিকিৎসা ধারার তিনিই পথিকৃৎ। তাঁর মাইক্রোবোটরা মানুষের মস্তিষ্কে ঢুকে জটিল থেকে জটিলতর স্নায়বিক ব্যাধি আর মানসিক রোগ সারিয়ে দিচ্ছে বহু মানুষের। অগাধ তাঁর বিষয়সম্পত্তি আর অর্থ। পৃথিবীর অন্যতম ধনী ডাক্তার তিনি যাঁর মনে পুত্রবিয়োগের অশেষ বেদনা।
ন্যূনতম কেটে মানুষের মস্তিষ্কে মাইক্রোরোবোট দের ঢুকিয়ে দেন। স্নায়ু কোষে কোষে তারা নেভিগেশন করে মাইক্রোবোটিক নিউরো সার্জারি করে। মনের জটিলতার জট খুলে দেয়। কত মানুষের আত্মহত্যা প্রবণতা কমিয়ে দিয়েছেন অমরনাথ বাবু; আর কত স্নায়বিক রোগীর জীবন ফিরিয়ে দিয়েছেন। মানুষে তাঁর নামে ধন্য ধন্য করে। আজ তিনি চিকিৎসক হয়ে এক গর্হিত কাজ করে ফেলেছেন।
একেই বলে নিয়তির পরিহাস। চারদিন আগের কথা। অন্য হাসপাতাল থেকে কলকাতায় ওঁর হাসপাতালে এক রোগিনী এলেন চিকিৎসার জন্য। এলেন বললে ভুল হবে, নিয়ে আসা হল। নিয়ে এসেছে তাঁর আত্মীয় স্বজন, বাড়ির লোক। কঠিন স্নায়বিক রোগে আক্রান্ত সংজ্ঞাহীন রোগিনী কি করে নিজে আসবেন। তাকে দেখেই চমকে উঠেছিলেন অমরনাথ বাবু। চেনা লাগল। শুধু এতগুলো বছরের বয়সের রেখা তাকে পাল্টে দিয়েছে। এসিস্টেন্টের কাছে অমরনাথ বাবু চেয়ে নিলেন রোগীর কাগজপত্র।
ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলেন। হ্যাঁ, সেই নাম, যদিও পদবি ভিন্ন। খুবই স্বাভাবিক। বয়সেও মিলে যাচ্ছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য অমরনাথ বাবু র চোখ দুটো জ্বলে উঠেছিল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এসিস্টেন্ট আর নার্স সেটা লক্ষ্য করেছিল হয়ত। সেটা বুঝে তিনি নিজগুণে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার অভিনয় করলেন সেদিনের মত। সে রাতে অমরনাথ বাবু র ঘুম হয় নি। পরের দিন ডাক্তার ঘোষালের বাড়ি গিয়ে হাজির হয়েছিলেন অমরনাথ বাবু। অনেকক্ষণ কথা হল। তারপরে নিজের কাজে ফিরে গিয়েছিলেন অমরনাথ বাবু। পরে আবার ফোন করেছিলেন বন্ধুকে।
তাঁর শিক্ষিত প্রোগ্রামিং করা মাইক্রোরোবোটরা ছড়িয়ে দেয় স্নায়ুকোষে স্নায়ুকোষে আরোগ্য। নিয়ে আসতে পারে তারা মানুষের মনের গহনের খবর। স্নায়বিক তরলের মধ্যে দিয়ে তারা মানুষের স্নায়ুমণ্ডলীতে পৌঁছে কখনও করে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শল্যচিকিৎসা, কখনো সযত্নে খুলে দেয় ব্লকেজ, কখনো ছাড়িয়ে দেয় ক্লট। স্নায়বিক তরলে পর্যাপ্ত লবণ বা সল্যুশন মিশিয়ে দিয়ে কখনো কখনো এনে দেয় ভারসাম্য। বহু মানুষের জটিল থেকে জটিলতর মানসিক বৈকল্য ঠিক হয়ে যায়। কম্পিউটার মনিটরে লাইভ ক্যামেরায় সমস্ত লক্ষ্য করেন অমরনাথ বাবু। প্রতিটি রোগীর চিকিৎসায় আলাদা করে শিক্ষিত করে দিতে হয় মাইক্রোরোবোটদের। কিবোর্ডে তাদের জন্য মানব শরীরের অন্তঃস্থ অকুস্থলে কর্মরত অবস্থায় বার্তা পাঠিয়ে দেন অমরনাথ বাবু। এই মাইক্রোরোবোট গুলি জীবাণু আকৃতির। এরা তাঁর বড় বিশ্বস্ত, বড় প্রিয়।
সেদিন যথাসময়ে অপারেশন শুরু হল। মাইক্রোরোবোটদের তার আগের দিন প্রোগ্রামিং করে দিয়েছিলেন অমরনাথ বাবু। বিশ্বস্ত মাইক্রোরোবোট দের প্রবেশ করিয়ে দিয়ে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাদের গতিবিধি অপলকে দেখছিলেন অমরনাথ বাবু। প্রথমে নিজের ধারণা থেকে সমস্ত সন্দেহের নিরসন করলেন। বিশ্বস্ত মাইক্রোরোবোট সঠিক সংকেত দেখাল যন্ত্রে। আরও দুইবার তিনি দেখে নিলেন মনের গহন অতীতের প্রতিচ্ছবি । নির্ভুল- ডঃ ঘোষালের কথাই ঠিক। অমরনাথ বাবু র হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল।
কোনোরকম প্রমাণ রাখা যাবে না। নিপুণ ভাবে কাজ হাসিল করতে হবে। যদিও এই পদ্ধতিতে তিনিই একচ্ছত্র, তাঁকে প্রশ্ন করার কেউ নেই- তবু সাবধানের মার নেই। যে যেমন তার সাথে সেই ব্যবহারই করতে হবে।
কোনোরকম প্রমাণ সেও রাখেনি। শ্লথ বিষক্রিয়ায় সে ঠেলে দিয়েছিল মরণের দিকে- এ বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই। ডঃ ঘোষাল সে কথাই নিশ্চিতভাবে বলেছিলেন অমরনাথ বাবুকে। বারবার জিজ্ঞাসা করেও একই উত্তর দিয়ে গেছে ঘোষাল। সমস্ত সাক্ষ্য পরোক্ষভাবে তাই তুলে ধরছে অথচ কোনো প্রমাণ নেই। কিছুই করার থাকল না।
এক কুশ্রী মনোবৃত্তির বশে অমরনাথ বাবু র পুত্রবধূ নিজের স্বামীকে সুকৌশলে হত্যা করল। অনেক আশা ভরসা করে ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এই নিদারুণ প্রতারণার কথা ঘুণাক্ষরেও টের পান নি। নিজের শয্যাশায়ী অসুস্থ ছেলেকে পুত্রবধূ নীলিমার ভরসায় রেখে তিনি বিদেশে চলে গিয়েছিলেন। নীলিমা সেই সুযোগটা নিয়েছিল।
নিজের স্বামীর মৃত্যুর অব্যবহিত পরে নীলিমা আরেকবার বিয়ে করে। হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন অমরনাথ বাবু। পরে যখন জানতে পারেন যে ব্যাঙ্ক একাউন্ট্ আর গয়নাগাঁটি নীলিমা সবকিছুই হস্তগত করেছে তাঁর ছেলের,তখন তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। আর কিছু করার ছিল না তখন। পুত্রশোকবিহ্বল অমরনাথ বাবুকে ডাঃ ঘোষাল অনেক রকম সান্ত্বনা দিয়ে শান্ত করেছিলেন।
আজ এত বছর পরে নীলিমা সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তাঁর চিকিৎসাধীন। মাইক্রোরোবোটরা ঢুকে পড়ে তাদের কাজ করে চলেছে। একদল ঢুকে স্নায়ুকোষের জট ছাড়াচ্ছে- আরেক দল কে ঢোকালেন অমরনাথ বাবু। এই দ্বিতীয় দলটি ওঁর বিশেষ বিশ্বস্ত। কিন্তু তাদের আজ অমরনাথ বাবু ভাইরাস আক্রান্ত করে দিয়েছেন। তাঁর প্রযুক্তিবিদ পুত্র অনেক বছর আগে এই ভাইরাস তৈরি করেছিল। সযত্নে রাখা ছিল এতদিন। আজকে এভাবে কাজে লাগল।
মাইক্রোরোবোটরা স্নায়ুকোষে মিশিয়ে দিচ্ছে আত্মগ্লানির বিষ। নিউরোট্রান্সমিটার দিয়ে তা পৌঁছে যাচ্ছে নীলিমার কোষে কোষে। বিশ্বস্ত মাইক্রোরোবোটরা ব্যস্ত রোগিনীর আত্মহত্যা প্রবণতা বাড়ানোর কাজে। অমরনাথ বাবু ক্রমাগত চোখ রেখেছেন কম্পিউটারে। কোষে কোষে বাড়ছে ঘনত্ব রাসায়নিক পদার্থের। চরম অবস্থায় পৌঁছে দিতে হবে তাকে। তার অবচেতনে বাঁচার ইচ্ছা একেবারে ভূমিসাৎ করে দিতে হবে।
নিজেদের কাজ শেষ করে মাইক্রোরোবোটরা চলে এল ফাইবারের পাইপলাইনের মাধ্যমে কম্পিউটারের হার্ড ডিস্কে। এতক্ষণে নীলিমার অবচেতন মনেও কুরে খাচ্ছে আত্মজিঘাংসা আর আত্মগ্লানি। তা তাকে মুমূর্ষু করে দিচ্ছে। আর বেশিক্ষণ সময় নেই। ঘড়ি দেখলেন অমরনাথ বাবু।
কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিল নীলিমা- অমরনাথ বাবু নিজের চোখে দেখলেন। ই সি জি মেশিনের দিকে অনেকক্ষণ নজর দিলেন। হ্যাঁ- সব শেষ। টান টান উত্তেজনা নিয়ে বিশ্বস্ত মাইক্রোরোবোট গুলোকে বিনষ্ট করে দিলেন এক এক করে। সাক্ষ্য রইল না। ভাইরাস আক্রান্ত মাইক্রোরোবোট থেকে বাকি মাইক্রোরোবোট আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ও রইল না। মানসিক অবসাদ, যন্ত্রণা আর ক্লান্তি নিয়ে বেরিয়ে এলেন অপারেশন থিয়েটার থেকে। সেখান থেকে বাড়ি।
বাইরে ডোরবেল বাজল। চমকে উঠে অমরনাথ বাবু গেলেন দরজা খুলতে। এতক্ষণে অনেকটা সামলে নিয়েছেন। দরজায় ডঃ ঘোষাল। দুজনে দুজনের মুখের দিকে তাকালেন। ডঃ ঘোষালের বুঝতে বাকি রইল না ঘটনাটা।
‘ আয় আয় ভেতরে আয়’ বললেন অমরনাথ বাবু। মাথা নীচু করে ডাঃ ঘোষাল ঢুকলেন। বললেন ‘রুগীর মারা যাওয়ার খবর দিয়েছ কাউকে হাসপাতালের এখনও? ‘
– ‘ না ত; এখনই ফোন করে দিচ্ছি।’ চমকে বললেন অমরনাথ বাবু।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।