।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় তন্দ্রা বন্দ্যোপাধ্যায়

বাল্যসঙ্গিনী

এই গল্পটা আমি শুনেছিলাম আমেরিকার দক্ষিণের টেনেসির এক বরফঝরা বিকেলে । অবশ্য কাহিনীটা দেশের । আমার বন্ধু নমিতার দিদিশাশুড়ী এসেছিলেন কিছুদিনের জন্য বেড়াতে । আমরা যারা নমিতার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী, তাঁদের সক্কলের উনি চটপট করে দিম্মা হয়ে গেলেন এবং আমাদের সঙ্গে ভীষণ ভাব হয়ে গেল । এই বয়সেও চাঁপাফুলের মত রং, চমৎকার রান্নার হাত, আর গল্প করেন জমিয়ে । তো সেদিন দুপুরে একটা খাওয়া দাওয়া ছিল, সবাই চলে গেলেও আমরা কজন আড্ডা ছেড়ে যথারীতি নড়লাম না । ডিনার সেরে বাড়ি ফেরার ইচ্ছে হলে যাবো । বরেরা সবাই ওঘরে কি একটা খেলা দেখছে টি ভি তে আর মাঝে মাঝে বিকট চ্যাঁচাচ্ছে । ছেলেমেয়েরা এধার ওধার খেলছে ।
ফ্যামিলি রুমের মেঝেতে কার্পেটে পা ছড়িয়ে বসে ভূতের গল্পের কথা হচ্ছিল, কারণ একটু আগে একটা হরর মুভি চলছিল টি ভি তে । সুমনা বলল, “দিম্মা তোমার ভূতের গল্পে ভয় করে ?”
দিম্মা প্রিয়ার জোগাড় করা পান মুখে দিয়ে বললেন, “নাঃ, আজকাল আর তেমন জমাটি ভূতের গল্প কই রে ?”
নমি ওনার গলা জড়িয়ে ধরে বললো, “একটা সত্যি ভূতের গল্প বলো নাআআআ দিম্মা লক্ষ্মীটি । তুমি নিশ্চয়ই জানো অনেএএক !”
দিম্মা একটু হাসলেন, তারপর বললেন, “সত্যি ভূতের গল্প ! ঠিক ভূতের কিনা জানিনা কিন্তু জানি একটা…ওই যে তোরা বলিস এখন, ব্যক্তিগত, তা-ই, আর খুব মর্মান্তিকও ।” অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন ।
“প্লীইইজ বলো, বলো, দিম্মা !”
সীমা করুণভাবে বললো, “খুব ভয়ের নয় তো ? মানে, ইয়ে…” । তাকে দাবড়ানি দিয়ে থামানো হল ।
দিম্মা নড়েচড়ে বসলেন, “আচ্ছা, শোন । ভয় পাবি না তো ? অনেকদিনের কথা, মনে পড়ে গেল ।”
তাঁর জবানিতেই বলছি ।
************* ************* *************
আমার বাপের বাড়ি ছিল বর্ধমানের কাছেই এক গ্রামে, মানে প্রায় শহরই বলা যেতে পারে । সবরকম সুবিধেই ছিল । আমাদের ছিল বর্ধিষ্ণু যৌথ পরিবার, অনেক জমিজমা ছিল, জ্যাঠা কাকারা ভালো চাকরিও করতেন । আমি ছিলাম সেজো ভাইয়ের মেয়ে, আমার জন্মের পর পরই আমার মা মারা যান, কিছুদিন পরে বাবাও । কিন্তু আমাদের পরিবারে সকলে ছিলেন অতি স্নেহশীল ও সৎ, আর আমি মানুষ হয়েছিলাম আদর যত্নে । মা বাবাকে মনেও ছিল না, তাঁদের অভাবও বোধ করি নি । সব তুতো ভাইবোনে মিলে মিশে বড়ো হচ্ছিলাম, আর আমার প্রাণের সখী ছিল আমার জাঠতুতো বোন ইন্দিরা, ইন্দু । প্রায় সমান বয়সী ছিলাম আমরা, প্রায় যমজ বোনের মতই বড়ো হচ্ছিলাম । সব মনের কথা বলাবলি করতাম । আমার নাম সুনন্দা, নন্দু বলে ডাকতো সবাই ।
আঠার উনিশ বছর বয়স হলো প্রায় আমাদের, কাছের একটা কলেজে ভর্তি হয়েছি, আমার জেদেই । তখনকার রেওয়াজ মতো এবার-তো-বিয়ের-ব্যবস্হা-করতেই হয় গোছের ভাব সবাইয়ের । দুজনেই যাতে কাছাকাছি থাকি সেই ইচ্ছে সবার । আমরা দেখতে শুনতে ভালো ছিলাম, বাড়ি থেকে যথেষ্ট দেওয়া থোওয়া হবে , সুতরাং উপযুক্ত পাত্র পাওয়ার সমস্যা হওয়ার কথা নয় । ইন্দু ছিল শান্ত ধীর স্হির, সংসারেই মন, লেখাপড়ায় অত নয় । বিয়ের ব্যাপারে খুব রাজি । আর আমি ছিলাম ঠিক উলটো । অস্হির চঞ্চল, এইখানেই এখনই বিয়ে করে সংসার করার ইচ্ছে নেই মোটেই , আমি চাই গণ্ডির বাইরে পা বাড়াতে । বাইরেটা দেখতে । পড়াশুনো করতে ।
একদিন ইন্দু আমায় জড়িয়ে ধরে বললো, “আমরা দুবোন যদি বিয়ে হয়ে দূরে দূরে চলে যাই কি হবে রে নন্দু ? ধর কখনো আর দেখা যদি না হয়।”
আমি বললাম, “ দূর, দেখা হবে না কেন ? বাপের বাড়ি আসবো না আমরা !”
“ আর ধর যদি মরে যাই তাহলে ?”
“কি মুশকিল, মরতে যাবো কেন খামোখা ?”
খেলাচ্ছলে ঠিক হলো যদি কেউ মরে যাই অন্যজনকে এসে দেখা দিয়ে বলে যাবো মরার পর কি হয়। ইন্দুর খুব আগ্রহ ছিল এসবে । আমরা রক্ষেকালীর মন্দিরের দিকে তাকিয়ে দিব্যি করলাম পরস্পরকে ছুঁয়ে । যদিও আমার ছেলেমানুষি মনে হচ্ছিল এ সব ।
এমন সময় পাড়ার কি এক অনুষ্ঠানে পাশের গ্রামের জমিদার গিন্নীমা আমায় দেখে পছন্দ করে ফেললেন তাঁর বড়ো ছেলেটির জন্যে । সবাই খুশি হলো, এমন ঘর বর, কিন্তু আমি নয় । জমিদারনন্দনকে এক নজর দেখে মোটে ভালো লাগেনি । টকটকে রং, মাঝারি লম্বা, তুলিতে আঁকা চোখমুখ, ঢুলুঢুলু চাউনি, সরু গোঁফ । এধরণের চেহারা আমার দু চক্ষের বিষ । অপছন্দ করার আরেকটা কারণ ছিল ( দিম্মা এখানে একটু কাশলেন ), আরেকজনকে আমার মনে ধরেছিল । ওপাড়ার সতীশজ্যাঠার ছেলে বিজয় ( নমি, আমাদের প্রতি: “দাদু, বুঝলি তো ?” ) এতদিন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে এবার মুম্বইয়ে কাজ পেয়েছে । ছ ফুট লম্বা, শ্যামবর্ণ, কাটা কাটা চোখমুখ, লোহাপেটা চেহারা । বাপের কাছে এসেছে কদিনের জন্য । মা অনেকদিন গত, সতীশজ্যাঠাও ঠিক সংসারী নন, আজ হরিদ্বার কাল বৈদ্যনাথধাম ঘুরে বেড়ান । যদিও বিষয় সম্পত্তি যথেষ্ট । ছোট থেকেই ওনার বাড়ি আমার আসা যাওয়া, কারণ ওনার বিশাল লাইব্রেরিতে আমি অনেকটা সময় কাটাতাম । সে যাক গে, বিজয়ও আমায় দেখেছিল, এবং…হাসছিস যে বড়ো? প্রেম ব্যাপারটা কি তোরাই আবিষ্কার করেছিস নাকি ? যাই হোক ওর বাবাও আমায় খুব ভালোবাসতেন, কিন্তু এদিকে তো এই জমিদারি সম্বন্ধের ঝামেলা ।
আরেকজনেরও খুব মন খারাপ, সে হলো ইন্দু । আমার কাছে লুকোবার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু তা কি সম্ভব ? ছলছল চোখ আর দীর্ঘশ্বাসের ঘটাতেই ধরে ফেললাম, ইন্দু ওই সুনীলরঞ্জন মানে জমিদারনন্দনকে হৃদয় দিয়ে ফেলেছে । আমার মনোভাবও সে আঁচ করেছে । কি ভয়ানক জটিলতা রে বাবা ! কি করবো আমরা । যাই হোক আমরা আমাদের মাই ডিয়ার টাইপের ছোটকাকিমাকে সবটা বললাম । তিনি চোখ কপালে তুললেন কিন্তু সবাইকে বলে ব্যবস্হা একটা হলো । আমার জেদের কথা সবাই জানতো । ইন্দু আমার থেকে ছ মাসের বড়ো এই অজুহাতে বলা হল ওর বিয়েটা আগে হওয়ার কথা, আর একমাত্র মেয়েকে জ্যেঠু এখনি দশ বিঘে জমি লিখে দেবেন…. ইন্দুর সঙ্গেই যদি বিয়েটা হয়…. । তো জমিদাররা রাজি হয়ে গেলেন । আমি পিতৃমাতৃহীনা বলে বোধহয় ওনাদের একটু খুঁতখুঁতুনি ছিলই । মেয়ে জমিদারের বাড়ি বৌ হবে বলে জ্যেঠু জ্যেঠিমাও খুব খুশী । আমার বিয়েও এক মাস পরেই হবে বিজয়ের সঙ্গে, ঠিক হয়ে গেল । সবাই সুখের সাগরে ভাসতে লাগলাম ।
খুব ঘটাপটা করে ইন্দুর বিয়ে হয়ে গেল । ইন্দুর সুখের হাসি দেখে খুব ভালো লাগলো । যদিও নতুন জামাইবাবুর চোখের দৃষ্টি হাবভাব, নতুন শ্যালিকার সঙ্গে আদিরসাত্মক রসিকতা এসব ভালো লাগেনি আমার । এগুলো স্বাভাবিক বলেই ধরা হত কিন্তু কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল আমার । যাই হোক আমারও বিয়ে হয়ে গেল, আর কিছু ভাবার অবকাশ ছিল না ।
মাসখানেক পরে মুম্বই চলে যাবো, তার আগে একদিন বাপের বাড়ি এসে দেখি ইন্দু এসেছে । দেখা হয় নি বেশ কিছুদিন । অনেক গয়না, দামি শাড়ি । কিন্তু আমার কেমন কেমন যেন লাগলো । অত সুন্দর চেহারা কিরকম শ্রীহীন দেখাচ্ছে, ফ্যাকাশে, মুখের হাসিটা জোর করে টেনে আনা। শোবার ঘরে নিয়ে গিয়ে বললাম, “কি হয়েছে তোর ?”
“কিছু না রে, কি হবে আবার ?”
“আমার কাছে লুকোবি ?”
দু একবার না না করে তারপর আমার কোলের ওপর লুটিয়ে পরে কাঁদতে লাগলো । “আমি ভীষণ ভুল করেছি রে । আর আমার না হলে তোর কপালেও তো এই হতো ।”
সুনীলদা প্রচণ্ড মদ্যপ । আনুষঙ্গিক সব রকম দোষই আছে । একাধিক রক্ষিতা । ওদের দাম্পত্য জীবনের কিছু কথা জেনে শিউরে উঠলাম । জ্যেঠুরা খোঁজখবর করার সময় কেউ কিছু বলেনি । শাশুড়ী নাকি মুখঝামটা দিয়ে বলেছেন বনেদী বাড়িতে এসব হয়ই, কোনো অভাব তো নেই বৌয়ের ! ওর মাথায় হাত রেখে বসে চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো ।
“এ বাড়িতে বলেছিস ?”
“মা বাবা জানেন । কি আর করবেন, বলছেন মানিয়ে নিতে ।”
চুপ করে গেলাম । ইন্দু আমার শ্বশুরবাড়িতে একবার এলো আমি যাবার আগে । জোর করে নিজের একটা আংটি পরিয়ে দিলো । কেমন খাপছাড়া ভাবে বললো, “আমাদের সেই দিব্যি দেওয়া মনে আছে তো তোর ?” আমি বললাম “ছাড় তো ওসব কথা । একি পায়ে কিছু পরিস নি ?” আমার শাশুড়ীর দরুণ পাওয়া পুরোনো গয়নার বাক্স থেকে একজোড়া রূপোর নূপুর পরিয়ে দিলাম ওকে । খুব সুন্দর দেখতে, কলকা কাটা, সারি সারি ঝুমঝুমি । ম্লান হাসলো বিদায় নেবার সময় ।
মুম্বই গিয়ে সময় কাটতে লাগলো নতুন বিয়ে আর নতুন সংসারের সুখে আনন্দে । বোরিভিলিতে থাকতাম আমরা । ছোটখাট জায়গা । সিনেমাহল দোকান বাজার সবই আছে, মোটরগাড়িও আছে, টাঙাও আছে । আড়াইটে ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম । সামনে পেছনে একটুকরো করে জমি । বেশ গুছিয়ে বসলাম ।পাড়া প্রতিবেশীরা শুধু মারাঠী নয় নানা প্রদেশের মানুষ । অনেক বন্ধু বান্ধব হয়ে গেল । বিজয় সকালবেলা ইলেকট্রিক ট্রেণে আন্ধেরি যেতো ওর কাজের জায়গায়, ফিরতো সন্ধ্যের আগেই । শুধু ইন্দুর কথা ভেবে মন খুব খারাপ হতো মাঝে মাঝে ।
ওখানকার স্হানীয় “ঘাটি” মেয়েদের আমার খুব ভালো লাগতো । খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, আঁটসাঁট কোঁচা দিয়ে পরা রঙিন শাড়ি, তেল দিয়ে আঁচড়ে বাঁধা চুল । আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়েই ঝুড়ি করে সবজি কুচো মাছ এই সব নিয়ে বাজারে যেতো । ওরাই অনেকে লোকের বাড়ি বাসন মাজা ঘর মোছা কাপড় কাচা ইত্যাদির কাজ করতো । তাদের বলা হতো বাঈ, তারাও আমাদের বলতো বাঈ । আমারও ছিল একজন, কুন্তী । আমাদের বাড়ির সামনে একটা বড় গাছ আর তার নিচে একটু বাঁধানো জায়গা ছিলো । বাজার ফেরত মেয়েগুলো একটু বসতো ওখানে কখনো কখনো । পাড়ার বাঈরা কাজ সেরে আসতো, তারপর এক সঙ্গে বাড়ি যেতো । আমি ক্লান্ত মেয়েগুলিকে জল, একটু কিছু খাবার, মুড়ি, লাড্ডু নাড়ু দিতাম । খুব খুশী হতো । আমার জন্যে ভালো সবজি মাছ আনতো সকালে ।
ইন্দুকে চিঠি লিখে বিশেষ উত্তর পেতাম না । ওখানে তখন খুব সুন্দর ছাপা নরম সুতির শাড়ি পাওয়া যেতো । একবার বাপের বাড়িতে কিছু উপহার পাঠালাম পার্সেলে, ইন্দুর জন্যে একটা বিশেষ করে ঐরকম একটা শাড়ি পাঠালাম ।
কিছুদিন পরে পাড়ার অনেকে মিলে গেলাম অজন্তা ইলোরা দেখতে । ভালোই কাটছিল । কিন্তু অজন্তায় সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে হঠাৎ কিভাবে যেন আঁচলে টান লাগলো, বিজয় না ধরে ফেললে অনেক নিচে পড়ে যেতাম । দেখি একটা কাঁটাঝোপে আঁচলটা আটকে গেছে কিরকম অদ্ভুতভাবে । কেমন যেন ভয় করতে লাগলো । হোটেলে ফিরে গিয়ে অসুস্হ লাগছিল, কেমন যেন অস্হির, দম বন্ধ হয়ে আসছে । বিজয় মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, “আচমকা ভয় পেয়ে এমন হচ্ছে ।”
ফিরে এসেও ভয়টা ছিল ক’দিন । খালি মনে হচ্ছিল আঁচলটা কিভাবে উড়ে গেল, আর ওদিকে কোনো কাঁটাঝোপও তো আগে দেখিনি । ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছি, এমন সময় বাড়ি থেকে চিঠি ।
ইন্দু আর নেই, শ্বশুরবাড়ির লাগোয়া পুকুরে ডুবে মারা গেছে । ওঁরা বলছেন হয়তো কিছুতে পা জড়িয়ে গিয়েছিলো, নইলে ও তো সাঁতার জানতো । তিন মাস অন্তঃসত্ত্বা ছিল ।
ধাক্কাটা খুব বেশী লাগলো । আবাল্যসঙ্গিনী সখী, দুই বোনের মতো মানুষ হয়েছি, এভাবে চলে গেলো ! কি হয়েছিল ঠিক? কদিন খুব কান্নাকাটি করলাম । ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হতে লাগলো।
একদিন দেখি গাছের নিচে ঘাটি মেয়েগুলির থেকে একটু দূরে আরেকটি মেয়ে বসে আছে । মুখটা পুরোটাই ঘোমটায় ঢাকা । একটু অবাক হলাম, কারণ এরা বেশ সপ্রতিভ এবং ঘোমটা দেয় না । যাক গে, কতরকম জাতির কতরকম নিয়ম এখানে ।
তারপর মাঝে মাঝেই দেখতাম ও মেয়েটাকে কিন্তু লক্ষ্য করলাম ও কিচ্ছু খেতো না । একদিন সে আসে নি, আমি অন্যদের কুচো নিমকি দিতে দিতে বললাম, “তোমাদের সঙ্গে যে ঘোমটা দেওয়া মেয়েটা আসে সে কিছু খায় না কেন ?”
ওরা অবাক হয়ে বললো , “কোন ঘোমটা দেওয়া মেয়ে ? কার কথা বলছো বাঈ ? ওরকম কাউকে আমরা দেখি নি তো !”
কিরকম খটকা লাগলো । বার কয়েক জিজ্ঞেস করতেও ওরা একই কথা বলে । ওরা চলে যাবার পর আমি রান্নাঘরের কাজ সারতে সারতে খোলা দরজা দিয়ে হঠাৎ চেয়ে দেখি, সেই মেয়েটি বসে আছে, ততক্ষণে সন্ধ্যে হয়ে আসছে । কি করবো ভাবতে ভাবতেই সে উঠে চলে গেলো আর তারপরই বিজয় ফিরে এলো ।
তারপর দেখি মেয়েটা অন্যদের সঙ্গে আসে না , মাঝে মাঝে এসে বসে থাকে সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসার পর কখন চলে যায় । মেয়েটার শাড়িটা একদিন খুব চেনা চেনা লাগলো । ওইরকম নীলের ওপর ফুল ফুল শাড়ি…ইন্দুকে পাঠিয়েছিলাম না ? যাঃ ওরকম শাড়ি তো কতই আছে । কিন্তু কেমন অস্বস্তি লাগছিল । বিজয়কে বললাম, ও হেসে উড়িয়ে দিলো । ওর ফ্যাক্টরিতে কাজের চাপ বেড়েছে আজকাল ফিরতে দেরীও হচ্ছে ।
সেদিন বিকেল পেরিয়ে গেছে, মেয়েগুলি এসে বসে জলটল খেয়ে চলে গেছে, কুন্তীও গেছে, আমি একলা । আজ বিজয়ের দেরী হবে বলেছে । আমি মিল্ক কলোনীর দিয়ে যাওয়া বোতলের দুধ বসিয়েছি গ্যাসে জ্বাল দেবো বলে । দরজা বন্ধ করবো, কাছে গিয়ে হঠাৎ তাকিয়ে দেখি, গাছের ছায়ার ঝুঁঝকো আঁধারে সেই ঘোমটা দেওয়া মেয়েটি বসে । উঠে দাঁড়ালো, কিন্তু চলে না গিয়ে পায়ে পায়ে এদিকে এগিয়ে আসতে লাগলো । আমার কি রকম গা ছম ছম করে উঠলো । খেয়াল হলো আমি একেবারে একা । দুপাশের বাড়িগুলি একটু দূরে দূরে আর দরজা বন্ধ । মেয়েটি কাছে আসছে….হ্যাঁ, আমার ইন্দুকে পাঠানো সেই শাড়িটাই, নীলের ওপর সাদা ফুল আর সবুজ ছাপ…আমার শরীর অবশ হয়ে গেছে, কিছুতে দরজাটা বন্ধ করে দিতে পারছি না…ছোট্ট বারান্দাটার দুধাপ সিঁড়ির নিচে দাঁড়ালো ।
অদ্ভুত একটা অবাস্তব ভয়ের মধ্যে লক্ষ্য করলাম মেয়েটির শাড়িটা সম্পূর্ণ সপসপে ভিজে । টপটপ করে চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল পড়ছে । শ্যাওলা আর কাদার গন্ধ… আমি বিকৃত কন্ঠে বললাম, “ক্ কে…” যদিও আমার আর সন্দেহ ছিল না ।
ঘোমটার ভেতর দিয়ে আমায় দেখছে ? একটা পা বাড়ালো, ঝুম করে শব্দ হলো । আমি দেখলাম আমারই দেওয়া সেই নুপুরটা ।
আমি তখন যুক্তির বাইরে, বললাম, “ইন্দু !” মাথা নাড়লো কি!
দম বন্ধ হয়ে আসছে, কোনোরকমে বললাম, “কেন – কেন এসেছিস ? তুই কি আমায় কিছু বলবি ?”
আর যেই না বলা, প্রচণ্ড একটা ঝটকা দিয়ে দুধারে মাথা নাড়লো – না, না, না । হাত দুটো দুধারে প্রবল বেগে নাড়ছে…না, না, না, বলতে চায় না ।
ভয়ঙ্কর একটা আতঙ্কের মধ্যে থেকে আর্তকন্ঠে বললাম, “ইন্দু …আমি শুনতে চাই না, চাই না…তোকে দিব্যি থেকে মুক্তি দিচ্ছি…তোর পায়ে পড়ি, চলে যা, চলে যা…”
আমি দেখতে পাচ্ছি দূরের বাড়িগুলোতে আলো জ্বলছে, ওই কোণের গোবিন মুদির দোকানে কারা কথা বলছে । দুধ উথলে পড়ে একটা পোড়া গন্ধ মিশে যাচ্ছে শ্যাওলা ঝাঁঝির গন্ধের সঙ্গে । শুধু এখানে…এখানে একটা অলৌকিক ভয়ের বন্ধ জগতে শুধু আমি…আর সে । আমার বাল্যসঙ্গিনী, বোন, সখী….সে দাঁড়ালো, তারপর একটু ঝুঁকে পড়ে দুহাত রাখলো তার তলপেটের ওপর, সে কি যে করুণ ভঙ্গি । আমার মনে পড়লো সে মৃত্যুর সময় গর্ভবতী ছিলো । আমি প্রায় শেষ শক্তিটুকু দিয়ে হাতজোড় করে বললাম, “ইন্দু, চলে যা..আর আসিস না…”
পিছন ফিরে কয়েক পা গিয়ে মিলিয়ে গেলো , তারপর আমার আর মনে নেই । বিজয় ফিরে এসে আবিষ্কার করলো আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছি অন্ধকার বারান্দায়, দুধ পুড়ে কড়াই জ্বলছে । আলো জ্বেলে আমায় তুলে ঘরে নিয়ে গেল, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছিল । খুব ঘাবড়ে গেছিল বিজয়, জ্ঞান এলে ওকে সব বলতে বললো জ্বরের ঘোরে ভুল দেখেছো । কিন্তু বারান্দায় গিয়ে দেখলো নিচে অনেকটা জায়গা একেবারে ভিজে, আর ধাপির নিচে কি একটা চকচক করছিলো, তুলে দেখলো একটা রূপোর নূপুর । আমার হাতে এনে দিলো নিঃশব্দে ।
সুস্হ হতে ক’দিন লাগলো, ওবাড়িতে আমি আর থাকতে পারছিলাম না, গাছতলার দিকে তাকাতে ভয় করতো । বিজয়ের একটা প্রোমোশন হলো, আমরা আন্ধেরিতে চলে গিয়ে নতুন সংসার পাতলাম । বছরদেড়েক পরে বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম । তদ্দিনে ইন্দুর মৃত্যুশোক স্তিমিত হয়ে এসেছে । জ্যেঠিমা আমার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “কি ভাবে কেমন ভাবে চলে গেলো মেয়েটা, শ্বশুরবাড়িতে খুব দুঃখে ছিলো রে…পরে আমি বলতাম আমাদের কাছে চলে আয়, শুনলো না…তোর কথা খুব বলতো রে নন্দু…যখন তুললো জল থেকে তোর দেওয়া শাড়িটা পরা ছিল, আর ডান পায়ে একটা নূপুর…অন্যটা জলে পড়ে গেছিল..” অসংলগ্নভাবে বলে চুপ করে গেলেন ।
আমি ওঁর হাত ধরে বসে রইলাম, কিছু বলি নি । পরে ইন্দুর শ্বশুরবাড়ির পুকুরের জলেই সেই একপাটি নূপুর ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম ।
************ ************* **************
দিম্মা চুপ করলেন । বোধহয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন । আমরা কেউ কিছু বললাম না । অন্ধকার হয়ে এসেছিলো ।
একটু পরে আমি উঠে বড় আলোটা জ্বেলে দিলাম ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।