‘কফি পাহাড়ের রাজা’ সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে তুষ্টি ভট্টাচার্য (পর্ব – ৩ ।। খন্ড – ১৪)

কফি পাহাড়ের রাজা

তৃতীয় পর্ব:

১৪)

ফোন হাতে এলো মুরুগানের। কিন্তু ফোন খুলে দেখে লগবুক ফাঁকা! সেভ্‌ করা নামগুলো আর নেই। চেনা মানুষ আর কটা? গৌতমদের থেকে নম্বর নিয়ে নেওয়া যাবে, ডিলারের নম্বরও পাওয়া যাবে। আর কুগান যদি ফোন না করে? তবে? ভাবতেই বুকের ভেতরটায় একটা ঠান্ডা প্রবাহ বয়ে গেল। তারপর এরকম অলীক ভাবনা ঝেরে ফেলে দিল মুরুগান। ধুর! কুগান ঠিক ফোন করবে। নিশ্চই এই কদিনও করেছে। ফোন বন্ধ দেখে না জানি কত দুশ্চিন্তা ভোগ করেছে বেচারা ভোলেভালা ছেলেটা। এখন শুধু কুগানের ফোনের অপেক্ষায় থাকতে হবে। রোজ যেমন দিন কেটে যায়, আজও যাচ্ছিল মুরুগানের। দুপুর পেরিয়ে গেল, ফোন এলো না। সন্ধেবেলায় তো ফোন আসার কথা না। তবুও অপেক্ষায় ছিল মুরুগান। গৌতমের সঙ্গেও তেমন আড্ডা জমল না আজ মুরুগানের। গৌতমী ওর আনমনা ভাব লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু হয়েছে নাকি? একটু যেন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে আপনাকে’। মুরুগান ধরা পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘না, তেমন কিছু ঘটেনি। সমস্যা মানুষ নিজেই ডেকে আনে। যতদিন ফোনের আবিষ্কার হয়নি, মানুষ দূরের মানুষের সঙ্গে কি ভাব বিনিময় করেনি? নিশ্চই করেছে। তবে যোগাযোগ এত সুলভ ছিল না, এই যা। আর ফোন আবিষ্কারের পরে, যোগাযোগ এতই সহজলভ্য হয়ে গেছে যে, মানুষের প্রতি মানুষের যে টান, সেটারই যেন অভাব দেখা দিয়েছে। এই যেমন কদিন ফোন ছিল না বলে, নিশ্চিন্তে ছিলাম। নেই তো নেই! যেই সে ফিরে এসেছে, ভাবছি ফোন আসে না কেন!’ এই বলে মুরুগান হাহাহাহা করে হেসে উঠল স্বভাবসিদ্ধ ভাবে। গৌতমী ফিকে হাসল একটু। তারপর বলল, ‘নিশ্চই স্পেশাল কারুর ফোনের অপেক্ষায় আছেন, সেই জন্যই মন উচাটন হয়ে আছে আপনার। আজ বরং আপনি বাড়ি ফিরে যান। রেস্ট নিন’। মুরুগান উঠল। গৌতমী কি অভিমান করল? ঠিক বুঝল না মুরুগান। এত চাপা এই মেয়েটা, ওকে বোঝা একটু সমস্যার। আর এই বোঝাবুঝির পর্বে মুরুগান খুবই কাঁচা।
  কুগান নিশ্চিত হয়ে গেছিল। ও মুরুগানকে যেটুকু জানে, তাতে ও বুঝে গেছিল—মুরুগান আর যোগাযোগ রাখবে না তাদের সঙ্গে। সব শেষ হয়ে গেল, যেটুকু বাকি ছিল। ভেতরে ভেতরে খুব ভেঙে পড়েছিল কুগান। বিদ্যাকে কিছু খুলে বলতেও পারছে না। কুগান কি বোঝে না—বিদ্যা কতখানি অভাব বোধ করছে মুরুগানের? হয়ত যতটা বোকা বা এলেবেলে ওকে ভাবে সবাই, ও ততটা নয়। মুরুগানের ফোন আর কখনও খোলা পাবে না—কুগান জেনে গিয়েছিল। তার জানার বাইরেও যে অনেকখানি অজানা রয়ে গেছিল, কুগান জানত না। আর একবারও যদি কুগান ফোন করার চেষ্টা করত মুরুগানকে, এ কাহিনির পরিণতি বোধহয় অন্যরকম হতে পারত। কিন্তু নিয়তির কাছে সবাই কোনো না কোনো ভাবে বশ মানে, অজান্তেই। কুগান আর একবারও মুরুগানকে ফোন করল না, আর মুরুগানও নম্বর হারিয়ে দিশেহারা হয়ে ভাবল, কুগান আর বিদ্যা ঘাড় থেকে বোঝা ঝেরে ফেলেছে। দূরত্ব বাড়তে দিলে তা এতটাই বিস্তৃত আর সুদূরপ্রসারী হয়ে পড়ে, ওদের বুঝি জানা ছিল না।
   এদিকে রামলাল কোম্পানি হঠাতই একদিন বিনা নোটিশে অর্ধেকের বেশি মাল ফেরত দিয়ে চলে গেল। জানতে চাইলে বলল, কোয়ালিটি অনুযায়ী নাকি মাল দেওয়া হয়নি। বিদ্যার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল! অনেক কথাকাটাকাটি, উকিলের মারপ্যাঁচ চলতে থাকল দুপক্ষের। এদিকে যতটা মাল সাপ্লাই করেছিল ওরা, তার পুরো পেমেন্টই পেয়ে গেছিল বিদ্যা। সেদিক থেকে কোন ফাঁক রাখেনি রামলাল কোং। কিন্তু কোন অজুহাতে কোয়ালিটি খারাপের অজুহার দেখিয়ে মাল ফেরত এলো, সেটাও খোলসা করে বলছে না ওরা। তাদের কোম্পানির যা মূলধন, উন্নত মান, যা নিয়ে কোনরকম আপস করেনি ওরা। সেই মান নিয়ে বাজারে যদি গুজব রটে, বদনাম হয়ে যায় একবার, ওদের আর এই প্রতিযোগিতার বাজারে ব্যবসা করে খেতে হবে না। দুশ্চিন্তায় পাগল হয়ে যাবে মনে হচ্ছে এবার বিদ্যা। কুগান তো বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শুধু। আর রাও যদিও রামলাল কোম্পানির সঙ্গে পুরো ব্যাপারটা মিটিয়ে নিতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে, কিন্তু কতদূর কী হবে বুঝে উঠতে পারছে না বিদ্যা। অনেকগুলো টাকা আটকে পড়ে রয়েছে। রেডি প্যাকড্‌ মাল ঘরে ফিরে এসেছে উপরন্তু। প্রোডাকশন বাড়াতে আর ভরসা হচ্ছে না। তাহলে কি কোম্পানি বন্ধ করে দিতে হবে সাময়িক? নাহলে লেবার পেমেন্ট পর্যন্ত দেওয়া যাবে না। জমানো পুঁজি ভাঙিয়ে যদি লেবার পেমেন্ট করতে হয়, সেই ব্যবসা চালানোর থেকে বন্ধ করে দেওয়া ভালো। এইসব দুশ্চিন্তার মধ্যেই রাও জিজ্ঞেস করল, ‘আম্মা, আপাতত কি তবে কুলিলাইনে এক সপ্তাহের মজুরি দিয়ে ছুটি দিয়ে দেব? তারপরে নাহয় একটু সামলে আবার শুরু করা যাবে’। বিদ্যা ভাবল একটু। এছাড়া আর কীই বা করার আছে! তারপর ঘাড় নেড়ে রাওকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী করে সামলাবেন, কিছু ভেবেছেন আপনি? আমি তো কোন পথই দেখতে পাচ্ছি না সামনে। জানি না কী করব…’ রাও আশ্বাসের সুরে বলল, ‘এত হতাশ হবেন না আম্মা। আমি আমাদের পুরনো পার্টিদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য খবর পাঠিয়েছি। নিজে গিয়ে ওদের সঙ্গে কথা বলে আসব। নিশ্চই একটা না একটা রাস্তা বেরবে’।
  সারারাত ঘুমোয় না বিদ্যা। ছটফট করে। ওই লোকটার কথাই সত্যি হল তাহলে? সে ঠকে গেল ওদের কাছে? নতুন ভাবে ব্যবসা দাঁড় করাতে গিয়ে ভরাডুবি হবে? কী উত্তর দেবে বিদ্যা নিজেকে? আজ যদি মুরুগান থাকত, একটা না একটা উপায় বেরত ঠিকই। কিন্তু ওই স্বার্থপর তো নিজেই চলে গেছে। হারিয়ে গেছে ইচ্ছে করে। দূর থেকে মজা দেখছে ওদের বিপাকে ফেলে দিয়ে। ওর কি বোঝা উচিত ছিল না যে, বিদ্যা বা কুগান এত বড় একটা ব্যবসা চালানোর জন্য ততটা অভিজ্ঞ নয়? পাশে থাকাও যে অনেকটা মনোবল বাড়ায়, সেটাও কি ও বুঝল না? নিজের ভালো লাগাই সব হল ওর? আক্ষেপ, বিলাপ, হতাশা, ক্রোধ, সব একসঙ্গে পেড়ে ফেলতে চাইছে বিদ্যাকে। সামনে ঘন অন্ধকার। কোথাও কোন আলো দেখতে পাচ্ছে না বিদ্যা এই মুহূর্তে। রাও যতই আশ্বাস দিক, ও এটুকু বুঝেছে একবার বদনাম হয়ে গেলে, মার্কেটে সুনাম ফেরানো খুব কঠিন কাজ।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।