• Uncategorized
  • 0

গদ্যানুশীলনে তাপস কুমার বর

ভূত রহস্য

আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগের ঘটনা,আজ লিখতে বসেছি। আমি সুরেন্দ্র শেখর ভট্টাচার্য। বাবা ও মায়ের এক সন্তান। ছোট্টবেলা থেকে বাবা মায়ের কাছে যা চেয়েছি তাই পেয়েছি। পড়াশোনাতে বরাবর খুব ভালো। বাবা মায়ের নয়নের মনি। কলেজ পাস করে মাস্টার ডিগ্রির জন্য নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। সেখানে অত্যন্ত প্রিয় কয়েক জন বন্ধুর সাথে পরিচয় হলো আমার। সমর, পরিনিতা, যোগেশ, সোমনাথ ও মায়া। ওরা আমার অত্যন্ত কাছের মানুষ বিপদে-আপদে বরাবর কাছে পাই ওদের। একদিন যোগেশ তার জন্মদিনে বাড়িতে সকল বন্ধু বান্ধবদের ডেকেছিল। যোশের বাড়ি একটা প্রত্যন্ত গ্রামে।যার নাম মহেশপুর।একদিন আগে আমরা পাঁচজন যোগেশের বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিলাম। গ্রামে জনবসতি তেমন নেই। যোগেশ কে আমি জিজ্ঞেস করলাম,তোরা কতদিন ধরে এখানে বসবাস করছিস? যোগেশ বলেছিল… প্রায় চারপুরুষ ধরে এখানে বসবাস করে আসছে। যোগেশ বললো সে এ কথা দাদুর মুখে শুনেছে। যোগেশের জন্মদিনটা বেশ জমজমাট পরিবেশে মেতে উঠেছিল। খাওয়া দাওযায় কোন খামতি রাখেনি যোগেশ। আমি, যোগেশ,পরিনিতা,সমর,সোমনাথ আর মায়া, ছয়জন বন্ধু বান্ধবদের কথার মাঝে ভূতের প্রসঙ্গ আসে।কথাটা সেদিন না হলেই ভালো হতো। এখনো সেই কথা মনে পড়লে একটা ভয়ঙ্কর আতঙ্কের শিহরণ খেলে যায়,….
“আগুনের ফসফরাসের মতো চোখ,এক অট্টহাসি,প্রতিশোধের জ্বালায় জ্বলছে।”
পরিনিতা বললো,সুরেন্দ্র তুই কখনো ভূত দেখেছিস? আমি বললাম না!তবে কখনো দেখার সৌভাগ্য হয়নি।যোগেশ বলেছিল,তাহলে ছয়জন মিলে ভূত দেখে আসি চল। মায়া বললো,সত্যি ভূত কি আছে?
সমর বললো,দাদুর কাছে আমি অনেক রাক্ষস খোক্ষসের গল্প শুনেছি, কি ভয়টা না লাগতো। সোমনাথ রেগে গিয়ে বললো,…
“বাঙালিদের যতটা বীর ভাবি,ভূতেদের কাছে এরা পরাজিত সৈনিক”।
মায়া বললো,কখনো ভূতের সম্মুখীন হয়েছিস?তাহলে সেদিন মুখের কথায় বিশ্বাস করতাম!সোমনাথ রেগে গিয়ে মায়াকে কিছু জ্ঞানের বক্তব্য দিয়েদিল।পরিনিতা বললো ভূত না ছাঁই,যতসব ভন্ডামির ডিপো।এই কথা কাটাকাটির মাঝে একটা বাক দ্বন্দ্বের আক্রমণে এক বিচ্ছিরি পরিবেশ সৃষ্টি হলো। আমি আর যোগেশ অনেক কষ্টে সামাল দিয়েছিলাম ওদের কে। কিন্তু সোমনাথ নাছোড়বান্দা, সে ভূত বিশ্বাস করে না, উক্ত ঝাঁজালো কন্ঠে বলে,…
“মানুষের কল্পনা শক্তি এতোটাই প্রখর,তাতে কল্পনার ভয়ঙ্কর রঙ মিশিয়ে অহেতুক মানুষের মনে বিষাদ সৃষ্টি করা।”
এক রকম জেদের বসে, সকলকে প্রমান দিতে হবে।একদিন সকলে মিলে পোড়ো বাড়িতে সারারাত দিন কাটাতে হবে।সেদিন প্রমাণ হবে……, “ভূত আছে না নেই “।
দিনটা ছিল 12ই এপ্রিল।ঘোর অমাবস্যা রাত। যোগেশ বলেছিল, শিবগঙ্গের একটা ছোট্ট গ্রামে 30 কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে ঝাঁউ আর শিমুল গাছের জঙ্গল। ওখানে একটা শ্মশান আছে ঘন গাছপালায় ঘেরা।সেখানে একটা পোড়ো বাড়ি আছে,যার নাম “নীলকুঠি”। এখন বেশি একটা লোক ওখানে যায় না।তবে সুরেন্দ্র অর্থাৎ আমার একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি জাগছে মনে। কত না সেই ডিটেকটিভ বই পড়েছি,…
“আমার গল্পের নায়ক শ্যালক,কখনো বা ব্যোমকেশ,আবার কখনো ফেলুদা”
একটা আঁঠালো গন্ধ পাচ্ছে সুরেন্দ্র,যা ভূত রহস্যের মতো। যোগেশের বাড়িতে সেদিন সন্ধ্যে ছয়টায় ছয়জন বন্ধু বান্ধব খাওয়া দাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়লাম, ভূত রহস্যের সন্ধানে। আমি নিয়েছি একটা টর্চ,ভিডিও ক্যামেরা,চারটে মোমবাতি,একটা দেশলাই আর একটা পিস্তল। রাস্তায় যেতে যেতে সোমনাথ কোন কথা বললো না। হয়তো সে মৌনব্রত পালন করছে।কারণ আগের রাতের ওই রকম ঘটনাটা মনে মনে মেনে নিতে পারেনি, তাই হয়তো। তাই সে,……
“মনে মনে ফাইট করছে”।
যাই হোক নীলকুঠিতে পৌঁছতে প্রায় রাত 9 টা বেজে গেলো। সেদিন কি রকম একটা গুমোট পরিবেশ কেমন যেন।বাড়িটা এখনও খুব মজবুত। হয়তো তেমন লোক জনেরা আসেনা প্রায়,তাই আগমনের অপেক্ষায় সে নির্জনে প্রহরগুনে একাকি মনে কাঁদছে। বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে একটা বড়ো ঘন জঙ্গল। পাশে একটা শ্মশান। জঙ্গলে শিয়ালের কোরাস শুরু হয়ে গেছে,মনে হয়,….
“শিকারির আশায় আদি নরকঙ্কাল গুলো ঘুম থেকে জেগে উঠেছে”।
একদিকে প্যাঁচার ডাক, আবার আমাদের ছয়জন বন্ধু বান্ধবদের মাছখান থেকে হঠাৎ কোথা থেকে একটা কালো বেড়াল ভঙ্কর আওয়াজ করতে করতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। পরিনিতা,সোমনাথ,সমর ও মায়া ভয়ে আঁতকে উঠেছিল। আমি আর যোগেশ অনেক কষ্টে চারজনকে বোঝালাম।তারপর বাড়ি দরজা খুলে যেই ডুকতে যাবো কতগুলো কালো বেড়াল চিৎকার করতে করতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো।সকলে ভয়ে আঁতকে উঠেছিলাম,…..
“সে এক হাড়হিম করা ভয়”
সারা বাড়িতে একটা গুমোট গন্ধ কোথা থেকে আসছে তা বুঝতে পারছিলাম না। সারা বাড়িতে ঘোর অন্ধকার কিন্তু একটা বাড়ির কক্ষ সম্পূর্ণ আলাদা মনে হলো। টর্চের আলোয় আমি আর যোগেশ বাড়িটার কক্ষে দিকে এগিয়ে গেলাম। পেছন ফিরে তাকাতে কেউ যেন আড়াল করে পালিয়ে গেলো। এ দিকে হঠাৎ মায়ার চিৎকার শুনে আমি আর যোগেশ সেদিকে ছুটে গেলাম। বললাম কি হয়েছে? মায়া থরথর করে কাঁপছে, সে কিছু একটা বলতে চাইছে কিন্তু ঠিক ভাবে বলতে পারছেনা। সোমনাথ পরিনিতা,সমর ওরা ও ভীষণ ভয় পেয়েছে।আমি আর যোগেশ তৎক্ষণাৎ চার জনকে নিয়ে আমরা একটা কক্ষে প্রবেশ করলাম। যোগের কাছে মোমবাতি ছিল, মোমবাতি জালিয়ে সবাই ভাবতে বসলাম,এখান থেকে কিভাবে বেরোব।এ দিকে আবার মায়া কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। পর পর আমাদের সাহসটাও দিশাহারা হয়ে পড়ছে। মায়াকে বোঝালাম….”আমি যতক্ষণ তোদের সঙ্গে আছি তোদের কিছু হবে না”। হঠাৎ ঘড়িটা ঢং ঢং করে বারোটার ঘন্টায় বেজে ওঠলো,…
“শুরু হলো এক মায়াবী কান্না,অট্টরোহের হাসি।আমি প্রতিশোধ চাই,ওই মানুষের গন্ধের স্বাদে।”
সারা বাড়ির এক ভয়ঙ্কর বিভৎস কান্ড,কতগুলো সেই বিড়ালের আওয়াজ।রক্তহিম করা এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য। আমি আর যোগেশ বাড়ির দরজা খুলে হাতে টর্চ নিয়ে বেরিয়ে গেলাম, বাড়ির উপরের ছাদে উঠে যা দেখলাম,….
“বলার ভাষা সেদিন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল,গা থেকে শুধু ঘাম ঝরছে।”
ছাদের উপরে একটা আশি বছরের বৃদ্ধ চেয়ারের মধ্যে বসে আছে।আমাদের দেখে গম্ভীর গলায় বললো, এখানে এসেছো কেন?প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।আমি বললাম,আমরা ভূতের সন্ধান করতে এসেছি।বৃদ্ধ গম্ভীর গলায় বললো,ভূত যখন তখন কি দেখা দেয়,সেটা ভূতের নিজের উপর নির্ভর করে।তিনি কোথায়,কখন কিভাবে দেখা দেবে।যোগেশ বললো দাদু আপনি এই বাড়িতে কতদিন আছেন?বৃদ্ধ হাসলেন,মাথা নাড়লেন।তিনি বললেন তোমরা ভূত দেখতে চাও? সে এক ভয়ঙ্কর পৈশাচিক অট্টহাসি।আমি বৃদ্ধের পায়ের দিকে তাকাতে,স্পষ্ট দেখতে পেলাম “নরকঙ্কার”।যার গায়ে এক ফোঁটাও মাংস নেই। আমি যোগেশকে যেই বলতে যাবো,বৃদ্ধ মনের কথা বুঝতে পেরে,ফসফরাসের মতো উজ্জ্বল দৃষ্টিতে আমাদের দিকে হিংস্র ভঙ্গিতে তাকিয়ে আসল রূপ পরিবর্তন করলো। কি ভয়ঙ্কর সেই রূপ,সারা শরীরটা মাংস খোপলানো।সে কি পৈশাচিক অট্টহাসি ওই বৃদ্ধের। দুজনে বিপদের আশঙ্কা বুঝে,সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত বেগে নেমে সোজা সটান মায়াকে ডাক দিতে দরজা খুললে সাথে সাথে কক্ষে প্রবেশ করলাম।
আমাদের দু-জনের এই অবস্থা দেখে চারজন বন্ধু হতবাক হয়ে গিয়েছিল। ওরা জিজ্ঞাসা করলো কি হয়েছে? যোগেশ বললো,পরে বলবো। আগে এখান থেকে কি করে বেরোব সেটা ভাবো।আমি বললাম সোমনাথ তুমি মায়াকে তোমার সঙ্গে রাখবে আর সমর পরিনিতাকে সঙ্গে রাখবে। আমি আর যোগেশ প্রথমে থাকবো।আমরা যে পথ দিয়ে যাবো সেই পথ স্মরণ করবে তোমরা।তবে মায়া ও পরিনিতাকে একা ছেড়ে দেবেনা।মনের মধ্যে ভয় পেলে চলবে না, সামনের দিকে এগোতে হবে।কারণ যাদের সঙ্গে লড়াই তারা খুব ভয়ঙ্কর।এই রকম একটা প্লানিং করে আমরা সময় বুঝে এখান থেকে বেরিয়ে যাবো।বাড়িতে এখন,…
“ভূতেদের রাজত্ব চলছে,মানুষের রক্তের স্বাদ পেতে।বার বার দরজায় আঘাত,এক হাড়হিম করা ভয়”।
তখন ঘড়িতে প্রায় তিনটে বাজে,সকাল হতে আরো তিনঘন্টা।মাথা কাজ করছে না। এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা যায় না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম এখুনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবো সকলে। যা আছে কপালে হোক। প্রথমে আমি আর যোগেশ যেই দরজা খুলেছি,চারি দিকে ওই কালো বেড়ালগুলো ঘিরে রয়েছে। পকেট থেকে পিস্তল বের করলাম পিস্তল উচিয়ে, উপরের দিকে গুলি ছুঁড়লাম বার দুয়েক।তার পর রুদ্ধশ্বাসে দৌঁড়তে লাগলাম সকলে। পেছনে ধাওয়া করেছে নরকঙ্কাল রূপী সেই বৃদ্ধ আর জনা দশেক নরকঙ্কালও তার সঙ্গে ছুটছে।ওরা নরকঙ্কাল রূপী রাক্ষস সব।ওদের হিংস্র গর্জন দূর দূরে ভেসে আসছে,….
“বন্যায় ভেসে যাওয়া তরীকে বাঁচাতে ছুটছি আমরা;পাগলের মতো দিশেহারা।ওই নরকঙ্কালগুলো চায় আমাদের রক্ত মাংস ছিঁড়ে খেতে।”
জ্ঞানশূণ্য অবস্থায় প্রাণ নিয়ে ছুটছি।ছুটতে ছুটতে একটা লোকালয়ে পৌঁছালাম।একজন মুদিওয়ালা ভোরবেলায় আমাদের এই অবস্থা দেখে প্রথমে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। সকলকে তিনি ডেকে এক গ্লাস করে জল ছয়জনকে খেতে দিল।তার পর আমি আর যোগেশ সব কথা মুদির দোকানদারকে খুলে বললাম।মুদিওয়ালা এই কথা শুনে হতবাক।আরো বললেন, তোমরা যে প্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরতে পেরেছো এটা তোমাদের সৌভাগ্য। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে শ্যামচরণ হালদার ওই নীলকুঠি রাজমহলে বসবাস করতেন।তিনি ছিলেন খুব অত্যাচারী,শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করিয়ে টাকা পয়সা দিতো না।এই রকম কয়েক মাস কাটার পর,শ্রমিকরা এক্যবদ্ধ হয়ে শ্যামচরণ হালদারকে পিটিয়ে মেরে বাড়ির ছাদের ওপর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়। তার কয়েক বছর পর যারা তাকে মেরেফেলে ছিল, তারা কোন না কোন ভাবে মারা গেছে,কেউ অপঘাতে,কেউ বা গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে চাপা পড়ে।তারপর থেকে ওই বাড়ির ছাদে এই এলাকার অনেকে শ্যামচরণ হালদার কে অনেক বার বাড়ির ছাদে চেয়ারে বসে থাকতে দেখেছে।তারপর থেকে এই এলাকা এতোটাই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলো, সকল গ্রামবাসী ওখান থেকে পালিয়ে অন্য জায়গার বসবাস করতে শুরু করে। এদিকে তেমন একটা লোককে আসতে দেখা যেতো না।বাবা তোমরা যে প্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরতে পেরেছো এটাই পরম সৌভাগ্য তোমাদের।তারপর আমরা ছয়জন একে অপরের দিকে তাকালাম।তখনও বুকের মধ্যে ভয়টা জাপটে বসে আছে। ভোরের নতুন সূর্যোদয়ে আকাশের কালোমেঘ সরে গিয়ে ঝলমলে আলোর রোশনাই বিচ্যুরিত হলো এবং মন থেকে অতঙ্কটা একটু একটু করে সরে যেতে লাগলো।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।