এবার বলি অসাধারণ খেয়াল ও ঠুংরী গান যার কন্ঠে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিলো সেই সবচেয়ে বিখ্যাত ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী বড়ে গুলাম আলি খান সাহেব ও তাঁর ঘরাণা অর্থাৎ পাতিয়ালা ঘরাণার কথা ।
পাঞ্জাবের পাতিয়ালায়, পাতিয়ালার মহারাজের পৃষ্ঠপোষকতায় এই ঘরাণা গড়ে ওঠে । এই ঘরাণার পরতে পরতে যেন পাঞ্জাবী ছাপ । পাঞ্জাবীরা প্রকৃতিগত ভাবে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, খোলা মনে গান করতে ও নাচতে ভালোবাসে । উদ্দাম আনন্দের প্রকাশ তাঁদের বৈশিষ্ট । জাতিটি করিতকর্মা, কিন্তু চঞ্চল প্রকৃতির । পাতিয়ালা ঘরাণার খেয়াল ও ঠুংরিতেও ঠিক সেই ভাবের প্রকাশ । এটি মূলতঃ খেয়াল ও ঠুংরি ঘরাণা ।
ঠুংরি ও দাদরা খেয়ালের মতোই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অপর একটি ধারা । খেয়াল ভেঙে ঠুংরীর জন্ম । খেয়াল যেমন এক একটি শুদ্ধ রাগ রাগিনী নিয়ে গড়ে ওঠে, ঠুংরীতে মিশ্র রাগ-রাগিনীর প্রাধান্য । তার কথাতেও দেহাতী ভাষার ব্যবহার।বরষা ও বসন্তে প্রিয় মিলনের আকাঙ্খা ও প্রিয়ের বিরহ ব্যাথা এর মূল উপজীব্য । বাঈজীর কোঠায় তার বেড়ে ওঠা । সুরের চলনে নানা বৈচিত্র ও নানা রাগ-রাগিনীর ছায়া নিয়ে এই গান যেন মোচড় দিয়ে নিংড়ে নেয় মনের সব আবেগ। ঠুংরীতে মিশ্র খামাজ, পিলু, সোহিনী প্রভৃতি রাগ ব্যবহার হয়। এই গানে সাধারণতঃ তানের ব্যবহার হয় না। মধ্যলয়ে শুরু হয়ে দ্রুত লয়ে তবলার বোলে লগগি লড়ি করে শেষ হয় ঠুংরী। কথিত আছে পাতিয়ালার মহারাজারা খেয়ালের সঙ্গে সঙ্গে ঠুংরী, দাদরা ও গজল শুনতে খুবই পছন্দ করতেন।
পাতিয়ালা ঘরাণা প্রতিষ্ঠা করেন ফতে আলি ও আলি বক্স খান । এই ঘরাণায় খেয়ালে সম্পূর্ণ রাগের চেয়ে ষাড়ব ও ঔরব অর্থাৎ যে রাগের চলনে আরোহণে ও অবরোহণে সাতটির জায়গায় ছটি বা পাঁচটি স্বর লাগে সেই সব রাগগুলি বেশী গাওয়া হয়। কারণ এই রাগগুলি চঞ্চল এবং তাতে অতি সূক্ষ্ম হড়ক, কাজ ও মূড়কি ব্যবহার করা সহজ । পাতিয়ালা ঘরাণার গায়নে অলংকরণ ও বিচিত্র তানের ব্যবহার খুব বেশী ।
এই ঘরাণার সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত শিল্পী বড়ে গুলাম আলি খান । তাঁর জন্ম হয় ব্রিটিশ ভারতের অধীনস্ত পাঞ্জাবের কসুরে। স্বাধীনতার পর কসুর পাকিস্থানের অন্তর্ভুক্ত হয় । বড়ে গুলাম আলি পাকিস্থানে চলে গিয়েও পরে ভারতে পাকাপাকি ভাবে চলে আসেন । কথিত আছে তাঁর বিখ্যাত ঠুংরী “ইয়াদ পিয়া কি আয়ে হায় রাম”এ “হায় রাম” কথাটি ব্যবহারে আপত্তি তুলেছিলেন পাকিস্থান সরকার এবং সেখানে হায় আল্লা বলতে বলা হয়েছিল । বড়ে গুলাম আলি বলেন যে তিনি হিন্দু মুসলমান সব ধর্মকে সমান ভাবে দেখেন এবং এক্ষেত্রে হায় রাম কথাটিই মানায়। সুতরাং তিনি কখনোই তা পরিবর্তন করবেন না । তিনি এটিকে তাঁর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হিসাবে দেখেন এবং রুষ্ট হয়ে পাকিস্থান ছেড়ে ভারতে চলে আসেন । মুম্বইয়ের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মোরারজী দেশাই তাঁকে মুম্বইতে বসবাসের ব্যাবস্থা করে দেন।
বড়ে গুলাম আলি এর পর অসংখ্য অনুষ্ঠানে ও রেডিওতে খেয়াল ও ঠুংরী পরিবেশন করে শ্রোতাদের মনোহরণ করেন । কলকাতায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সমঝদার শ্রোতার কাছে বড়ে গুলাম আলির গান অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। কথিত আছে শীতের কলকাতায় বিভিন্ন মিউসিক কনফারেন্সগুলিতে যখন তিনি গাইতে আসতেন শ্রোতারা টিকিট না পেলেও রাত্রে অত শীতের ভিতরেও বাইরে ফুটপাথে বসে সারারাত অপেক্ষা করতেন বাইরে লাগানো মাইকে তাঁর গান শোনার জন্য ।
বড়ে গুলাম আলি খেয়াল গানগুলি গাইতেন অত্যন্ত ছোট ছোট করে। বিস্তার অংশ থাকতো খুবই কম। বিচিত্র দ্রুত তানকারী থাকতো প্রচুর এবং তারপর তাঁর সেই বিখ্যাত ঠুংরীগুলি শোনার অপেক্ষায় থাকতো বিশাল জনতা ।
পিতা আলিবক্স ও কালে খানের কাছে এই ঘরাণার সঙ্গীত শিক্ষা করলেও উনি নিজের স্টাইল তৈরী করেন বেহেরামপুরী ধ্রুপদ, জয়পুর ও গোয়ালিয়র ঘরাণার গায়নের সঙ্গে পাতিয়ালার স্টাইল মিশিয়ে । কে আসিফের অনুরোধে বড়ে গুলাম আলি মুঘল এ আজম সিনেমায় সোহিনী রাগে দুটি অসাধারণ ঠুংরী করেন । তাঁর এই গানের মধ্যে দিয়েই সেলিম ও আনারকলির প্রেম প্রকাশ পায় । সিনেমায় গাইতে চান নি বলে তিনি এক একটি গান গাইবার জন্য তিনি ২৫০০০ টাকা চেয়েছিলেন । কিন্তু তাই দিয়েই তাঁকে গাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন পরিচালক । তখন লতা মঙ্গেশকর, রফি প্রভৃতি গায়ক এক একটি গান গাইতে ৫০০০ টাকা নিতেন । বড়ে গুলাম আলি সঙ্গীত নাটক আকাদেমী পুরস্কার ও পদ্মভূষণ উপাধী লাভ করেন । ১৯৬৮ সালে হায়দ্রাবাদে বসির বাগ প্যালেসে দীর্ঘ অসুস্থতার পর তাঁর মৃত্যু হয় ।