।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় উত্তম দত্ত

চিত্রগুপ্তের টংঘর ও নদীতীরের গন্ধর্ব-দম্পতি

ভার্সিটি ক্যাম্পাসের গা ঘেঁষে একটা খরস্রোতা নদী। নদীর কিনারায় একটা উঁচু টংঘর। সে ঘরের একদিকে একটা বড় দেয়াল। দেয়ালের গায়ে অন্তত এক হাজার জোড়া নতুন ও প্রাক্তন প্রেমিক-প্রেমিকার নাম লেখা। বিজন + ব্রততী… অরণি + উজ্জয়িনী… স্যাম্বি + ধানসিড়ি… চিত্রভানু + আলোলিকা…
অবশিষ্ট তিনদিক ফাঁকা। ওপরে কংক্রিটের ছাদ। ছাদের ঠিক মাঝখানে একটা লোহার হুক। এখান থেকে নদীর জল দেখলে মনে হত, পৃথিবীতে মৃত্যু ও দুঃখ বলে কিছু নেই।
দিনে আমাদের রাজত্ব ছিল এই ঘর। রাতে প্রেতাত্মারা এসে অদ্ভুত সব কবিতা লিখত দেয়াল জুড়ে। চিত্রভানু মারা যাবার পর থেকেই এই কাব্যিক উপদ্রব শুরু হয়। মাঝে মাঝে অপ্রত্যাশিত কিছু মন্তব্যও লেখা থাকত গোলাপি ও নীল চকে।
আমরা সেসব নিয়ে মজাই করতাম। আমাদের মধ্যেই যে এক বা একাধিক ভূত লুকিয়ে আছে সেটা জেনে উপভোগ করতাম ব্যাপারটা। কিন্তু মুখে বলতাম, এই দ্যাখ দ্যাখ চিত্রভানু কাল রাতে কী লিখে গেছে ঃ
* ‘তোমার মুখের ভিতরে কবিতার নীল শব সারারাত ভাসে।’
* ‘রাতপরিদের ডানায় আমি লিখে দিয়ে যাব, মৃত্যু কত সুন্দর।’
চিত্রভানু সেনগুপ্ত। বাঁকুড়া থেকে এসেছিল। দুর্দান্ত কবিতা লিখত। আলোলিকা একদিন ওকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেছিল ঃ
‘তোর এইসব কবিতা ডাস্টবিনের ওয়ালেও ছাপা হবে না।’
ওদের সম্পর্কে নানা জট এসে গিয়েছিল। আলোলিকাকে প্রায়ই দেখা যেত রণিতের হাত ধরে আজ শঙ্খ ঘোষের বাড়ি কাল সুনীল গাঙ্গুলির ফ্ল্যাটে যাচ্ছে। রণিত গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয় করত, ভালো কবিতা লিখত। একটা দুটো পুরস্কারও পেয়েছে।
একদিন সকালে চিত্রভানুর ঝুলন্ত লাশ পাওয়া গেল টংঘরে। একজন চোর প্রথম খবরটা দেয় পুলিশে। পুলিশ আলোলিকাকে গ্রেফতার করে। চিত্রভানুর বুক পকেটে একটা চিরকুটে অবশ্য লেখা ছিল তার সুইসাইড নোট ঃ ‘ আমার মৃত্যুর জন্য আলোলিকা দায়ী নয়।’
সেই থেকে আমাদের মুখে মুখে ওই ঘরের নাম হয়ে যায় ঃ চিত্রগুপ্তের টংঘর।
সেই টংঘরের আড্ডায় জীবনের সবচেয়ে সুন্দর আর সবচেয়ে কদর্য বিষয় নিয়ে সানন্দে আয়ুক্ষয় করতাম আমরা। আড্ডায় উঠে আসত কাম্যুর ‘আউটসাইডার’, মার্কেজের ‘শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা’, শেলির ‘ প্রমেথিউস আনবাউন্ড’….. উঠে আসত মানুষের সঙ্গম-পদ্ধতির নানা মুদ্রা, নারীশরীরের নানা অন্ধিসন্ধির রূপরেখা। মেয়েরাও সোল্লাসে যোগ দিত সেইসব সু এবং কু আলোচনায়।
এক একদিন টংঘরের ওপর থেকে আমরা দেখতাম কিছু দূরে নদীর কিনারায় একটা বাঁশ ও খড়ের চালার নীচে দুজন খর্বাকৃতি কুষ্ঠরোগীর সংসার।
দুজনেরই দু তিনটে আঙুল খসে গেছে হাতের ও পায়ের। মেয়েটির নাক নেই। শুধু দুটি ছিদ্র। ঠোঁট নেই। দেখে মনে হয় সবসময় হাসছে। পুরুষটির ভুরু খসে গেছে। গায়ের চামড়া কালচে তামাটে, ফোলা ফোলা। নীচের ঠোঁট নেই। নাকের ডগায় দগদগে লাল ঘা।
এক একদিন সন্ধের পর ঘুরঘুট্টি অন্ধকার নেমে এলে চিত্রভানুর প্রেতাত্মার সন্ধানে এসে আমি দেখেছি খড়কুটো দিয়ে নদীর ধারে আগুন জ্বালিয়েছে ওরা। হঠাৎ একটা আর্ত চিৎকার। তারপর জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে একজন ছুঁড়ে দিল সদ্য খসে যাওয়া একটা আঙুল। দূর থেকে নৈশ বাতাসে ভেসে আসছে মানুষের মাংসপোড়া গন্ধ। সেই গন্ধে নদীগর্ভ থেকে উঠে আসত জলদেবতারা। দূরের কাশবন থেকে শোনা যেত শেয়ালের সমবেত আর্তনাদ। শেয়ালের ডাকে একটা ছমছমে বিষাদ ছড়িয়ে পড়ত সমস্ত চরাচরে। সোনালি বুদবুদের মতো সমস্ত নদীর চরে উড়ে বেড়াত অগণন জোনাকির আলো।
আমরা পুরুষটির নাম দিয়েছিলাম শাম্ব। মেয়েটির নাম নীলাক্ষী। একদিন দুপুরের রোদে শাম্ব নদী থেকে জল তুলে এনে নীলাক্ষীকে স্নান করিয়ে দিচ্ছিল। আমাদের সুদর্শন বন্ধু স্যাম্বি হঠাৎ মেয়েটিকে ভালো করে জরিপ করে নিয়ে বলল ঃ
‘ লক্ষ করেছিস, মেয়েটা প্রেগন্যান্ট। ‘
কেউ কেউ হেসে উঠল।স্যাম্বি আপন মনেই জিজ্ঞেস করল ঃ ‘ ওরা ঐসব করে কখন? ‘
ধানসিড়ি তাকে ছদ্ম ধমক দিয়ে বলল ঃ
‘ তাতে তোর কী? যখন ইচ্ছে করুক। তোকে দেখিয়ে দেখিয়ে করবে নাকি? ইডিয়ট! ‘
সৃঞ্জয় বলল ঃ
‘ ধানসিড়ি, তুই সিরিয়াসলি ব্যাপারটা ভাব। ঠোঁট নেই, নাক নেই, মেয়েটার ব্রেস্টও নেই। দু’তিন মাস অন্তর কারো না কারো একটা করে আঙুল খসে যাচ্ছে। তার মধ্যেই এত প্রেম আসে কী করে?’
কোণারক জানালো ঃ
‘আমি দেখেছি, শাম্ব প্রতি হাটবারে কসাইদের কাছ থেকে ছাগলের মাংস চেয়ে আনে। মসলা পিষে দেয় পাথরে। আর নীলাক্ষী ইঁটের উনুনে আগুন জ্বালিয়ে সেই মাংস রান্না করে। তারপর পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দম্পতির মতো নদীর স্রোত দেখতে দেখতে মুখোমুখি বসে গরম ধোঁয়া ওঠা মাংস-ভাত খায়।
শুনেছি যাদের লেপ্রসি আছে তারা মাংস খেতে খুব ভালোবাসে। হয়ত ভাবে, মাংস খেয়ে খসে যাওয়া মাংসের অভাব পূরণ করবে।’
তাও তো রাতের দৃশ্য এরা দেখেনি। আমি দেখেছি। নদীর চরে ভুবনমোহিনী জ্যোৎস্না ফুটলে ওরা পাশাপাশি হাঁটে, গান গায়, পরস্পরকে আদর করে। একদিন রুপোলি নদীর চরের ধবল বিছানায় আমি ওদের সঙ্গম দেখে ফেলেছিলাম। সঙ্গম শেষ করে ওরা বালির ওপরে হাঁটু মুড়ে বসে আকাশ ও জলের দেবতার কাছে প্রার্থনা করছিল। কী চেয়েছিল ওরা? একটা রোগমুক্ত সুস্থ সন্তান? কী জানি! দূর থেকে আমি ওদের প্রার্থনা শুনতে পাইনি। হয়ত আমিই মনে মনে চেয়েছিলাম, এই অভিশপ্ত গন্ধর্ব-দম্পতির ঘরে একটি কুষ্ঠরোগমুক্ত শিশু এসে হামাগুড়ি দিক।
এর কয়েক মাস পরে চিত্রভানুর প্রেতাত্মা টংঘরের দেয়ালে কয়েকটি অদ্ভুত কথা লিখে যায় ঃ
* নীলাঞ্জনা ফার্স্ট ক্লাস না পেলে বিক্রম উর্বশীর কাছে চলে যাবে।
* যাজ্ঞসেনীর ব্রেস্ট যথেষ্ট ম্যাগনেটিক নয় বলে অর্জুন সুভদ্রার দিকে টাল খাচ্ছে।
* স্যাম্বি যতই দামি ফুল স্লিভ শার্ট পরে আসুক না কেন ওর গোপন রহস্য ধানসিড়ির কাছে ফাঁস করে দিয়েছে এক গদ্দার।
সেদিনকার এই তিন মন্তব্য আমাদের ভয়ংকরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রথম দুটিকে আমরা লঘু পরিহাস বলেই ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ কথাটি পড়ে স্যাম্বি রাগে আগুন হয়ে যায়। দিশাহারা আক্রোশে সন্দেহভাজন বন্ধুদের কলার ধরে ঝাঁকাতে থাকে সে। আমার আর অনুষ্টুপের সঙ্গে রীতিমতো হাতাহাতি হয়ে যায়। গদ্দারকে সনাক্ত করতে না পেরে সে বাইক নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায়। ধানসিড়ি তাকে কী একটা বলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু স্যাম্বি পাগলের মতো ছুটে বেরিয়ে যায় টংঘর থেকে। তার মুখ টকটকে লাল, চোখের কোণে জল।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা হতভম্ব হয়ে যাই। ধানসিড়িকে বললাম, তুই কিছু জানিস?
সে চুপ করে থাকে। দূরের নদীর দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ হয়ে যায় আরো।
মেয়েরা খুব চাপাচাপি করাতে সে শুধু জানালো, স্যাম্বির দুহাতে লেপ্রসি আছে। গোপনে ট্রিটমেন্ট চলছিল। পরশুদিন একজন এসে আমাকে খবরটা দেয়। প্রথমে বিশ্বাস করিনি….. দু’রাত ঘুমোতে পারিনি। অনেক ভেবে কালই ডিসাইড করেছি, ওর সঙ্গে এই রিলেশানশিপটা আর রাখা যাবে না। আজই ওকে ডিসিশানটা জানিয়ে দেব ভেবেছিলাম। কিন্তু তার আগেই….
ধানসিড়ি থমথমে মুখে চলে গেল। একবারও পিছনে তাকিয়ে দেখল না। আমরাও তিনদিন আর টংঘরে যাইনি কেউ। ঠিক চারদিনের মাথায় এক রাত্রিতে আমার হস্টেলের দরজায় কড়া নাড়ল লোকাল থানার পুলিশ। শুনলাম টংঘরের সিলিং থেকে স্যাম্বির লাশ পাওয়া গেছে । বডি সেখানেই আছে এখনো।
সেদিন সমস্ত আকাশে ছিল বসন্তের উন্মত্ত জ্যোৎস্না। নীচে নদীর বুকে ছুটে চলেছে ফসফরাসের মতো জলস্রোত। টংঘরের ধুলোভর্তি মেঝের ওপরে শুয়ে আছে স্যাম্বির ছ ফুট দীর্ঘ উজ্জ্বল কাঞ্চনবর্ণ নিথর শরীর।
পুলিশ অফিসারটি আমাদের প্রশ্ন করে করে ছোট্ট নোটবইতে লিখে নিচ্ছে ঃ
নাম — শাম্বসুন্দর মিত্র ওরফে স্যাম্বি।
বাবা— কৃষ্ণেন্দুবিকাশ মিত্র।
বয়স — ২২
***
বড় বড় টর্চের আলো জ্বালিয়ে পুলিশের লোকেরা মৃতদেহের ছবি তুলছে। ডোমেরা লাশ তুলে নিল ভ্যানে। বডি পোস্ট মর্টেমে যাবে। আমাদেরও আধঘন্টার মধ্যে থানায় পৌঁছোতে বলে পুলিশের লোকেরা ফিরে গেল।
আর তক্ষুনি আমার চোখে পড়ল নীলাক্ষী আর শাম্বর নদী তীরবর্তী চালা ঘরে আজ আলো জ্বলছে। আশ্চর্য এক অলৌকিক আলো। ভেসে আসছে নতুন শিশুর কান্না। মনে হলো জলের দেবতারা নদী থেকে উঠে এসে হাতে হাত ধরে ঘিরে রেখেছে জ্যোৎস্নাবিধুর কুঁড়েঘরটিকে। শাম্ব জল ও আকাশের দেবতাকে প্রণাম জানিয়ে নীলাক্ষীর ওষ্ঠহীন মুখে তার নশ্বর জীবনের শ্রেষ্ঠ চুম্বনটি এঁকে দেয় নিঃশব্দে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।