নব্বইয়ের গল্প শোনানো প্রায় শেষের দিকে। আর গল্প যত শেষ দিকে যায়, হিসেব-নিকেশ বাড়তে থাকে, কি বললাম, কতটুকু বললাম। এভাবেই ভাবতে ভাবতে হঠাৎই খেয়াল পড়ল, আরে! বন্ধুদের কথাই তো বাকি রয়ে গেল। কল্পনার কথা বললাম, যাদের সঙ্গে কল্পনায় একসঙ্গে বাঁচতাম, খেলার কথা বললাম কিন্তু যাদের সঙ্গে খেলতাম, নাচগান এর কথাও বললাম কিন্তু যারা সঙ্গী ছিল তারাই বাদ! সে কি করে হয়? তার ওপরে তাদের অনেকেই আমার এই লেখার নিয়মিত পাঠক, আর তারা মান অভিমানেরও বিশেষ ধার ধারে না। কে জানে, বাদ পড়লে কখন এসে চড়াও হবে! নিরীহ মানুষ আমি, প্রাণের ভয় তো আছে!
সে যাক, তাহলে ‘আমড়াতলার মোড়েই’ ফিরে আসি। মানে নব্বইয়ের দশকে। আমাদের ছোটবেলা থেকে কৈশোর, ছেলেবেলা থেকে মেয়েবেলায় যাওয়ার সময়ে। সেই মোবাইল-কম্পিউটার রসে বঞ্চিত হয়ে বাইরে ঘোরা, বই পড়া,পাড়া বেড়ানোর সময়ে। যখন পাড়ায় পাড়ায় ছেলেমেয়েদের দল থাকত, খেলাধুলো,নাচগান,সমাজসেবার জন্য। ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠত ক্লাব। একটা ক্লাবের সদস্যদের মধ্যে ঝগড়া হলে পরদিনই আরো একটা ক্লাব খোলা হয়ে যেত। এরকম আমাদের পাড়াতেও ছিল, দু’দুটো। একটা ফুটবলের, সঙ্গে বছরে একবার রক্তদান শিবির হত, ফুটবল না বুঝলেও, রক্তদান শিবিরের ভলান্টিয়ার হওয়ার ব্যাজের প্রতি লোভ ছিল বিলক্ষণ, এক আধবার সেটা জুটেও যেত। আর অন্য ক্লাবটা পাত্তা পেত একমাত্র কালী পুজোর সময়। আসলে ছোটবেলা থেকেই শিখিয়ে রাখা হয়েছিল যে পাড়ার ক্লাবগুলো বিড়ি সিগারেট খাওয়া আর মিঠুন গোবিন্দার সিনেমা দেখা বখাটে ছেলে আর ঝগড়াটি ফেলটুস মেয়েদের আড্ডা, ‘ভালো মেয়েরা'(?) ওখানে যায় না। তার ওপর অতি উৎসাহী মেম্বাররা ‘রকি সেন্টার’ নামকরণ করে ক্লাবের কৌলিন্য আরো ঘুচিয়েছিল। তখন তো আর রকি, ওরফে সিলভেস্টার স্ট্যালোন মহাশয়কে চিনতাম না, বরং পাড়ায় ‘গুপ্তকুঞ্জ'(আসলে বলতে চেয়েছিল গুপ্তদের বাড়ি, কিন্তু শব্দ মাহাত্ম্যে ব্যাপারটাই…) বাড়ির মহাপাজি অ্যালসেশিয়ান কুকুরকেই ‘রকি’ নামে জানতাম। ফলে বলাই বাহুল্য, ঐ ক্লাবের ব্যাপারে নাক উঁচু হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু তা সত্ত্বেও কালীপুজোর ভাসানের সময় ঐ বখাটে ছেলে আর ফেলটুস মেয়েদের দল সেজেগুজে ঠাকুরের সঙ্গে ব্যান্ডপার্টি নিয়ে নাচতে নাচতে গঙ্গার ঘাটে যেত, সেদিন দরজা ধরে ওদের দেখতে একবারও ভুল হয়নি। ইচ্ছে করত খুব, ওরা ডাকতোও, কিন্তু যাওয়ার অনুমতি কোনোদিন পাইনি।
এরকমই যখন অবস্থা, তখন ইচ্ছে হল নিজের একটা দল গড়ার,তাদের নিয়ে খেলার, বড় দিদিদের মত শাসন করার, নাচগান করার, দাদাদের মত ফিস্ট করার। বলা ভালো, ইচ্ছেটা ছিল আমাদের দু’জনের, আমার, আর আমার বর্তমানে দিল্লিপ্রবাসিনী হরিহর আত্মা বান্ধবীর। এতদিন আমরা দুজনেই খেলেছি, খেলনাবাটি, পুতুল, ছোটাছুটি, ধুলোকাদা, দাপিয়ে বেড়িয়েছি বর্ষায় জমা জল, দুর্গা হয়ে খুঁজেছি কুড়িয়েছি কাঁচা আম, খেজুর, জাম, ফলসা, সত্যবতী হয়ে ‘ঝাঁপাই ঝুড়েছি’ পুকুরে। কিন্তু বড় হতে হতে সবকিছু অন্যরকম হয়ে যাচ্ছিল। আমাদের থেকে ছোটরা ‘এলেবেলে’ বা ‘দুধভাত’ থেকে খেলার যোগ্য হয়ে উঠছিল, আমাদের লেখাপড়া বাড়ছিল, স্কুলের সময়ও, আমরাও সর্দারি করায় মন দিয়েছিলাম বেশি। সেসময়ই একে দুইয়ে হাজির হয়েছিল অনেকগুলো মেয়ে, দুএকটা ছেলেও ছিল প্রথমদিকে, পরে তারা দল ছেড়ে চলে যায়। তাদের নিয়ে দল বেঁধে খেলা চলত, তাদের ওপর রীতিমতো দিদিগিরি আর শাসনও।সারা বছরের খেলার পাশাপাশি, রথ টানতে যাওয়া, রথের পয়সায় জিলিপি খাওয়া,দোলের দিন রং খেলা, কালীপুজোয় বাজি পোড়ানো সব চলত। সস্নেহ প্রশ্রয় ছিল বড়দেরও। স্কুলের মাঝামাঝি ক্লাসে পড়ার সময় সবাইকে নিয়ে প্রথম নাটক, ‘লালকমল-নীলকমল’। একটাই খোক্কস পাওয়া গিয়েছিল, রাক্ষসী রানী এসেছিল বেনারসি শাড়ি পরে, সেজেগুজে, একবারও নিজমূর্তি ধরেনি, জটিবুড়ির মুখটা এতো মিষ্টি ছিল যে সবাই আদর করত,ভয় পাবে কে! এতকিছু গোলমালের পরেও সেটা ছিল আমাদের দলের প্রথম নাটক। এবং একটা নতুন অধ্যায়ের শুরুও বটে।
এই অধ্যায়, যা চলেছিল বেশ কিছু বছর। এর মধ্যেই আমাদের ছোট থেকে বড় হওয়া, স্কুল থেকে কলেজ, ইউনিভার্সিটি, ঋতুরঙ্গ থেকে ভানুসিংহের পদাবলী। দলের প্রতিটি মেয়ের গুটিপোকা থেকে প্রজাপতি হয়ে ওঠা। ‘আলোর মত হাসির মত কুসুমগন্ধরাশির মত’ ছড়িয়ে পড়া। এ সময় সুরে ভরে থাকা প্রতি গ্রীষ্মের বিকেলের, রিহার্সাল এর মাঝে গরম শিঙাড়ার, প্রতি শীতের ব্যাডমিন্টনের, প্রতি পুজোয় অষ্টমীর আড্ডা আর একসঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার,শীতে ছাদের ফিস্ট আর পড়ন্ত রোদে কমলালেবু খেতে খেতে চন্দ্রবিন্দুর গান গাওয়ার। দলের নামও ছিল, ‘মেলবন্ধন’ , সদস্যদের সবথেকে বড় আমার দিদি, সবচেয়ে ছোটটির বয়স মাত্র তিন। নিজেদের বলতাম ‘মেলবন্ধনের ফি-মেল’। বয়সের সীমা ছাড়িয়ে ছিল এক অনায়াস বন্ধুত্ব।
সে বন্ধুত্বের রেশ আজও মিলিয়ে যায় নি। আজও দেখা হয়, জন্মদিনে, অন্য কোনো অনুষ্ঠানে, হুল্লোড় হয় দোলের আবির রং আর তারপর জল ছিটিয়ে। সময় এগিয়েছে, আমরা সবাই নিজের নিজের কাজের ক্ষেত্র খুঁজে নিয়েছি, বাড়ি, শহর এমনকি রাজ্যও ছেড়েছে কেউ কেউ, তাও কোথাও কিছু আছে। সেই নব্বইয়ের স্মৃতিচারণের রেশটুকুর মত। এটা যাওয়ার নয়।