Cafe কলামে – অরুণিতা চন্দ্র – ২

অথ শিব- পার্বতী দাম্পত্য প্রেমকথা

আত্মার পবিত্রতা 

এই কাহিনী শিব-পার্বতীর বিবাহ পরবর্তী মধুচন্দ্রিমা কালের। এ কাহিনী জীবনের এক চরম সত্য অনুধাবনের। বিবাহের পরেই যখন নবদম্পতি উমা-মহেশ্বর বিশ্ব পরিভ্রমণ করতে নির্গত হলেন তখন বারাণসী ভ্রমণকালে পার্বতী লক্ষ্য করলেন প্রীতিদিন হাজারে হাজারে লাখে লাখে মানুষ দূরদূরান্ত থেকে গঙ্গাস্নানে আসেন নিজ পাপস্খলন করতে এবং মোক্ষলাভের উদ্দেশ্যে।
“স্বামী গঙ্গাস্নানের মাধ্যমে এই সব মানুষেরই মোক্ষলাভ কি সম্ভব?”
পার্বতীর প্রশ্নের উত্তরে হাস্য করে মহাদেব জানালেন খুব সামান্য সংখ্যক মানুষই মোক্ষলাভ করতে সক্ষম হবে।
“প্রিয়ে যারা পবিত্র চিন্তা এবং একনিষ্ঠ ভক্তিসহকারে গঙ্গাস্নান সম্পন্ন করে এবং স্নান সমাপনপুর্বক পুনরায় কোন পাপকার্যে লিপ্ত হয় না একমাত্র তারাই মোক্ষলাভের যোগ্য। বেশিরভাগ মানুষই গঙ্গাস্নানকে পুণ্য ক্রয় করার আনুষ্ঠানিক মাধ্যম বলে মনে করে যেমন হাট থেকে তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করে থাকে। এর পরিণতিতে নিজ অহংকে তৃপ্ত করা ব্যতীত অন্য কোন লাভ ই তাদের হওয়া সম্ভব না। যাদের হৃদয় পবিত্র, ঈশ্বরের প্রতি যাদের শ্রদ্ধা অবিচল তারা পৃথিবীতে থেকেই মোক্ষলাভ করতে সক্ষম। গঙ্গাস্নান তো এক বাহ্যিক ক্রিয়া মাত্র।“
স্বামীর উত্তরে উমা সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি প্রশ্ন করলেন দূরদূরান্ত বহু কষ্টস্বীকার করে এত মানুষ যে তীর্থযাত্রা য় আসেন তাঁদের কোনরূপ আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটেনি এ কিকরে মানা যায়?
তাই মহাদেবের কথার সত্যতা যাচাই করতে পার্বতী একটি পরীক্ষার প্রস্তাব দিলেন। নববধূর অনুরোধ রক্ষার্থে মহাদেব এক অসুস্থ কুষ্ঠরোগীর রূপ নিলেন পার্বতী হলেন তাঁর রূপবতী তরুণী ভার্যা। গঙ্গার ঘাটে পৌঁছে পার্বতী পুণ্যার্থীদের জনেজনে অনুরোধ করতে লাগলেন তাঁর স্বামীকে গঙ্গাস্নান সম্পন্ন করতে সাহায্য করার জন্য যাতে পবিত্র গঙ্গায় অবগাহন করে তিনি রোগমুক্তিলাভ করতে পারেন। কিন্তু বেশীরভাগ মানুষই তাঁর কাতর অনুরোধ শুনেও না শোনার অভিনয় করল। কিছু মানুষ বিরক্ত হল কুষ্ঠরোগীকে দেখে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করল কিছু মানুষ মৌখিক দয়া দেখালেও কোনরূপ সহায়তা করতে অগ্রসর হলনা। পার্বতীর রূপলাবণ্য আবার কিছু ব্যক্তিকে প্রলুব্ধ করে তুলল তারা প্রস্তাব দিল ওই কুষ্ঠরোগীকে পরিত্যাগ করে তাদের বিবাহ করার। অনর্থক নিজ যৌবনকে ওই কুষ্ঠরোগীর সাথে ব্যর্থ না করার। পার্বতীর ক্রুদ্ধ মূর্তি দেখে অবশ্য তারা অধিক উপরোধের সাহস করল না। এভাবেই অর্ধদিবস অতিক্রান্ত হল।
সূর্যাস্তের সময় নিকটবর্তী হল কিন্তু তথাপি কুষ্ঠরোগীকে সহায়তা করতে কোন পুণ্যার্থী র আগমন ঘটল না। নিরাশ হয়ে উমা যখন ছদ্মবেশ পরিত্যাগের কথা চিন্তা করছেন সেসময়ই এক ব্যক্তি তাঁদের সম্মুখে উপস্থিত হলেন।
“আসুন ভদ্র, আমি আপনার স্নান সম্পন্ন করাচ্ছি” কোনরূপ সংকোচ না করে কুষ্ঠরোগীকে বহন করে সেই ব্যক্তি নদীগর্ভে অবতরণ করলেন এবং তাঁর পুণ্যস্নান সমাপন করালেন। কার্য সম্পাদনার পর দম্পতিকে প্রণাম করে বিনা বাক্যব্যায়ে সেই সহৃদয় ব্যক্তি সেই স্থানত্যাগ করলেন।
“ প্রিয়ে কোনরূপ প্রত্যাশা ব্যতীত এই ব্যক্তি এক অচেনা কুষ্ঠরোগীকে সহায়তা করেছে। এই নি:স্বার্থ প্রাণের মোক্ষলাভের জন্য গঙ্গাস্নানের কি প্রয়োজন। মোক্ষ তো সে ইতিমধ্যেই লাভ করেছে। মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে সে অনুভব করছে তাই এক কুষ্ঠরোগীকে স্পর্শে তার কোন সংকোচ নেই। বাহ্যিক রূপ তাই তার কাছে অগুরুত্বপূর্ন।“
অত:পর সন্ধ্যার দিগব্যাপি অন্ধকারে উমা-মহেশ্বর নিজরূপ ধারণ করে পুনরায় নিজ যাত্রাপথে গমন করলেন।
পার্বতীকে দেওয়া শিক্ষায় এভাবে মহাদেব বিশ্বকে অবগত করলেন বাহ্যিক আড়ম্বরে নিজ আত্মার পবিত্রতা লাভের আমরা বিস্মৃত হয়ে থাকি। তবু ওই সহৃদয় ব্যক্তির মত কিছু মানুষের অস্তিত্বর কারণেই পৃথিবী আজো বাসযোগ্য।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।