প্রবন্ধে চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য

শ্রীজগন্নাথের রথ অপেক্ষায় মাজারের সামনে

“আহে নীলা শিলা, প্রবাল মত্তো বরণ
মো আরতা নলিনী বন কু কর দলন”
পুরীর বা ওড়িশার যে কোনও জগন্নাথ মন্দিরে গেলে এই ভজন শোনা যাবে। এই ভজন গাইতে গাইতেই ভক্তরা গর্ভগৃহে জগন্নাথের মূর্তি প্রদক্ষিণ করেন। এই ১৪ পংক্তির ভজনে আছে কৃষ্ণ-রূপ জগন্নাথের নানা কীর্তিগাথা। আছে কুরু রাজসভায় বস্ত্রহরণ পর্বে দ্রৌপদীর লাজ রক্ষার কথা, আছে রামায়নের লঙ্কাপর্বের পরে বিভীষণকে রাজা করায় কৃষ্ণের ভূমিকার কথা, আছে ভক্ত প্রহ্লাদকে রক্ষায় স্তম্ভ ভেঙে হিরণ্যকশিপুকে বধ করার কথা। পুরীর মন্দিরে হিন্দুদের পূজ্য দশাবতারের চিত্রে নবম অবতার রূপে আছেন জগন্নাথ। বৈষ্ণব জনের কাছে কৃষ্ণবর্ণ জগন্নাথই কৃষ্ণ।
এই ভজনটি লিখেছিলেন সালা বেগ, ওড়িশি উচ্চারণে সালাবেগা। জাতিতে মুসলমান বলে মন্দিরে তাঁর প্রবেশাধিকার ছিল না। আজও মন্দিরে মুসলমান ও দলিতের প্রবেশ নিষেধ। পার্সি ফিরোজ গান্ধীর স্ত্রী ইন্দিরা বা বর্তমান রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিদেরও প্রবেশাধিকার দেয়নি শ্রীক্ষেত্রের জগন্নাথ ধাম। কিন্তু সালাবেগের অসংখ্য ভজনেই সকাল সন্ধ্যায় আরাধনা হয় তাঁর পূজ্য প্রভুর। তাঁর লেখা ভজন উৎকীর্ণ আছে মন্দিরের ভিতরের দেওয়ালে। সশরীরে না হলেও নিজের সৃষ্টিকে পৌঁছে দিয়েছেন খাস দেবতার চরণতলে। ‘আহে নীলা শিলা’ ভজনের শেষ পংক্তিতে তিনি উল্লেখ করেছেন দেবতার গৃহে তাঁর প্রবেশাধিকার না থাকার মর্মবেদনা —
“কহে সালাবেগা হীন জাতি রে মে যবন
শ্রীরঙ্গ চরণতলে করুছি জানান।”
অন্য সব দেবতার মতোই জগন্নাথ দেবের নামে অনেক লোককথা বা কাহিনী ছড়িয়ে আছে। বহু বই ছাপা হয়েছে তাঁকে নিয়ে। হয়েছে চলচ্চিত্রও। তাঁকে নিয়ে অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে ওড়িশায়, যার কিছু কাহিনীর বাস্তব ভিত্তি আছে। লোককথা, তবে অসত্য নয়। আর, সালাবেগই একমাত্র ‘ভক্ত’, যার সমাধি আছে পুরীধাম থেকে গুণ্ডিচা বাড়ি (মাসির বাড়ি) যাবার পথে। প্রতি বছর জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার রথ সালাবেগের সমাধি বা মাজারের সামনে এসে পাঁচ মিনিট দাঁড়ায়। কথিত আছে, প্রভু তাঁর ভক্তের দর্শনের জন্য প্রতীক্ষা করেন।
সালাবেগ ছিলেন সপ্তদশ শতকের একদম প্রথম দশকের একজন। ভূবনেশ্বরের রিজিওন্যাল ইনস্টিটিউট অফ এডুকেশনের অধ্যাপক প্রীতিশ আচার্য বলেছেন, “অনেক ঐতিহাসিক বলেছেন, সালাবেগের জন্ম ১৬০৬ কি ১৬০৭ সালে। তাঁর নিজের লেখা থেকে পাওয়া যায়, তিনি এক মুসলিম পিতার ও ব্রাহ্মণ মাতার সন্তান।” নাথানের ‘বাহারিস্তান-ই-গালিবি’ এবং রামদাসের ‘দণ্ডতভক্তি রসাম্রুত’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে ‘ইমপ্যাক্ট অফ ইসলাম ইন ওড়িশিয়ান কালচার’ বইতে মুহম্মদ ইয়ামিন মির্জা লিখেছেন, বাংলার সুবেদার জাহাঙ্গির কুলী খান ওরফে লালবেগার ছেলে সালাবেগ-এর জন্ম ১৬০৬ থেকে ১৬০৮ এর মধ্যে।
লোককথায় পাওয়া যায়, লালবেগ একবার যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে দণ্ডমুকুন্দপুরের এক জলাশয়ে এক ব্রাহ্মণ নারীকে স্নান করতে দেখেন। তাঁর অপার সৌন্দর্যে মুগ্ধ লালবেগ তাঁকে জোর করেই তুলে আনেন। এবং তাঁকে প্রেম নিবেদন করেন, স্ত্রীর মর্যাদা দেন। তাঁদের একমাত্র সন্তান লালবেগ। লালবেগের স্ত্রী তাঁর নতুন জীবনে সুখী ছিলেন, তাই নিজের ধর্মাচরণ গোপনেই করতেন। সালাবেগ একটু বড় হতেই বাবার সেনাদলে যোগ দিলেন। একবার যুদ্ধে বাবা লালবেগ নিহত হন, ছেলে সালাবেগ গুরুতর আহত। বিধবা মা তখন করজোড়ে জগন্নাথের কাছে পুত্রের প্রাণরক্ষার আবেদন জানাতে থাকেন। সেই সময়েই সালাবেগ মায়ের আসল পরিচয় পান। দ্রুত তিনি সুস্থ হওয়ায় তিনি জগন্নাথের মন্দির দর্শনে রওনা হলেন।
কিন্তু, পুরীর মন্দিরে তাঁকে ঢুকতে দিলেন না পাণ্ডারা। সালাবেগ ঝগড়া করলেন না, শক্তি প্রয়োগ করলেন না, বছরে একবার জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা মাসির বাড়ি যাবেন বলে রথে চড়ে রাস্তায় আসেন জেনে তিনি সেই দিনটির অপেক্ষায় রইলেন। রথের দিন তিন দেবদেবীর বিশাল রথ পথে নামলো। সেই দিনই প্রথম দেবতার দর্শন পেলেন সালাবেগ। অভিভূত হলেন। তারপর থেকে প্রতি বছর রথ ও উল্টোরথের দিন পথের ধারে দাঁড়িয়ে আরাধ্যের দর্শন নিতেন। বাকি সময় নানা তীর্থক্ষেত্র ঘুরে বেড়াতেন।
একবার রথের দিন সমাগত, কিন্তু সালাবেগ তখন অসুস্থ হয়ে বৃন্দাবনে। বুঝতে পারছেন, রথের আগে পুরী ফেরা অসম্ভব। তবে কী প্রভুর দর্শনে বঞ্চিত হতে হবে! কাতর কণ্ঠে প্রভুকে বিনতি জানাতে থাকলেন, “হে প্রভু, আমার কি দর্শন হবে না?” একসময় স্বপ্নে জগন্নাথ দেখা দিয়ে বললেন, তিনি অপেক্ষা করবেন। স্বপ্ন কি আর সত্যি হয়! তবু যদি প্রভুর দেখা পান, রোগমুক্তির পর ক্লান্ত সালাবেগ যথাসম্ভব দ্রুত ছুটলেন পুরীর দিকে। যেদিন সেদিন পৌঁছচ্ছেন, তার সাতদিন আগে ছিল রথযাত্রা। এসে পৌছলেন বড়দণ্ড এলাকায় বাড়ির সামনে।
ইয়ামিন মির্জা তাঁর বইতে লিখেছেন, সালাবেগ এসে দেখলেন, জগন্নাথের ‘নন্দীঘোষ’ রথ তাঁর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। তাঁর পিছনে বলরাম ও সুভদ্রার রথ। কেন রথ চলছে না, কেউ জানে। সবাই বিপুল শক্তিতে রথ টানার চেষ্টা করেছেন। রাজবাড়ির হাতিদের দিয়েও চেষ্টা হয়েছে। রথ নড়েনি। শঙ্কিত পুরীর রাজা, পুরোহিত, পাণ্ডারা রথেই দেবদেবীদের পুজো করেছেন, সেবা করেছেন। সালাবেগ এলেন ছুটতে ছুটতে, গেলেন দেবতার কাছে, প্রণাম সারলেন। রথ আপনি নড়ে উঠল।
আজও গুণ্ডিচা বাড়ির পথে আছে ভক্ত সালাবেগার সমাধি বা মাজার। সালাবেগাই একমাত্র জগন্নাথ ভক্ত, মাসির বাড়ির পথে যার সমাধি আছে এবং এখনও প্রতিবার রথযাত্রায় পাঁচ মিনিটের জন্য নন্দীঘোষ রথ এখানে অপেক্ষা করে। দেবতার সেবায়েতদের কাছে মুসলিম ধর্ম ‘হীন’ হতে পারে, কিন্তু দেবতার কাছে নয়। তাঁরই লেখা ভজনে দেবতা খুশি হন। তাঁর মাজারের সামনে দেবতার রথ থেমে যায়। আর, পাণ্ডারা মন্দিরের গেটে তালা দেন।
ওড়িশার বিশিষ্ট পণ্ডিত ব্যক্তিদের মতে, সালাবেগের কারণেই সাধারণ ওড়িয়াদের মধ্যে প্রভু জগন্নাথ জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। অধ্যাপক প্রীতিশ আচার্য বলেছেন, “সময়ের বিচারে সালাবেগ খুবই বড় মাপের কবি ছিলেন। তিনিই ওড়িশার মানুষকে জগন্নাথের নানা ঐতিহ্য ও নানা কথা বুঝতে সাহায্য করেছেন। সে কারণে ওড়িশা সাহিত্যে তাঁর প্রশস্তি অনেক।”
অধ্যাপক আচার্য বলেছেন, সালাবেগের সাহিত্য সৃজনের সময় দেশে ভক্তি আন্দোলনের স্বর্ণযুগ। কবীর, নানক, মীরাবাঈ, তুলসীদাসরা ব্রাহ্মণ্যবাদকে পিছনে ফেলে ভক্তি আন্দোলনে হিন্দু ধর্মের সংস্কার সাধন করছেন। তাঁদের রচনায় বলা হচ্ছে, মনের আকুতি ও প্রার্থনাতেই দেবতার কাছে পৌঁছনো যায়, পুরোহিত ব্রাহ্মণ লাগে না। এই সময়েই দাসিয়া বাউড়ির মতো নিম্নবর্ণের মানুষ বা কুষ্ঠ রোগী দীন কৃষ্ণদাস পুরীর মন্দিরে প্রবেশাধিকার না পেয়ে তাঁরা তাঁদের লেখা দিয়েই প্রভু জগন্নাথের কাছে আর্জি জানিয়েছেন।
আগে, শ্রীক্ষেত্রের জগন্নাথ মন্দিরেও সংস্কৃত মন্ত্রে পুজোর মতো মন্দিরের ভিতরে ভজনও গাওয়া হতো সংস্কৃতে। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের সালাবেগ, দাসিয়া বাউড়ি, দীন কৃষ্ণদাসের মতো নিম্নবর্গের ও ভিন্ন ধর্মের মানুষই ওড়িয়া ভাষায় ভজন ও গান রচনা করে সাধারণের মধ্যে প্রভু জগন্নাথের প্রচার করেন। স্থানীয় সাধারণ মানুষ সংস্কৃত বুঝতেন না, স্বভাষায় মাহাত্ম্য বর্ণনা তাঁদের আকৃষ্ট করে। তাই, ওড়িশি সাহিত্যকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে সালাবেগের অবদান তাই অনস্বীকার্য।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বি পি সাহু বলেছেন, কেবল সালাবেগই নন, উজির বেগ নামেও একজন মুসলমান জগন্নাথ দর্শন ও ভাবনার প্রসারে বিরাট ভূমিকা রেখেছিলেন। আসলে, আজকের একুশ শতকের ঘৃণা আর বিদ্বেষের দৃষ্টিতে ৪০০ বছর আগের সমাজকে দেখা ভুল হবে।”
দুর্ভাগ্যের, এই ভুলটাই আজ ঘটছে দেশ জুড়ে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।