সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে দেবদাস কুণ্ডু (পর্ব – ৭)

লড়াইয়ের মিছিল

পর্ব – ৭

কলকাতা শহরের কাছে এমন খোলামেলা আকাশ, বিস্তৃত মাঠ, অজস্র ফড়িং আর প্রজাপতির ওড়াউড়ি, দূরে এক চাষী করছে চাষ এই সামগ্রিক দৃশ্যপট হরিদাস পালের ভিতর জাগিয়ে তুলল ফরিদপুর জেলার দেভোগ গ্রামের ছবি। কত বয়স হবে তার তখন? 13/14বছর।কিন্তু ছবি পস্ট ভেসে উঠছে চোখে। তিনি পরিস্কার দেখতে পারছেন সবুজ মাঠে ছুটছে এক কিশোর একটি লাল ঘুড়ির পিছনে। ঘুড়িটা মাতালের মতো টাল খেতে খেতে বাতাসে ভাসছে। কিশোর দৌঁড়াছে তার পিছন। সংগে ছিল আর এক কিশোর। পরাশর।ঘুড়ি টা নাগালের মধ্যে এলে দুজনের টানাটানিতে ছিঁড়ে গেল। তাদের হুশ হলো, তারা চলে এসেছে নদীর কাছে। ঘাটে বাঁধা নৌকো। পরাশর বলল, যাবি? ‘আমি বাইতে পারি।’
‘নারে। বাড়িতে জানলে বাবা মারবে।’
‘তোর বাবা শুধু মারে কেন রে?’
‘আমি দুষ্টোমি করি তাই।’
‘সে তো আমিও করি। কই আমার বাবা তো
মারে না।’
‘সবার বাবা বুঝি এক রকম হয়?আমার বাবা খুব রাগী।’
‘চল তো। সামনের হাঁসখালি চরাটায় যাবো।’
‘সেখানে কি আছে রে? ‘
কত রংয়ের পাখি আছে। কি সুন্দর ডাকে’। আমি গুলতি দিয়ে শীকার করবো। ‘
‘ আমি যাবো না। ‘
‘ কেন? ‘
‘ তুই কেন ওদের মারবি? ‘
‘ মারবো মানে, মেরে ফেলবো না। ‘
‘তাহলে? :
‘একটু আহতো হবে। এই যা। তারপর সুস্থ করে বাড়ি নিয়ে খাঁচায় পুরে দেবো।’
‘না না। আমি একাজে নেই।’
‘কেন? তোর আপত্তি কেন? ‘
‘ তুই একবার ভাব, আমাদের যদি কেউ এরকম খাঁচায় আটকে রাখতো, তবে কি আমরা বনে মাঠে ঘাটে এইভাবে ঘুরতে পারতাম? :’
‘আমাদের সংগে পাখির তুলনা?’
‘ শোন পরাশর পাখির ভিতর প্রান আছে। সে চায় মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াবে। গাছে বাসা বাঁধবে।ওদের সন্তান হবে। ‘
‘ তুই কি বিপ্লবী হয়ে গেলি নাকি? ‘
‘ দেখ বিপ্লবীরা লড়াই করছে বলে আমরা স্বপ্ন
দেখতে পারছি যে একদিন আমাদের দেশটা স্বাধীন হবে। পাখিও চায় স্বাধীনতা। ‘
‘ ঠিক আছে। আমি শীকার করবো না। ‘
সত্যি চরাটা খুব সুন্দর। ছোট্ট চরা।কিছু গাছ আছে ঘন ঘন। নদীর ঢেউ বার বার চরাটাকে চুমু খেয়ে যাচ্ছে। আর পাখি! কত রং
না এলে সে জানতে পারতো না তার দেশে এতো রংয়ের পাখি আছে। এক একটা পাখি দেখে তার মনে হয় কোন শিল্পীর আঁকা। ঈশ্বর কতো বড়ো এক শিল্পী। আর ডাক! তার কান ঝালা পালা করে দিচ্ছে। পাখিরা উড়ছে।ডাকছে।খেলছে। সে এক আনন্দময় রূপ। হঠাৎ একটা পাখি ছিটকে এসে পড়লো তার পায়ের কাছে। ছটপট করছে। কি ব্যাপার? পাখিটা হাতে তুলে নদীর জল দিতে না দিতে শান্ত হয়ে গেল। আর নড়ছে  না। মরে গেল? হ্যাঁ। মরেই গেল। তার মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো। সে ছূটে গিয়ে
পরাশরের মুখে সজোরে একটা ঘুষি মারলো। পরাশর পড়ে গেল বালিতে। সে পরাশরের বুকে উঠে মেরে যাচ্ছে অনবরত। পরাশর বলল, ‘আরে, মরে যাবো যে।’
‘আমি আজ তোকে মেরেই ফেলবো।বিশ্বাসঘাতক।কথা দিয়ে কথা রাখলি না। একটা পাখিকে মেরে তুই কি আনন্দ পাস?’
পরাশর আর্ত স্বরে বলে, ‘আর কোনদিন এমন কাজ করবো না। কথা দিচ্ছি।এখন ছাড়। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। যার নৌকা সে হয়তো খোঁজাখুজি করছে। ছাড় এবার।’
বালির ওপর শুয়ে হরিদাস পাল ফাঁপাচ্ছে।তার বুকের ভিতরটা কেমন কষ্ট হচ্ছে। চোখ ফেটে জল এলো বলে।
‘ মিস্টার পাল আপনার ব্রেক ফাস্ট।’
কোন সাড়া নেই। জানালার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন। নড়াচড়া নেই।
আবার ডাকলো মেয়েটি,’ মিস্টার পাল—‘
এবার নড়ে উঠলেন পালবাবু। এদিকে মুখ করলেন। কল্যান বাবু দেখলেন মিস্টার পালের মুখে এক অপার্থিব শোকের ছায়া।
পাল মেয়েটির দিকে তাকালেন। 20/22 বছর বয়স হবে। গোলাপি পোষাকে দারুন লাগছে। মেয়েটি হঠাৎ বললেন, ‘আপনার চোখে জল কেন?’ ‘
‘ জল! কি জানি। কেন জল। চোখ বলতে পারবে। ‘
‘ চোখ কি কথা বলতে পারে? ‘কল্যান বাবু খেতে খেতে বললেন।
‘ কে বলেছে চোখ কথা বলতে পারে ‘না? চোখ অনেক কথা বলে নিঃশব্দে। চোখের ভাষা বুঝতে জানতে হবে। ‘
‘ তাই বুঝি?’
মেয়েটি হাসলো। পালবাবু বললেন, ‘তোমাকে আমি ছুঁতে পারি? ‘
‘ অবশ্যই।’
পালবাবু মেয়েটির হাত ধরে তার পাশে বসতে বলল। মেয়েটি বসলো।
‘তোমার নাম কি?’
মেয়েটি নাম বলল।
‘ তুমি কি সাইথ ইন্ডিয়ান? কল্যাণ বাবু বলেন।
হ্যাঁ।
‘কি সুন্দর বাংলা বলছো তুমি। ‘
‘আমার মা যে বাঙালি।’
‘তুমি থাকো কোথায়?’
‘ গড়িয়া। ‘
‘ একটা কথা বলবো তোমায়? ‘
‘ বলুন।’
আজ আমার খেতে ইচ্ছে করছে না’।
‘সে কথা বললে তো চলবে না। আপনাকে খেতেই হবে।আপনি বসে থাকবেন না হাত গুটিয়ে। ‘
‘ আর যদি না খাই? ‘
‘না খেলে আমাকে জবাব দিতে হবে। ‘
তাহলে এক কাজ করো তুমি আমাকে খাইয়ে দাও। ‘
‘ আমি! ‘
হ্যাঁ ।তুমি ।’
‘কোন অসুবিধা আছে?’
‘না। মানে। কেউ তো কোনদিন এমন কথা বলেনি।’
‘আজ আমি বলছি। এই খাবারটা আমরা দুজনে শেয়ার করি। ‘
মেয়েটির চোখ জলে ভিজে এলো।
‘ কি হলো তোমার বলো তো? ‘
‘ ? আমার বাবা মা তো আলাদা থাকে। আমার দাদু আমাকে খুব ভালো বাসতো। দাদু এভাবে শেয়ার করে খেতো। সেই দাদু চলে গেছে। আমি এখন একা।’
‘ কে বলেছে তোমার দাদু নেই? এই তো আমি। আমিই তোমার দাদু। ‘
মেয়েটি আর স্থির থাকতে পারছিল না। পালবাবুর বুকে মাথা রেখে কাঁদছে ঝর ঝর করে। আর সত্যি এবার পালবাবু চোখে জল এসে গেছে।
এই দৃশ্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেখলে কি হবে সে কথা তারা কেউ ভাবছে না।
এমনও হয়! জানা নেই, চেনা নেই। দুটো হৃদয় এক হয়ে যায!

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।