আজকের লেখায় ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত

রবীন্দ্র আলোয় গান্ধীজী
রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধ ‘গান্ধীজী’-তে লিখেছিলেন, “আজ মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিবসে আশ্রমবাসী আমরা সকলে আনন্দোৎসব করব। আমি আরম্ভের সুরটুকু ধরিয়ে দিতে চাই”। ‘গান্ধী মহারাজ’ কবিতায় ব্যক্ত করলেন তাঁর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা –
“গান্ধী মহারাজের শিষ্য
কেউ-বা ধনী, কেউ-বা নিঃস্ব,
এক জায়গায় আছে মোদের মিল
গরিব মেরে ভরাই নে পেট
ধনীর কাছে হই নে তো হেঁট
আতঙ্কে মুখ হয় না কভু নীল”।
আজ মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিন। ভারতজুড়ে এ দিনটি গান্ধী জয়ন্তী এবং বিশ্বে আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস হিসেবে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। ২০০৭ সালের ১৫ জুন জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ২ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস বা International Day of Non-Violence হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বিশ্ব থেকে হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি, মারামারি, অসহিষ্ণুতা ও রক্তপাত বন্ধে বিশ্ববাসীর চেতনাকে জাগিয়ে তোলাই আন্তর্জাতিক অহিংস দিবসের মূল বাণী।
মহাত্মাজীর কথা হল, “আমার ধর্ম কোন ভোগোলিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ নেই। আমার ধর্মের ভিত্তি হল ভালবাসা এবং অহিংসা”।
গান্ধীজী আফ্রিকায় যখন কালো চামড়ার মানুষের ভোটাধিকারসহ সকল প্রকারের অধিকার আদায়ে নির্যাতন, ঘৃণা তুচ্ছ করে লড়াই করে সফল হচ্ছিলেন, তখন গোপাল কৃষ্ণ গোখলে ১৯১৫ সালে সি. এফ. এন্ড্রুজ মারফত গান্ধীজীকে ভারতে এসে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেওয়ার অনুরোধ জানান। রবীন্দ্রনাথও আফ্রিকায় গান্ধীজীর বিশাল কর্মযজ্ঞের ব্যাপারে সম্যক অবহিত ছিলেন। তিনি তাঁর ও মহাত্মার বন্ধু পি. এফ এন্ড্রুজের মাধ্যমে তাঁকে অভিনন্দন ও আশিস জানিয়েছিলেন। গান্ধীজী ভারতে ফিরেই শান্তিনিকেতনে ওঠেন এবং আশ্রমে প্রায় এক মাস (কারো মতে ৭ দিন) সময় কাটান।
মহাত্মা গান্ধী বিশ্ব মানবতার কাছে এক অবিস্মরণীয় নাম এবং প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক নেতা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ‘মহাত্মা’ আর ভারতবাসী ‘বাপু’ নামে ডাকতেন। বস্তুতঃ রবীন্দ্রনাথের মত গান্ধীবোদ্ধা প্রায় নেই বললেই চলে এবং তা কেবল গান্ধীজীর কোনও বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে নয়, তাঁর সুউচ্চ মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সমগ্র জীবন, দুর্জয় সাহস ও সকলের কল্যাণে প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গও কবিকে গভীরভাবে মুগ্ধ ও প্রভাবিত করেছিল এবং বক্তৃতা ও লেখায় নানাভাবে তিনি তা ব্যক্ত করেছেন। এটি সত্য যে মহাত্মাজী সম্পর্কে কারও কারও অসহিষ্ণুতা তাঁকে গভীরভাবে পীড়িত করেছে এবং প্রয়োজনে তাঁদের তিনি তিরস্কারও করেছেন। এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য সুভাষ চন্দ্র বসুর (তখনও তিনি নেতাজী হন নি) লিখিত মন্তব্য “আপনি (রবীন্দ্রনাথ) সম্প্রতি মহাত্মাজীর অন্ধ ভক্ত হয়ে পড়েছেন” এর প্রত্যুত্তরে কবিগুরুর চিঠি, “এই উপলক্ষে একটা কথা তোমাকে বলা আবশ্যক মনে করি। মহাত্মা গান্ধী অতি অল্প সময়ের মধ্যে সমস্ত ভারতবর্ষের মনকে এক যুগ থেকে আর এক যুগে নিয়ে যেতে পেরেছেন”।
প্রখ্যাত রবীন্দ্র-সাহিত্য সমালোচক ও সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী রবীন্দ্রনাথের ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকের ধনঞ্জয় বৈরাগী চরিত্রে গান্ধী-চরিত্রের প্রভাব সম্বন্ধে আলোচনাকালে একটি বাংলা প্রবাদ ব্যবহার করেছেন – “রামচন্দ্র জন্মের আগে রামায়ন লিখিত হইয়াছিল”। এই প্রবাদটি নৈবেদ্য কাব্যগ্রন্থের আলোচিত কবিতাগুলির ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। গান্ধীজীর আগমনের আগেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর আগমনবার্তা ঘোষণা করেছেন এবং এই ঘোষণার মধ্য দিয়েই কবিতাগুলি আমাদের আলোচনায় মূল্যবান স্থান লাভ করেছে।
প্রমথনাথ বিশী ‘নৈবেদ্য’ (১৯০১) কাব্যগ্রন্থের কতগুলি কবিতায় গান্ধী-চরিত্রের পূর্বাভাষ আছে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন বর্তমান প্রসঙ্গের মধ্যে এই কবিতাগুলিকে (‘নৈবেদ্য’ ৬৩-৬৮, ৭২, ৭৭, ৯২-৯৬, সংখ্যক কবিতা) নিক্ষেপ করে দেখলে একটা বিশেষ অর্থ পাওয়া যায় এবং পরবর্তীকালে দেখা যায় গান্ধী-চরিত্রের মহিমার একটি দিক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথের কল্পনার মহামানবের মতোই গান্ধীজীও ইশ্বরের প্রতি অবিচল আস্থা স্থাপন করে সমগ্র বিশ্বকে শুনিয়েছেন শান্তি, মৈত্রী, প্রেম, অহিংসা ও সত্যের বাণী। নিজের জীবনাচারের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্টা করেছেন শাশ্বত সত্যকে এবং গান্ধীজীর স্পর্শেই ভারত তথা সমগ্র বিশ্বে নতুন করে জাগরূক হয়ে উঠেছে স্বর্গলোক। শুধু ভারত নয়, সমগ্র বিশ্বই গান্ধীজীকে গ্রহণ করল জননেতা হিসাবে। তিনি হয়ে উঠলেন ভারতবাসীর একান্ত আপন ‘বাপু’। গান্ধীজী যে ভারতবাসীর একান্ত আপনার জন হয়ে উঠবেন তা যেন কবি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন, তাই কবির কন্ঠে শোনা গেল,
“… পৌরুষেরে করে নি শতধা; নিত্য যেথা
তুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা —
নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ,
ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত”।
গান্ধীজী জাতির জনক, তিনি পিতার মতো, সদা জাগ্রত অভিভাবকের মত ভারতবাসীকে সত্য, ন্যায়, অহিংসার অভিমুখে চালিত করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের দৃঢ় বিশ্বাস ‘ভারতই সেই পূর্ণতার – সেই ঐক্যের সন্ধান দিতে পারে। ইহাই কবির মতে ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা’। কবি নিশ্চিত একদিন না একদিন এই অন্ধকার কেটে যাবে কোনও এক মহামানবের স্পর্শে। তিনি এও জানেন যে, ভারতেই আবির্ভূত হবেন এই মহামানব। তাই কবি লিখেছিলেন,
“…নৃপতিরে শিখায়েছ তুমি
ত্যজিতে মুকুট দণ্ড সিংহাসনভূমি,
ধরিতে দরিদ্রবেশ; শিখায়েছ বীরে
ধর্মযুদ্ধে পদে পদে ক্ষমিতে অরিরে,
ভুলি জয়-পরাজয় শর সংহরিতে”।…
সত্যাগ্রহ গান্ধীজীকে ভারতের জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ট করে তুলল। ‘গ্রামাঞ্চলের কৃষকদের সঙ্গে যেমন, শহরাঞ্চলের মজুরদের সঙ্গেও তেমনি তাঁর (গান্ধীজীর) ঘনিষ্ট সম্পর্ক স্থাপিত হল। এই যোগাযোগ জাতীয় আন্দোলনে গান্ধীজীর অন্যতম মহৎ অবদান।… তিনিই বোধ হয় একমাত্র নেতা যিনি গ্রামাঞ্চলের মানুষের সঙ্গে সম্পুর্ণভাবে একাত্ম হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিকদের এই মন্তব্য গান্ধীজী পরিচালিত আন্দোলনের অভিনবত্ব প্রমাণ করে। তাঁর দেখানো পথে চললে ভারতবাসী অন্ধ সংস্কার থেকে, ভয় থেকে, মিথ্যার নাগপাশ থেকে মুক্তি পাবে। তিনি ভারতবাসীকে শুধু স্বাধীনতার যুদ্ধে আহ্বান করেন নি – তিনি তাদের আত্মীক উত্তরণের পথেও চালিত করেছেন। তাঁর আহ্বানে সাড়া দেবার ফলেই –
“…ঘুচল তাদের অপমানের শাপ-
চিরকালের হাতকড়ি যে,
ধুলায় খসে পড়ল নিজে
লাগল ভালে গান্ধীরাজের ছাপ”।
১৯২০ সালের এপ্রিল মাসে কবিগুরু এলেন আমেদাবাদে সবরমতী আশ্রমে। সেখানে এক ভাষণে বললেন. “মহাত্মাজীর বাণী বিশ্বের সর্বত্র বিস্তৃত হইয়াছে। অতএব মহাত্মাকে বিশ্বকর্মা বলা যাইতে পারে”। পরে লিখলেন, – “মহাত্মা অনেক কে বলা হয় তার কোনও মানে নেই। কিন্তু এই মহাপুরুষকে যে মহাত্মা বলা হয়েছে তার মানে আছে। আমাদের শাস্ত্রে ইশ্বরকে বলে মহাত্মা, মর্ত্যলোকে সেই দিব্য ভালবাসা, সেই প্রেমের ঐশ্বর্য্য দৈবাত মেলে” (৫ই আশ্বিন, ১৩৩৯)।
১৯৩১ সালের শেষার্ধে ২য় গোলটেবিল ব্যর্থ হওয়ার পরে, শুন্য হাতে ফিরে এলেন এবং গ্রেপ্তারও হলেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন,
“নবজীবনের সংকটপথে
হে তুমি অগ্রগামী,
তোমার যাত্রা সীমা মানিবে না
কোথাও যাবে না থামি।
….যত আগে যাবে দ্বিধা সন্দেহ
ঘুচে যাবে পাছে পাছে,
পায়ে পায়ে তব ধ্বনিয়া উঠিবে
মহাবাণী — “আছে আছে”।
১৯৩২ সালে আবার আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয় এবং ব্রিটিশ সরকার প্রচন্ড দমননীতি গ্রহণ করে। এর পাশাপাশি বিভেদ সৃষ্টির দ্বারা জাতীয় আন্দোলনকে ধ্বংস করার জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রেমজে ম্যাকডোনাল্ড ‘কমিউনাল এওয়ার্ড’ বা ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ নীতি ঘোষণা করেন। এর জন্য অনুন্নত হিন্দুদের জন্য পৃথক নির্বাচনের অধিকার দিয়ে হিন্দুদের মধ্যে একটি বিভেদের চেষ্টা হয়। গান্ধীজী এর কুফলটি বুঝতে পারেন ও এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও সেটা রদ করার জন্য ওই সালের ২০শে সেপ্টেম্বর থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন। তিনি তখন বন্দী অবস্থায় পুনার এড়োরা কারাগারে।
রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজীর সপক্ষে গর্জে উঠলেন। ৪ঠা আশ্বিন ১৩৩৯, শান্তিনিকেতনে এক সভায় বললেন, “সূর্যের পুর্ণগ্রাসের লগ্ন যেমন ক্রমে ক্রমে দিনকে আচ্ছন্ন করে তেমনি আজ মৃত্যুর ছায়া সমস্ত দেশকে আবৃত করেছে। এমন সর্ব্বদেশব্যাপী উৎকন্ঠা ভারতের ইতিহাসে আর ঘটেনি। যিনি সুদীর্ঘকাল দুঃখের তপস্যার মধ্যে দিয়ে সমস্ত দেশকে যথার্থভাবে, গভীরভাবে আপন করে নিয়েছেন, সেই মহাত্মা আজ আমাদের সকলের হয়ে মৃত্যুব্রত গ্রহণ করলেন”। জয় হোক সেই তপস্বীর যিনি এই মুহুর্তে বসে আছেন মৃত্যুকে সামনে নিয়ে, ভগবানকে অন্তরে বসিয়ে সমস্ত হৃদয়ের প্রমকে উজ্জ্বল করে জ্বালিয়ে। তোমরা জয়ধ্বনী করো তার, বলো তোমাকে গ্রহণ করলেম, তোমার সত্যকে স্বীকার করলেম”।
২৬শে সেপ্টেম্বর ১৯৩২, কবিগুরু স্বয়ং পৌছে গেলেন এড়োরা কারাগারে, অসুস্থ শরীরে, বৃদ্ধ বয়সে, মহাত্মা যে তার আশীর্বাদ চেয়েছেন। এই চরম কথাটি গুরুদেব ব্যক্ত করলেন, “আমরা একজন মানুষের জন্য অপেক্ষা করেছিলাম, মহাত্মা গান্ধীর মধ্যে আমরা সেই রকম ব্যক্তিত্বকে দেখতে পাই”। অবশেষে ‘পুণা-চুক্তি’র মাধ্যমে একটি আপোষ মীমাংসার পরে গান্ধীজী অনশন ভঙ্গ করলেন।
গান্ধীজীর অনশন ভঙ্গের পরবর্তী পর্যায়টি রবীন্দ্রনাথ অপূর্বভাবে তাঁর মর্মস্পর্শী লেখনিতে মূর্ত করেছেন এইভাবে, “বন্ধুরা একপাশে দাঁড়িয়ে চিঠিখানি পড়লেন। আমাকেও দেখালেন। রাষ্ট্রবুদ্ধির রচনা সাবধানে লিখিত, সাবধানেই পড়তে হয়। বুঝলেম মহাত্মাজির অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধ নয়। পণ্ডিত হৃদয়নাথ কুঞ্জ্রুর’পরে ভার দেওয়া হল চিঠিখানার বক্তব্য বিশ্লেষণ করে মহাত্মাজিকে শোনাবেন। তাঁর প্রাঞ্জল ব্যাখ্যায় মহাত্মাজির মনে আর কোনো সংশয় রইল না। প্রায়োপবেশনের ব্রত উদ্যাপন হল।
প্রাচীরের কাছে ছায়ায় মহাত্মাজির শয্যা সরিয়ে আনা হল। চতুর্দিকে জেলের কম্বল বিছিয়ে সকলে বসলেন। লেবুর রস প্রস্তুত করলেন শ্রীমতী কমলা নেহেরু। Inspector-General of Prisons— যিনি গবর্মেণ্টের পত্র নিয়ে এসেছেন— অনুরোধ করলেন, রস যেন মহাত্মাজিকে দেন শ্রীমতী কস্তুরীবাঈ নিজের হাতে। মহাদেব বললেন, ‘জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো’ গীতাঞ্জলির এই গানটি মহাত্মাজির প্রিয়। সুর ভুলে গিয়েছিলেম। তখনকার মতো সুর দিয়ে গাইতে হল।
“জীবন যখন শুকায়ে যায়
করুণাধারায় এসো।
সকল মাধুরী লুকায়ে যায়,
গীতসুধারসে এসো।
পণ্ডিত শ্যামশাস্ত্রী বেদ পাঠ করলেন। তার পর মহাত্মাজি শ্রীমতী কস্তুরীবাঈয়ের হাত হতে ধীরে ধীরে লেবুর রস পান করলেন। পরিশেষে সবর্মতী-আশ্রমবাসীগণ এবং সমবেত সকলে ‘বৈষ্ণব জন কো’ গানটি গাইলেন। ফল ও মিষ্টান্ন বিতরণ হল, সকলে গ্রহণ করলেম।
জেলের অবরোধের ভিতর মহোৎসব। এমন ব্যাপার আর কখনো ঘটে নি। প্রাণোৎসর্গের যজ্ঞ হল জেলখানায়, তার সফলতা এইখানেই রূপ ধারণ করলে। মিলনের এই অকস্মাৎ আবির্ভূত অপরূপ মূর্তি, একে বলতে পারি যজ্ঞসম্ভবা”।
পুণা থেকে ফিরে এসে রবীন্দ্রনাথ ‘চন্ডালিকা’ গীতিনাট্যে লিখলেন, –
“হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!
মানুষের অধিকারে
বঞ্চিত করেছ যারে,
সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান”।…
রবীন্দ্রসাহিত্যে গান্ধীজী একটা বিশেষ অংশ দখল করে আছে, যেমন, ‘মহাত্মাজির পুণ্যব্রত’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন,
“যুগে যুগে দৈবাৎ এই সংসারে মহাপুরুষের আগমন হয়। সব সময় তাঁদের দেখা পাই নে। যখন পাই সে আমাদের সৌভাগ্য। আজকের দিনে দুঃখের অন্ত নেই; কত পীড়ন, কত দৈন্য, কত রোগ শোক তাপ আমরা নিত্য ভোগ করছি; দুঃখ জমে উঠেছে রাশি রাশি। তবু সব দুঃখকে ছাড়িয়ে গেছে আজ এক আনন্দ। যে মাটিতে আমরা বেঁচে আছি, সঞ্চরণ করছি, সেই মাটিতেই একজন মহাপুরুষ, যাঁর তুলনা নেই, তিনি ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করেছেন”।
এছাড়াও কবিতা, প্রবন্ধে, নাটকে, ভাষণে, তিনি গান্ধীজী সম্বন্ধে তাঁর উপলব্ধির কথা লিপিবদ্ধ করেছেন, এবং বলেছেন, অকু্ন্ঠ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন। ধনঞ্জয় বৈরাগী চরিত্র সৃষ্টি করে গান্ধীজীকে অমরত্ব দান করেছেন।
১৯৩৩-এর ১১ই ফেব্রুয়ারী মহাত্মা গান্ধীর সম্পাদনায় ‘হরিজন’ নামে যে. ইংরেজি পত্রিকা বেরিয়েছিল, তারই প্রথম সংখ্যার জন্যে রবীন্দ্রনাথ সত্যেন্দ্রনাথের ‘মেথর’ কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ পাঠিয়েছিলেন। লেখাটির নাম ‘The Cleanser’ (A free rendering from the Bengali of Styendranath Datta’s “Scavenger”-
মেথর – সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
“কে বলে তোমারে, বন্ধু, অস্পৃশ্য, অশুচি?
শুচিতা ফিরিছে সদা তোমারি পিছনে;
তুমি আছ, গৃহবাসে তাই আছে রুচি
নহিলে মানুষ বুঝি ফিরে যেত বনে”।…
“The Cleanser”-
“Why do they shun your touch my friend, and call you unclean?
Whom cleanliness follows at every step making the earth and air sweet for our dwelling…
And ever luring us back from return to the wild”?…
You help us like a mother her child into freshness and uphold
the truth that disgust is never for man….
Come friend, come my hero, give us courage to serve.
১লা এপ্রিল সংখ্যায় আছে ‘The Fight is Necessary’ শিরোনামে গান্ধীজীকে লেখা কবির একটি পত্র।
Dear Mahatmaji
“It is needless to say that I do not all relish the idea of divinity being enclosed in a brick and mortar temple for the special purpose of exploitation by a particular group of people. I strongly believe that it is possible for the simple-hearted people to realize the presence of God in the open air, in a surrounding free from all artificial obstruction.”…..
১৫ই জানুয়ারী, ১৯৩৪ – বেলা ২টো ১৫ মিনিটে বাতাস উদ্দাম হল, আর মাটি কাঁপতে লাগল। প্রায় হাজার মাইল দূর থেকেও সেই ভয়াবহ ভূমিকম্প টের পেল সবাই। মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে বিহারের উত্তর প্রান্তের সমস্ত শহরটাই ধ্বংসস্তুপে পরিণত হল। এই ভূমিকম্পে প্রায় দেড়-কোটি লোক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। ২১শে জানুয়ারী ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ টেলিগ্রামে গান্ধীজীকে জানালেন, – “Earthquake has wrought terrible havoc, ruining Monghyr, Darbhanga, Muzzafarpur, and Motihari…. এই প্রকৃতিক বিপর্যয়ে বিহারের মানুষের পাশে যথাসাধ্য সাহায্য নিয়ে দাঁড়াতে গান্ধীজী আবেদন করলেন ২৪শে জানুয়ারী। কিন্তু তার মধ্যে একটা কথা জানাতে ভুললেন না যে আমাদের পাপের জন্যে এ দুর্যোগ ঈশ্বর প্রেরিত। কারণ তার বিশ্বাস – “It is my unmistakable belief that not a blade o grass moves but the divine will”. গান্ধীজীর এ কথাও মনে হল যে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে তিনি যে ব্রত গ্রহণ করেছেন বিহারের এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে তার সম্বন্ধ আছে। এই আকষ্মিক দুর্যোগ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে আমাদের অবস্থান আর ঈশ্বরই বা কি? কিন্তু অস্পৃশ্যতার দু্র্যোগ শতাব্দী ধরে বয়ে চলে আসছে। “It is a curse brought upon ourselves by our own neglect o a portion of Hindu Humanity while the Bihar calamity damages the body, the calamity brought about by untouchable corrodes the very soul. Let this Bihar calamitybe a reminder to us that, whilst we have still a ew more breaths left, we should purify ourselves ot the taint of untouchability and approach our Maker with clean hearts”….
হরিজন পত্রিকার এক সংখ্যায় যখন গান্ধীজী এই মত প্রকাশ করেন তখন রবীন্দ্রনাথ এর প্রতিবাদ করেন এক বিবৃতি প্রকাশ করে। হরিজন পত্রিকায় গান্ধীজী লিখলেন, ‘Superstion vs Faith’ এবং এর অনুসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বিবৃতি প্রকাশ করলেন, “It has caused me painful surprise to find Mahatma Gandhi accusing those who blindly follow their own social custom of untouchability of having brought down God’s vengeance upon certain parts of Bihar, evidently specially selected for. His desolating displeasure. It is all the more unfortunate, because this kind of unscientific view of things is too readily accepted by a large section of our countrymen.
হরিজন পত্রিকায় গান্ধীজী যে বিবৃতি প্রকাশ করলেন সেখানে কবির প্রতি তাঁর আন্তরিক শ্রদ্ধা ও সমীহ জ্ঞাপন করলেন তিনি। একদা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে কবির আশ্রমে যে আশ্রয় পেয়েছিলেন সে-কথা জানিয়েও তিনি লিখলেন, – “But Gurudev and I early discovered certain differences of outlook between us.”… নিজের মতামতের বিস্তৃত ব্যাখ্যা করে শেষে গান্ধীজী লিখলেন, “I have not the faith which Gurudev has that ‘our own sins and errors, however enormous, have not got enough force to drag down the structure of creation of ruins’ on the contrary. I have the faith that our own sins have more force to ruin that structure that any mere physical phenomenon. There is an indissoluble marriage between matter and spirit”.
১৯৩৯-৪০ সালে তথাকথিত গান্ধীজী সুভাষচন্দ্র বিতর্কের সময়ে কি চমৎকারভাবে গান্ধীজীর যুক্তি অনুধাবন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। কবি তার সচিব অমিয় চক্রবর্তীকে ২০-০৫-১৯৩৯ তারিখে লিখলেন, “… বুঝতে পারছি স্বদেশকে স্বতন্ত্রদানের উদ্দেশ্যে মহাত্মাজীর মনে একটা বিশেষ সংকল্প বাঁধা রয়েছে। মনে মনে তার পথের একটি ম্যাপ তিনি এঁকে রেখেছেন। অতএব পাছে কোনও বিপরীত মতবাদের অভিঘাতে তার সংকল্প ক্ষুন্ন হয়এ আশংকা তার মনে থাকা স্বাভাবিক। হয়তো মহাত্মাজীর সৃজনশালায় আরও অনেক মূল্যবান নূতন উপকরণ যোগ করার প্রয়োজন আছে। এই যোগ করা যদি ধৈর্য্যের সঙ্গে, শ্রদ্ধার সঙ্গে তার সহযোগীতানা ঘটে তা হলে সমগ্রেরই ক্ষতি। এ অবস্থায় মূল সৃষ্টিকর্তার উপর নির্ভর করতেই হবে। দেশের সৌভাগ্যক্রমে দৈবাৎ যদি এমন শক্তিসম্পন্ন পুরুষের আবির্ভাব হয় যার প্রভাব সকলের ওপর, তবে তাঁকে পথ ছেড়ে দিতেই হবে, তার ধারাকে বিক্ষিপ্ত করতে পারবে না”।
১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কবিগুরু কালিম্পং-এ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন ও কলকাতায় চলে এলেন। দু-দিন পরে গান্ধীজীর শুভেচ্ছা বার্তা নিয়ে তাঁর একান্ত সচিব মহাদেব ভাই দেশাই জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করলেন। গান্ধীজীর চিঠি পড়ে রবীন্দ্রনাথের দু-চোখ বেয়ে জলধারা নেমে এলো। সে শুভেচ্ছা বার্তায় গান্ধীজী লিখেছিলেন, “মানবতা আপনাকে চায়, আপনি আরও কিছুদিন থাকুন”।
১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারী মাস। গুরুদেবের জীবদ্দশায় মহাত্মাজীর শেষ বার শান্তিনিকেতন ভ্রমণ। রাত্রে যে ঘরে গান্ধীজী শয্যা গ্রহণ করবেন সেই ঘরে কবি নিয়ে গেলেন তাঁকে। আয়োজনে অভিভূত গান্ধীজী বলে উঠলেন, “… এ তো বাসর ঘর। কনে কোথায়!” রবীন্দ্রনাথ বললেন, “কনে আছে”! আশ্রম ত্যাগের আগে কবি তাঁকে দিলেন খামে মোড়া একটি পত্র, বললেন, “ গাড়িতে পড়বেন”। গান্ধীজী দেখলেন, কবি লিখেছেন, “ বিশ্বভারতী আমার জীবনের শ্রেষ্ট ফসল। আমি এখন অন্য পথের যাত্রী। এর স্থায়িত্বের ভার আপনার হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলেম”। কবি লিখেছিলেন, “ accept this institution under your protection, giving it an assurance of permanence i your consider it to be a national asset. Visvabharati is like a vessel which is carrying the cargo of my life’s best treasure, and I hope it may claim special care from my countrymen for its preservation.”
প্রত্যুত্তরে গান্ধীজী লিখেছিলেন,
“ Dear Gurudev,
The touching note that you put into my hands as we parted has gone straight into my heart. Of course, Visvabharati is a national institution. It is undoubtedly also international. You may depend upon my doing all I can in the common endeavour to assure its performance.
I look to you to keep your promise to sleep religiously for about an hour during the day.
Thনough I have always regarded Santiniketan as my second home, this visit has brought me nearer to it than ever before.
With reverence and love
yours
M.K.Gandhi
Visva-Bharati News: April 1940
১৮ই ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় উত্তরায়ণ প্রাঙ্গণে ‘চন্ডালিকা’ নাটকটির অভিনয় হল। গান্ধীজী বিষ্ময় কৌতূহলে একঘন্টা ব্যাপী সে অভিনয় দেখলেন। ‘হরিজন’ ৯ই মার্চ সংখ্যায় সেই অনুষ্টানের প্রতিবেদন প্রকাশিত হল। সেখানে লেখা হল এই ৭৯ বছর বয়সেও কবি দীপ্ত, তার দৃষ্টি উজ্জ্বল, তার কন্ঠস্বর এখনও আকর্ষণীয়। কবি গান্ধীজীকে তাঁর অত্যন্ত প্রিয় নৃত্যনাট্য ‘চন্ডালিকা’ দেখবার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। প্রতিবেদক আরও লিখেছেন, “It was a sight to be remembered when at one stage he almost jumped to the edge of his seat and broke out into a musical interpolation to provide the cue when the performers had seemed to have lost it. His enthusiasm must have got an infection quality in it, for I have never seen Gandhiji follow with such sustained and rapt interest any entertainment as he did this one during the full one hour that it lasted”.
রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পর বিভিন্ন সময়ে কবির সাতটি লেখা ‘হরিজন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
যেমন ২৬শে ডিসেম্বর ১৯৪৮-এর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে’“The servent of Man”, যার মূল বাংলা ‘একদিন যারা মেরেছিল’।
“একদিন যারা মেরেছিল তাঁরে গিয়ে
রাজার দোহাই দিয়ে
এ যুগে তারাই জন্ম নিয়েছে আজি,
মন্দিরে তারা এসেছে ভক্ত সাজি”…–
“Those who struck Him once
In the name of their rulers,
Are born again in the present age”….
২৬শে জানুয়ারি-এর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে, ‘একলা চল’ কবিতার ইংরেজি ‘Walk Alone’ এবং গান্ধীজীর প্রতি কবির শ্রদ্ধার্ঘ, ‘Mahatma’।
“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।
একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো,একলা চলো রে॥
“WALK ALONE”
“If they answer not to thy call walk alone
পরস্পর পরস্পরকে লেখা একাধিক পত্রে উভয়ের সম্পর্কের গভীরতা পরিমাপ করা যায়, চিঠি থেকে বোঝা যায়। বড়মাপের দুজন চিন্তাবিদ ও কর্মীর মধ্যে দেশপ্রেম, অসহযোগ, জাতীয়তাবাদ, স্বরাজ ও চরকা নিয়ে যে সহনশীল, শ্রদ্ধা-উদ্রেককর ও সৌজন্যমূলক আচরণ প্রদর্শিত হয়েছিল, তাই স্বাধীনতা-উত্তর উপমহাদেশের রাজনীতির ভিত্তি হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল।
১৯৪১ এর ৭ই আগষ্ট রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ। কবিপুত্রকে গান্ধীজী লিখলেন, “তুমি যা হারালে আমিও তাই হারালাম, সমগ্র জাতি, শুধু সমগ্র জাতি কেন, সারা জগত তা হারালো”।…
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গান্ধীজীর কি অমিল ছিল না? অনেক ক্ষেত্রেই ছিল, তবে মিল ছাপিয়ে গিয়েছিল অমিলকে, মতানৈক্যকে। ১৯৩২ সালের ভাদ্রমাসে ‘চরকা’ প্রবন্ধে কবিগুরু লিখেছেন, “… মহাত্মাজির সঙ্গে কোনো বিষয়ে আমার মতের বা কার্যপ্রণালীর ভিন্নতা আমার পক্ষে অত্যন্ত অরুচিকর। বড়ো করে দেখলে তাতে কোনো দোষ নেই। কিন্তু তবু সব সময়ে মন মানে না। কেননা, যাঁকে প্রীতি করি, ভক্তি করি, তাঁর সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে সহযোগিতার মতো আনন্দ আর কী হতে পারে। তাঁর মহৎ চরিত্র আমার কাছে পরম বিস্ময়ের বিষয়। ভারতের ভাগ্যবিধাতা তাঁর হাত দিয়ে একটি দীপ্যমান দুর্জয় দিব্যশক্তি আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এই শক্তি ভারতবাসীকে অভিভূত না করুক, বলশালী করুক; তাকে নিজের মন দিয়ে চিন্তা করতে, সংকল্প করতে, ত্যাগ করতে শিক্ষা দিক– এই আমার কামনা”।…
১৯৪৫ সালের ডিসেম্বর মাসে শেষবার যখন গান্ধীজী শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন তখন এক জনসভায় বলেছিলেন, যে তার ও গুরুদেবের মধ্যে অমিলের খোঁজ তিনি করেছেন। কিন্তু তার এই পবিত্র উপলব্ধি হয়েছে যে তার ও গুরুদেবের মধ্যে কোনও অমিলই ছিল না। একথা অবশ্য অনেক পূর্বে, ১৯২৫ সালের ৫ই নভেম্বর তাঁর ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় ‘কবি ও চরকা’শীর্ষক প্রবন্ধে গান্ধীজী লিখেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথ ও তিনি পরস্পরের পরিপূরক।

ঋণ: রবীন্দ্ররচনাবলী, প্রমথনাথ বিশী – রবীন্দ্র সাহিত্য বিচিত্রা, গৌতম ভট্টাচার্য – হরিজন পত্রিকা, ‘রবীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্র’-নেপাল চন্দ্র মজুমদার, ‘গান্ধীজী ও নেতাজী’-ভবানীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।