সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (পর্ব – ৮)

কলকাতার ছড়া 

ইংরেজ আমলের প্রথম ফাঁসির দড়ি হাসিমুখে বরণ করেন কে? শহীদ গোপীনাথ সাহা অথবা শহীদ ক্ষুদিরাম বসু? একেবারেই না। নামটি যাঁর, ধারে-ভারে তিনি ছিলেন সেযুগের সম্ভ্রান্তদের মধ্যে একজন। শাসন হাতে তুলে নেবার পরেপরেই মিথ্যে অভিযোগে তাঁর ভয়ানক ‘আইনি হত্যা’র মধ্যে দিয়েই কলকাতা তথা বাংলার মানুষের মনে একটা ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পেরেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
মহারাজা নন্দকুমার। জন্ম বীরভূমের ব্রাহ্মণ পরিবারে। দিল্লীর বাদশা শাহ আলমের থেকে ১৭৬৪ সালে ‘মহারাজা’ উপাধি পাওয়ার পর বৈষ্ণব গুরু রামঠাকুরের থেকে দীক্ষাগ্রহণ করেন। চাকরিসূত্রে তিনি ছিলেন কোম্পানীর দেওয়ান। হুগলী, নদীয়া ও বর্ধমান অঞ্চলে দেওয়ানি সামলেছিলেন বহুদিন। তাও আবার স্বয়ং ওয়ারেন হেস্টিংসের বদলি হিসাবে। এই অপমান কখনোই ভুলতে পারেন নি হেস্টিংস সাহেব। এরপর থেকে কখনোই আর দুজনের সম্পর্কে শীতলতা ফিরে আসেনি কোনোভাবে। অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগের লড়াই অব্যাহত রেখেই দুই প্রভাবসম্পন্ন ব্যক্তির দ্বন্দ্ব কলকাতাবাসী প্রত্যক্ষ করেছে সেইযুগে। নবাব মীরজাফরের মৃত্যুর পর তাঁর নাবালক পুত্র মোবারক-উদ-দৌলার অবিভাবকত্বের আর্জিতে মুন্নি বেগমের থেকে অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগ ওঠে হেস্টিংসের বিরুদ্ধে। আর ঘটনাচক্রে অভিযোগটি আনেন মহারাজা নন্দকুমার। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এলিজা ইম্পে (যাঁর কবর আজও সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রিতে দেখা যায়) তাঁর বাল্যবন্ধু হওয়ায় সবটাই যায় নন্দকুমারের বিপরীতে। আর ফল হয় মিথ্যে জালিয়াতির অভিযোগে প্রকাশ্যে ফাঁসি। প্রসঙ্গত বলে রাখি, তখন কথায় কথায় ফাঁসি দেওয়ায় নতুন শাসক ছিল সিদ্ধহস্ত। জনসমক্ষে ফাঁসি প্রদর্শনের জন্য রাস্তায় গাছের নীচে তৈরি থাকতো ফাঁসির মঞ্চ। বর্তমানে রাজভবনের কাছে ফ্যান্সি লেন কলকাতার এক পরিচিত গলি। আজকের কলকাতাবাসী যতই এই নামটি অভিজাত ভঙ্গিতে উচ্চারণ করুন না কেন, আসলে এই নামের উৎস খুঁজতে গেলে চমকে উঠতে হয় বৈকি। সেই রাস্তাতেই নাকি ছিল এমন একটি ফাঁসির মঞ্চ। আর ‘ফাঁসি’ই ইংরেজি অপভ্রংশে হল ‘ফ্যান্সি’। যেখানে সামান্য ঘড়ি চুরির অপরাধে ফাঁসি দেওয়া হয় এক জনৈক দেশীয় কর্মচারীকে। যাই হোক, ওয়ারেন হেস্টিংসের সাথে বিবাদের ফলস্বরূপ একরকম বিনাদোষেই ফাঁসির মঞ্চে উঠতে হয় মহারাজা নন্দকুমারকে। বাংলার ইতিহাসে এ এক সাড়াজাগানো ঘটনা। আর এই ভয়ঙ্কর ঘটনার পর কলকাতার বাঙালী সমাজ ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায়। এমনকি বহু পরিবার কলকাতা ত্যাগ করে পাড়ি দেন বারাণসী। আজও তাঁদের পরিবার বারাণসী নিবাসী।
এহেন মহারাজা নন্দকুমারকে নিয়ে সেযুগের কলকাতাবাসী এই ছড়া আওড়াত –
“ভাদুরের নন্দকুমার,
লক্ষ ব্রাহ্মণের করলে সুমার
কেউ খেলে মাছের মুড়ো
কেউ খেলে বন্দুকের হুড়ো”

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।