সাপ্তাহিক ধারাবাহিক প্রবন্ধে মানস চক্রবর্তী – ১৪

|| ১৪ || 

তাঁর হাই থিকিং এর ফলশ্রুতি ১৯৬১ সালে দ্বারহাট্টা রাজেশ্বরী নিম্নবুনিয়াদী বিদ্যালয় স্থাপন , ১৯৬৪ তে দ্বারহাট্টা রাজেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন | দ্বারহাট্টা বিবেকানন্দ পাঠাগার স্থাপনও ছিল তাঁর কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত |
একজন শিক্ষকের প্রধান গুণের মধ্যে লক্ষ্যণীয় তিনি ছাত্রদরদী কিনা ? ব্রহ্মচারী মহারাজ সেখানেও সফলতম ব্যক্তি | কোনো ছাত্রের প্যাণ্ট ছিঁড়ে গেছে , কে খেয়ে আসেনি , কার পয়সার অভাবে বই কেনা সম্ভব হয়নি এসব ব্যাপারে তিনি সজাগ দৃষ্টি রাখতেন | প্রত্যেক মাসেই তিনি তাঁর মাইনে থেকে কিছু গরীব ছেলেমেয়েদের জুতো , বই কিনে দিতেন | এক বার এক ক্লাস নাইনের ছাত্রের লুঙ্গি পরে বিদ্যালয়ে round দেওয়া লক্ষ্য করলেন | ছাত্রটিকে খুব ধমক দিয়ে আদেশ করলেন বিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা অনুযায়ী পোশাক পরে আসতে | পরক্ষণেই তার ডাক পড়ল প্রধান শিক্ষকমহাশয়ের ঘরে | কারণে ছাত্রটি জানাল , লুঙ্গি ছাড়া স্কুলে পরে আসার মতো আর কিছু ছিল না | শোনার পর তৎক্ষণাৎ তিনি বাড়ি থেকে একটি ধুতি এনে ছাত্রটিকে দিলেন |
কিন্তু কোনো শিক্ষার্থী অন্যায় করলে তিনি শাসন করতে পিছপা হতেন না | সকাল সন্ধ্যা দু’বেলায় ছাত্রাবাসে প্রার্থনা হতো | সেখানে সকল ছাত্রকে উপস্থিত থাকতে হতো এবং তিনি নিজেও উপস্থিত থাকতেন | একবার সন্ধ্যাকালীন প্রার্থনায় একটি ছাত্র কথা বলল এবং হাসল | প্রার্থনার শেষে ব্রহ্মচারী মহারাজ ছাত্রটিকে ডেকে পাঠিয়ে উইকেট দিয়ে মারলেন | পরে ছাত্রটিকে ডেকে বুকে জড়িয়ে সে কী কান্না  ! শিক্ষক কাঁদছেন , ছাত্রও কাঁদছে | এক স্বর্গীয় দৃশ্য | কথায় আছে – শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যেজন | সেই সন্ধ্যাটিতে ঘটে গেল তারই বাস্তব প্রতিফলন |
ছাত্রদেরকে পড়ানোর আগে ছাত্রদেরকে ভালো করে পড়তে হবে এটা তিনি খুব মানতেন | এইজন্য তিনি জুনিয়র টিচারদেরকে ছেলেদের ফ্যামিলি হিস্ট্রি জেনে নেবার কথা বলতেন | কোন্ পরিবেশ থেকে আসছে , অর্থনৈতিক অবস্থা কীরূপ জানা থাকলে study করতে সুবিধা হয় | তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ আত্মনিবেদিত প্রাণ |
তিনি সাধারণত কঠোর শাসন দ্বারা কড়া বাক্য দ্বারা সংশোধনের বিরোধী ছিলেন | তাঁকে রেগে গিয়ে কড়া কথা বলতে কেউ কখনো শুনেনি | এক প্রাক্তন ছাত্র তার  স্মৃতিচারণায় জানাচ্ছে সে নাকি রোজ চা করতে যাবার সময় দেশলাই খুঁজে পেত না এবং ব্রহ্মচারী মহারাজ যেখানে পুজো করতেন সেই টেবিলে রাখা দেশলাইটা নিয়ে আসত আর রেখে আসতে ভুলে যেত | কিন্তু ব্রহ্মচারী মহারাজ দিনকয়েক একই সমস্যায় পড়ার পর একদিন চায়ের জায়গায় বাজার থেকে এক বাক্স দেশলাই কিনে এনে রেখে দিলেন | ছাত্রটি জানিয়েছে সে নাকি শুধু ভুলই বুঝতে পারেনি , সঙ্গে সঙ্গে সুন্দর শিক্ষালাভও করেছে |
তাঁর একটি নেশার জিনিস ছিল সংবাদপত্র পাঠ | তাঁরই ছাত্র আনন্দ মোহন বসুর লেখাতে আছে , “প্রতিদিন বাংলা সংবাদপত্রটি খুঁটিয়ে পড়া ও অমৃতবাজারের cross word টি পূরণ করা ছিল তাঁর দৈনন্দিন কাজের মধ্যে অন্যতম | বিশেষ করে আনন্দবাজারের অরণ্যদেব ও গোয়েন্দাগিরি পড়ার জন্য অত্যন্ত উদগ্রীব হয়ে থাকতেন , সংবাদপত্র পড়ার এত নেশা ছিল যে জীবনের শেষ পর্যাযে হাসপাতালে যখন মৃত্যুর সাথে লড়াই করছেন , তখনও ওনাকে সংবাদপত্র পড়ে শোনাতে হত | প্রকৃতপক্ষে তিনি দেশ ও সমাজ সম্পর্কে সবসময় ওয়াকিবহাল থাকতে চাইতেন |”
প্রতিশ্রুতিমতো ডাইরি প্রসঙ্গে আসি | ডাইরিতে পরের দিনের কর্মসূচী রাতেই লিখে রাখতেন ‘অদ্যকার কর্মসূচী’ শিরোনামে | পরেরদিন এক একটা কাজ শেষ করতেন ও টিক মার্ক দিতেন | কোনো কাজই বাদ পড়ত না |
বহুল প্রচলিত একটি বাণী , যেটা অবশ্যই ক্লাসিক – উত্তম নিশিন্তে চলে অধমের সাথে / যিনিই মধ্যম তিনিই চলেন তফাতে | যিনি মানেন এবং যিনি পারেন তিনিই উত্তম | ব্রহ্মচারী মহারাজ নিসন্দেহে পেরেছেন | মহারাজজীর যখন কোথায় যাবার প্রয়োজন হয়ে পড়ত তখন দ্বারহাট্টার হাটতলার কালোর রিকসাতেই যেতেন | এই কালো সারাদিন আকণ্ঠ মদ্যপান করে থাকতেন | তবু তার সঙ্গে ছিল তাঁর প্রাণের সখ্যতা | এই সখ্যতা শুধু মানুষের সঙ্গে নয় , পশুপাখিরাও এর অংশীদার ছিলেন | ভোম্বল নামে মহারাজের এক কুকুর ছিল | শুনতে অবিশ্বাস্য হলেও কুকুরটা মহারাজের সঙ্গে সিনেমা হলেও যেত | আশ্চর্যের বিষয় তখন কুকুরের মধ্যে স্বভাব জনোচিত চাপল্য থাকত না | উনি যখন ক্লাস করতেন ভোম্বল তখন টেবিলের নীচে চুপ করে শুয়ে থাকতেন |
মানুষের অসম্ভব রকম ভালোবাসা পেয়েছিল এই  মহান মানুষটি | সেই সুখস্মৃতির স্মরণ নেব | ব্রহ্মচারী মহারাজ রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে কেউই তাঁকে অতিক্রম করে চলে যেতেন না | সাইকেল থেকে নেমে পড়তেন | উনিই পিছন ফিরে তাকিয়ে চলে যাবার কথা বলতেন , “যাও সব চলে যাও |” হরিপাল থেকে যে সব বাস যাতায়াত করত সেইসব বাসে মহারাজের কোনো ভাড়া লাগত না | খুব ভিড় বাসেও মহারাজের বসার স্থান সঙ্কুলান হতো না |  হৃদয় ভরা ভালোবাসার অর্ঘ্য শিক্ষকজীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি – যা মহারাজ পেয়েছেন |
তাঁরই এক ছাত্রের লেখা কবিতার শেষ দু’লাইন দিয়ে এ শ্রদ্ধাঞ্জলি শেষ করব –
“তোমার জীবন তো নয় ছিলে মূর্ত বাণী
 করিতে দশের সেবা তোমার আদর্শ মানি | “

কৃতজ্ঞতা স্বীকার : 
ব্রহ্মচারী জ্যোতির্ময় চৈতন্য জন্মশতবার্ষিকী স্মরণিকা ১৯০৭ – ২০০৭

( চলবে )

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।