(৬)
রবিবারের সকাল ,সোহাগের বাড়িতে হই হই রমরমা কান্ড। অমিত বাবু থলি ভর্তি বাজার করে, স্নান করে, সাদা পাতলুন হলুদ পাঞ্জাবী পড়ে ছেলে পক্ষের আসার অপেক্ষা করছেন। চিরাগকে মিষ্টি আর দই আনার দায়িত্ব দিয়েছেন ।কাকলি দেবী হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘর ডাইনিং দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর যাকে ঘিরে এত তোড়জোড় সেই সোহাগ মায়ের জোরাজুরিতে লাল ঢাকাই হলুদ ব্লাউজের সাথে পড়ে বসে আছে নিজের ঘরে। কপালে একটা ছোট্ট লাল টিপ, গলায় আর কানে লাল হলুদ মেশানো মাটির মূর্তির গয়না, হাতে লাল কাঠের উপর কালো মধুবনি কাজের বালা।
সোহাগের আজ বড্ড মন খারাপ ।কেন তার মতের বিরুদ্ধে সকলে এমন হাড়িকাঠে তার গলায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে সে নিজেও বুঝতে পারছে না। শুধু নিজেকে বলির পাঁঠা মনে হচ্ছে বারবার সরি পাঁঠি আর চিরাগ— চিরাগকে দেখে ভারী রাগ হচ্ছে তার। সোহাগের বিয়ে হবে বলে চিরাগের মনে যেন আনন্দের শেষ নেই, দেখে মনে হচ্ছে ফুর্তির প্রান গড়ের মাঠ ।সকাল থেকে কত কাজ ই না করছে। সব এক একটা শত্রু। একটু না হয় খেতে ভালোবাসে ও। তার জন্য দুচার পয়সা খরচ হয় বলে এমন বলির পাঁঠা বানানো উচিত ?রাগে দুঃখে ক্ষোভে অভিমানে সোহাগের গা রি রি করছিল ।তাই মাঝে দুদিন ফোন করলে, মেসেজ করলেও তার কোন উত্তর দেয়নি সোহাগ ।খালি মনে মনে বলেছে ,”যা ভ্যাবলা সারা জীবন ভ্যাবলাকান্ত হয়েই ঘোর । কক্ষনো তোর সাথে কথা বলবো না।”
হলোটা কি সোহাগের ।নিজের ঘর থেকে বেরোচ্ছে না। চিরাগ ডাইনিংয়ে বসে উস খুশ করতে লাগলো সবার মাঝে। পাত্রপক্ষ এসে হাজির। অংশু ছেলেটা অতটা ডেস্পারেট না হলেও একটু ভালো মানুষ নিরীহ টাইপের মনে হল চিরাগের। সোহাগ যেই জিন্স আর শার্ট পরে আসবে অমনি বেচারীর আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যাবে এটা ভাবলেই ছিল পেটের মধ্যে হাসির রোল হুলস্থুল পাকাচ্ছিল। অংশুর সাথে বিয়েটা কেটে গেলেই মোটির সাথে আবার ভাব হয়ে যাবে চিরাগের। এটা ভাবলেই মনটা আরাম লাগছিল তার। বাবাঃ এই যে দুদিন মধ্যে কথা বলেনি, চিরাগের যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে ।মেয়েটার মাথায় ছিট আছে, কাঁদলো কেন কে জানে ।সেই স্কুলে পড়ার সময় একবার সোহাগ ইতিহাসে কম নম্বর পেয়েছিল বলে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছিল কি মিষ্টি লাগছিল থুতনির কাছটা সেদিন যখন সব ফোনে কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছিল ওই মুখটাই মনে পড়ে যাচ্ছিল চিরাগের। পাগলি একটা ,মনে মনে এসব ভাবতে ভাবতে সামনে তাকাতেই হাঁ হয়ে গেল মুখটা এতটাই যেন দশ টাকার লাড্ডু অনায়াসে মুখের মধ্যে টপ করে ঢুকিয়ে দেয়া যাবে। সোহাগকে চেনাই যাচ্ছেনা ।লে হালুয়া পা দুটো এমন কাঁপছে কেন রে বাবা । সোহাগ যেন ভিনগ্রহের কোন প্রাণী এমনভাবে দেখছিল চিরাগ। মুখটা এমন স্নিগ্ধ ,কোমল ,মোহময় হয়ে গেল কি করে রে বাবা ।সোহাগের কি যমজ বোন আছে নাকি ?সেটাই বা কি করে সম্ভব রাতারাতি ।পাল্টে গেল কি করে এই দুদিনে?চোখ দুটো এত সুন্দর আগে দেখেনি তো কখনো ?আবার কাজল পড়েছে।চিরাগের হঠাৎ ভীষণ রাগ হল ।সোহাগ যে দুমুখো সাপ তা তো জানতো না ।এই যে বলল ওর নাকি মেনিমুখো কে বিয়ে করতে প্রবল আপত্তি— তার জন্য এত সাজ!আরো রাগ হলো যখন সোহাগ তার দিকে একবারও না তাকিয়ে মুখ নামিয়ে সবার আলোচনাতে সায় দিচ্ছিল। শেষ ঘটনা টা আর নিতে পারল না যখন আশীর্বাদ শেষে এক সপ্তাহ পরেই রেজিস্ট্রির দিন ঠিক হয়ে গেল । ক্ষোভে রাগে ভিতরে ভিতরে জ্বলে উঠেছিল চিরাগ অথচ কারন টা বুঝতে পারছিল না। যখন অংশু আর সোহাগ পাশের ঘরে চলে গেল নিভৃতে কথা বলার জন্য, তখন চিরাগ আর সামলাতে না পেরে বলেই ফেলল ,”আন্টি এখন আমায় বাড়ি যেতে হবে ,আসলে বাড়িতে একজন আসার কথা আছে।”
“লাঞ্চ করবি না এখানে ?”কাকলিদেবী অবাক হয়ে বললেন
“না আন্টি আজ আর হবেনা!”
তবুও সোহাগ একবারও চিরাগের দিকে তাকায় নি তখন থেকে ।গুমর দেখিয়ে অন্য ঘরে চলে গেছিল আর তখনই সোহাগদের ডাইনিং এর বড় ঘড়ি তে ঢং ঢং করে বারোটার ঘন্টা বেজে ছিল চিরাগকে চমকে দিয়ে ।রাস্তায় এসে যখন দাঁড়িয়ে ছিল তখন খাঁ খাঁ করছিল চারিদিক। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গেছিল। উল্টোদিকের দোকান থেকে একটা কোল্ড্রিংসের বোতলের ছিপি খুলে ফসস করে বেশ খানিকটা ফেনা উপচে ফেলে ঢকঢক করে খেয়ে গলা ভেজালেও বুকের ভেতর টা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। ময়দানের খোলা মাঠে মোটির সাথে খুনসুটি, একপ্লেট বিরিয়ানি কাড়াকাড়ি করে খাওয়া, হলুদ ট্যাক্সির পাশে ট্রামে চেপে ধিক ধিক করে চলা সব স্মৃতি বুকের ভিতর ঘা মারছিল হাতুড়ি দিয়ে বারবার ।কে যেন বলছিল মোটিকে ছাড়া চলতে পারবে তুমি ?মরুভূমির মধ্যে এদিক ওদিক খালি হাতড়ে বেড়াবে। একটু না হয় বেশি খেলো চিরাগকে তো কম প্রশ্রয় দেয় না সোহাগ। হঠাৎ সোহাগের উপর খুব রাগ হল চিরাগের। কি দরকার ছিল ওই মেনিমুখোর সাথে অন্য ঘরে এমন করে কথা বলবার। এতক্ষণে শান্তি হলো সোহাগের দেওয়া নামটা মনে পড়ে ।আরো আবিষ্কার করলো মনে মনে সোহাগকে ছাড়াও একদিন তো থাকতে পারবে না, সোহাগ কে ও ভালোবাসে ,কিন্তু কোনদিন তো বুঝতে পারেনি। ভালোবাসে তো বেশ করেছে। কিন্তু সোহাগের যে আশীর্বাদ হয়ে গেল রেজিস্ট্রি ঠিক হয়ে গেল কি করবে এখন চিরাগ! না না সোহাগকে অন্য কারোর সাথে চলে যেতে দেখতে পারবে না চিরাগ। তাহলে উপায় ?পালাবে পিসির বাড়ি বর্ধমানে! কিন্তুপর হয়ে যাবে যে সোহাগ।আর সিগারেট ভাগাভাগি করতে পারবেন না ভদকা খেয়ে খিল্লি করতে পারবে না হঠাৎ নিজেকে দেবদাস দেবদাস মনে হলো ,মনের বেলুন টাতে যেন একটা পিন ফুটিয়ে কে ফুসস করে সব হাওয়া বের করে দিল।ফোনটা বেজে উঠল, স্ক্রিনে ভেসে উঠল অনন্যা কলিং।
দুবার কেটে দিল ।বার বার অনন্যার ফোন আসতে থাকায় চিরাগ ফোনটা ধরে নিজেকে চমকে দিয়ে বলল “কেন ফোন করছ তুমি ? বার বার কেটে দিচ্ছি —আচ্ছা বেয়াদপ মেয়ে তো তুমি ,একদম জ্বালাবে না বলে দিলাম,যত সব উটকো ঝামেলা।”