• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে শম্পা রায় বোস (পর্ব – ১৯)

আমার মেয়েবেলা

মাধ্যমিক পরীক্ষা

মাধ্যমিক পরীক্ষার সিট পড়েছিল ধুলিয়ান এর কাঞ্চন তলা স্কুলে। তাই আমাদের বাসে করে যেতে হত। সকাল সারে সাতটায় স্কুলের সামনে থেকে বাস ছাড়ত।
পরীক্ষা শুরুর দিন সাতটার সময় বাস ছাড়ল। সবারই একটা টেনশন। চিরকাল হেঁটে স্কুলে গিয়েছি। বাসে ট্রেনে চড়া অত অভ্যেস নেই । আমার আবার পেট্রলের গন্ধে বমি পায়। আসলে আমাদের তো সেই সময় অত ঘোরা বেড়ানো ছিল না। বছরে একবার ঠাকুমা বা মামার বাড়ি যাওয়া। তাও সেই বমি করতে করতে। ট্রেনে তো যাওয়াই হত না।
যাইহোক বাস থেকে নামলাম ঠিক সারে আটটায় সময়। ১০ টায় পরীক্ষা আরম্ভ। মোটামুটি একঘন্টা রেস্ট পাব। বাবার সব ব্যাপারেই একটু তাড়াহুড়ো ছিল। কোথাও গেলে স্টেশনে পৌঁছাত ট্রেন ছাড়ার দুঘণ্টা আগে। তাড়াহুড়ো করে সাতটায় বাস রওনা করিয়েছে। যদি বাস খারাপ হয়ে যায়, যদি কারোর শরীর খারাপ করে, যদি রাস্তায় জ্যাম হয়,,,,কত রকম যে বাহানা ,,,,,,
পেটে ব্যথা কমে গেছে। মুখে চোখে একটু জল দিয়ে রেস্ট নিচ্ছি। সারে নটায় স্কুলে ঢুকতে গিয়ে দেখি হৈ হৈ ব্যাপার। কী হল? দেখি আমাদের এক বন্ধু পাপিয়া অধিকারী এডমিট কার্ডই আনেনি। কী অসম্ভব একটা ব্যাপার! বাবা সেই স্কুলের
(কাঞ্চনতলা স্কুল) হেড মাস্টারের হাতে পায়ে ধরে যা হোক করে রাজি করিয়ে পাপিয়াকে পরীক্ষার হলে বসাতে পেরেছিল। টেনশনে আমার শরীর খারাপের কথাটাই ভুলে গিয়েছিলাম। আমরা তিরিশটা মেয়ে সেবছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে ছিলাম। তাই রোল নম্বর মোটামুটি জানাই ছিল। আমাদের স্কুলের হেড স্যার কে জিজ্ঞেস করে ওর রোল নম্বর কনফার্ম করা হল। সবার এডমিট কার্ডের একটা করে জেরক্স কপি আমাদের হেড স্যার (AKG স্যার) রেখে দিয়ে ছিলেন।। পাপিয়া বার ক্লাস পরীক্ষার (প্রথম দিন) সময়ও এডমিট কার্ড নিয়ে যায় নি। সেবার সিট পড়েছিল মালদায়। সেই আমার বাবাই সামলে ছিল। তারপর থেকে ওর এডমিট কার্ড আগে দেখা হত তারপর বাস ছাড়া হত।।
মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় গার্জেন দের তরফ থেকে বাবাই যেত। ফার্স্ট হাফের পরীক্ষা একটায় শেষ হত।
সেকেন্ড হাফ পরীক্ষা শুরু হত দুটোর সময়। মোটামুটি সব মিলিয়ে পঁয়তাল্লিশ মিনিট মত টাইম পেতাম খাওয়ার জন্য। বাবা সবার দিকে খেয়াল রাখত। কেউ টিফিন আনতে ভুলে গেলে তাকেও বসিয়ে খাওয়াত দই আর ছিঁড়ে। মা একটু বেশি করেই দিয়ে দিত। কেউ যদি টিফিন আনতে ভুলে যায়। তারপর ডাব খেয়ে ঢুকে পড়তাম পরীক্ষার হলে।
বেশ মনে আছে ৬ই এপ্রিল পরীক্ষা শুরু হয়েছিল । বেশ গরম তখন। আমরা সবাই গাছের ছায়ায় বসতাম। ফার্স্ট হাফের পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে এসে দেখতাম বাবা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে খাবারের ঝোলা। বাবাকে দেখামাত্র ছুট্টে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরতাম। বাবা আমাকে খাবারটা দিয়ে বলত,” তুই খা আমি একটু সবার খোঁজ নিয়ে নি। বাবা সবাইকে জিজ্ঞেস করত পরীক্ষা কেমন হয়েছে টিফিন এনেছে কিনা, শরীর খারাপ করছে কিনা, পেনের কালি আছে কিনা। “কোন দরকার হলে আমাকে বলবি কিন্তু তোরা। আমি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকব।”
বাবাকে দেখতাম আর চোখ মুছতে মুছতে দই চিঁড়ে খেতাম। কিছুতেই মানুষ টাকে এক জায়গায় বসাতে পারতাম না। যতক্ষণ না আর একটা পরীক্ষা আরম্ভ হচ্ছে বাবা শুধু দৌড়ে বেড়াত। ওদিকে আবার ছেলেরা পরীক্ষা দিচ্ছে তাদেরও খোঁজ নিত। বাবাকে দেখে তখন খুব কষ্ট হতো আমার। রোদে বাবার ফর্সা মুখটা লাল হয়ে যেত। বাবাকে দেখে শিখে ছিলাম কীভাবে সবার সঙ্গে মিশে যেতে হয়। ভাগ করে নিতে হয় সব কিছু। কোন দিন একা খেতে শিখিনি, একা আনন্দ করতে শিখিনি, একা দুঃখ করতে শিখিনি। আমরা দুই ভাই বোন সেভাবে একা মানুষ হইনি। পাড়ার মধ্যে আলাদা আলাদা কোয়ার্টার এ থাকলেও আমরা ছিলাম একান্নবর্তি পরিবারের মতো। মায়ের রাঁধা ভাত পাশের বাড়ির কাকিমার ডাল আর এক কাকিমার তরকারি খেয়ে আমরা সেই সময় অনেকেই স্কুলে গিয়েছি। হৈ চৈ আনন্দে বিপদে আপদে সবার আগে আমার বাবা মা থাকত। এটাই স্বাভাবিক মনে করতাম। আর এভাবেই কবে যেন বড়ো হয়ে গেলাম! দেখতে দেখতে একা হয়ে গেলাম। পাশে যখন সব থেকে বেশি দরকার ,,,,,, তখন দেখলাম ও বাবাআআআ কেউ নেই তো! কেউ নেই,,,,,,
যাইহোক দেখতে দেখতে হৈ হৈ করে অংক পরীক্ষা চলে এল।
পরীক্ষার দিন বাবাকে কুড়ি পাবই কথা দিয়ে খুব কনফিডেন্টলি পরীক্ষার হলে ঢুকেছিলাম।
ক্রমশঃ
আমার ক্লাসে আমরা তিনজন শম্পা ছিলাম। আর
মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় আমরা তিন শম্পা বেশ কাছাকাছিই বসে ছিলাম। এই দুই শম্পা অংকে খুব ভাল। বলা যায় পড়াশোনাতেও খুব ভাল। এক শম্পা (ভট্টাচার্য ) আমার সামনে। আর আর এক শম্পা (মিত্র) আমার পাশে। শম্পা মিত্রকে বললাম, বীজগণিত আর জ্যামিতি পারব ।কিন্তু পাটিগণিতটা একটু সামলে দিস্ ভাই।
এর পর একসঙ্গে অংক করতে শুরু করলাম। মোটামুটি যখন বুঝলাম আমার পাশ নম্বর উঠে গেছে তখন শম্পা কে বললাম, আর তোর খাতা দেখব না। আমি আর তুই অংকে এক নম্বর পাব এটা হয় না। অধর্ম হবে।
অংকে পাশ করে যাব।ব্যাস্ আমি এটুকুতেই খুশি।
আমি ইচ্ছে করলে পুরোটাই ওর দেখে অংক করতে পারতাম। আর ওর মতো আমিও হয়তো ৮০|৯০ পেয়ে যেতাম। কিন্তু আমি সেটা চাইনি।
ছোট থেকেই আমার চাহিদা ছিল খুব কম। যতটুকু চাইতাম ততটুকু পেলেই খুশি হতাম। অনেক পাবার কথা কোনও দিন ভাবিই নি।
তখন থেকেই পাপ পুণ্য ধর্ম অধর্ম এসব খুব মানতাম আর বিশ্বাসও করতাম। পাওয়ার পরও আরও কত বেশি পাওয়া যায় এই চিন্তা কোনও দিন মাথায় আসে নি। আমার বাবা এবং মা যেমন ছিলেন সৎ এবং ভগবান বিশ্বাসী আমাদের দুই ভাইবোন কেও তেমন ভাবেই মানুষ করেছিলেন। আমাদের কোনও চাহিদা ছিল না বলেই হয়তো ভগবান আজ আমাকে যা দিয়েছেন তা কোনও দিন স্বপ্নেও ভাবি নি।
সবসময়ই বাবা কে অনুসরণ করতাম।
বাবার মতো যতটা সম্ভব সকলের উপকার করার চেষ্টা করতাম। সেই সময় আমি যে আবেগে ভেসে যাওয়া কতটা সরল বোকা একটা মেয়ে ছিলাম আজ সেটা বুঝতে পারি, তাও এই বয়েসে এসে।
আমি মাধ্যমিকে পেয়েছিলাম ৫০। এটাই আমার জীবনে অংকে সর্বোচ্চ নম্বর। এবং তারজন্য আমি সব ক্রেডিট টাই আমার বন্ধু শম্পা মিত্রকে দিতে চাই। ও না থাকলে হয়ত আমি সেবার মাধ্যমিকে গাড্ডা খেতাম।
আমাকে অংক শুরু করার আগেই বলেছিল একদম ঘাবড়াবি না। ঠিক পারবি। তুই শুরু কর। ভুল হলে আমি বলব। ধীরে ধীরে অংক করতে শুরু করলাম। অংক শেষে উত্তর টা ওর খাতা দেখে মিলিয়ে নিলাম। যেই অংক মিলতে লাগল আমারও কনফিডেন্স বেড়ে গেল। সেইদিন জীবনে শিক্ষা পেয়েছিলাম কঠিন পরিস্থিতির সময় কিভাবে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়।
সারা জীবন ওকে মনে রেখেছি। ও যেন আমার শরীরের সঙ্গে মিশে আছে।
পরবর্তীতে ও হাবার্ট ইউনিভার্সিটি তে পড়াত।
আমার সব থেকে বড্ড আপসোস এই কারণে যে হায়ার সেকেন্ডারির পর আমার আর কোনো দিন ওর সঙ্গে দেখা হয় নি। শেষ চিঠি পেয়ে ছিলাম ওর বিয়েতে। ও আসতে বলেছিল। কিন্তু আমার যাওয়াই হয় নি। আর কোন দিন ওর সঙ্গে আমার দেখা হবে না। কারণ ও আমাদের সকলকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছে। আমেরিকাতেই ও মারা যায়।
বড্ড কষ্ট হয় ওর জন্য। খুব ভালোবাসতাম ওকে। ওর মধ্যে কোনও অহংকার ছিল না। খুব ভাল মেয়ে ছিল। ওর অভাব আমাকে খুব খোঁচা দেয়।
আমার আর এক বন্ধু শম্পা সেও খুব ভাল। শান্ত বিনয়ী আমার এই বন্ধুটি যেন ঠান্ডা বাতাস। খুব আস্তে আস্তে কথা বলে, ধীর স্থির। আমাকে যেন বটগাছের মতো আশ্রয়ে রাখে। আমার প্রতিটি কঠিন পরিস্থিতিতে মায়ের মতো হাত বাড়িয়ে দেয়। পরম মমতায় আমার মনের ক্ষত গুলো যে কিভাবে সারিয়ে তোলে বুঝতেই পারি না।
বর্তমানে ও একটি সরকারি স্কুলের প্রধানা শিক্ষিকা।আমরা আমাদের সব বন্ধুরাই খুব মিস করি আমাদের হারিয়ে যাওয়া সেই মেধাবী মিষ্টি শম্পা কে।
স্কুলের জীবনটা আমার দারুণ ছিল। অংক ক্লাস বাদ দিয়ে সব ক্লাসেই আমি পড়া শুনতাম খুব মন দিয়ে।
মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে
মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলাম। তাই এই পরীক্ষার গুরুত্ব অত বুঝতাম না। অংক ক্লাসে দরজা দিয়ে পাখি ওড়া দেখতাম।
কোনও কোনও সময় জল খাওয়ার নাম করে বারান্দায় এসে নীল আকাশ দেখতাম। সারি সারি পাখি ওড়া দেখতে দেখতে কটা পাখি উড়ে গেল সেটাও গুণতাম। আর সমান ভাবে কি করে উড়ে যাচ্ছে এটা ভেবেও অবাক হতাম।
অংক ক্লাসে বসে আমার ভাবনার শেষ ছিলনা। চৌবাচ্ছা জলের অংক,আর একটা বাঁশের উপর বাঁদরের ঐ এগিয়ে যাওয়া আর পিছিয়ে আসার অংক যেদিন শিখেছিলাম সেই দিনই বুঝে গিয়েছিলাম আর যার জন্যই হোক অংক আমার জন্য নয়। আমার বাংলা ইংরেজি ইতিহাস ভূগোল জীবন বিজ্ঞান লজিক সব বেশ ভাল লাগত। কিন্তু অংকটাকেই কোনও দিন ম্যানেজ করতে পারিনি।
আমি খুব ছোট্ট থেকেই একটু ভাবুক প্রকৃতির মেয়ে ছিলাম।
চৌবাচ্চার জলের সঙ্গে মেলাতে চেয়ে ছিলাম জীবনের ওঠাপড়া।
পাঁজরের কোণায় কোণায় সবটুকু ভালোবাসা দিতে গেলে, সময়ের খাতায় কতটুকু অভিমান জমা থাকে তার হিসেব করতাম।
আবার বাঁশের ঐ বাঁদর টার মতো এগিয়ে যাওয়ার পর কতটা পিছোলে, আর এগিয়ে যাওয়ার অংকটাই যে থাকে না,,, এসব ভাবনা সেই তখন থেকেই।
আসলে বই এর অংক কষতে গিয়ে জীবনের আসল অংক শিখে ফেলেছিলাম খুব অল্প বয়েসে। যার ফলে আমি ভেতরে ভেতরে খুব পরিণত হয়ে উঠেছিলাম, যেটা সেই সময়ে আমার জন্য একদমই ভাল ছিল না।
আমর সঙ্গীত-
জনগণ মন,,,বিভিন্ন সুরে এবং বিভিন্ন উচ্চারণে চোখ বন্ধ করে ভ্রু কুঁচকে গলার শিড়া ফুলিয়ে গাইতাম,,” নিজেকে
ফার্স্ট পিরিয়েড থেকেই আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো।Because at that time I was the most talkative girl in my class.
শাড়ি, খুব সুন্দর করে বেশ গুছিয়ে পড়তেন। কি স্মার্ট ছিলেন দিদি!!! দিদির একটা কথা আজও মনে আছে আমার। এখনও স্পষ্ট মনে আছে। রসায়ন বিদ্যা আমার যে খুব ভালো লাগত তা নয়। কিন্তু স্যার এত সুন্দর পড়াতেন!! আমার খারাপ লাগত না।
আমার প্রিয় বিষয় ছিল ইতিহাস ভূগোল বাংলা ।
ইতিহাস পড়াতেন স্বপ্নাদি।
স্বপ্না দি এত সুন্দর পড়াতেন যে চোখের সামনে যেন সব ভেসে উঠত। এক এক করে,,,,পলাশীর যুদ্ধ,, সিরাজদৌল্লার পরাজয়,,মীরজাফর এর বেইমানি,,1905 এর বঙ্গভঙ্গ,,,
লাস্ট পিরিয়েড,, দিদির ক্লান্ত চোখ,,কপালে ধেবড়ে যাওয়া সিঁদুরের টিপ,,দিদি বলছেন “”পলাশির যুদ্ধে সিরাজের পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষের স্বাধীনতা র সূর্য অস্তমিত হয়েছিল।”— বলতে বলতে দিদির গলাটা একটু কেঁপে গিয়েছিল। আমরা সবাই কেঁদে ফেলেছিলাম। সেই রাত একটা না বলা যন্ত্রণা আমাকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল। কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়েছিলাম।
ক্লাস নাইনে পড়ি। পাশের লাল বিল্ডিং টায় পদার্থ বিজ্ঞান এর ক্লাস চলছে। আমরা ছেলে মেয়েরা একসঙ্গে ক্লাস করছি। গোপ স্যার প্রাণপণে আমাদের বোঝাচ্ছেন,, “ভর” আর “ভারের” পার্থক্য। 45 মিনিট ধরে আমিও খুব মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম। ক্লাস শেষ হলে স্যারের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।স্যার বললেন,”” কি হল শম্পু রাণী? মাথায় কিছু ঢুকল?””—- স্যার কে প্রণাম করে বললাম,””আপনার বোঝানোয় কোনও ফাঁক নেই। কিন্তু পদার্থ বিদ্যা আমার জন্য নয়। আমি আইন নিয়ে পড়াশোনা করব।”শেষ পর্যন্ত আমি আইন নিয়েই পড়াশোনা করেছিলাম ।
তোমার কথা গুলো পড়তে পড়তে চলে গিয়ে ছিলাম সেই স্কুলে। চোখের সামনে এস কে বি আর স্যার এস পি ডি স্যার যেন ভেসে উঠল। কি স্মার্ট ছিলেন এস কে বি আর স্যার! সাদা জামা সাদা প্যান্ট কালো জুতো, স্টাউট চেহারা।। যাকে বলে সত্যি কারের পুরুষের মতো চেহারা। খুব ভালো লেগেছিল জান? কি সুন্দর পড়াতেন বল? আমার মোটা মাথাতেও তাঁর পড়া ঠিক ঢুকে যেত।
আজ এত বছর পর ঐ সেই ছোট্ট কিশোরী কে যেন ছুঁতে পারলাম। কি যে ভাল লাগত স্যার কে।
কাউকে ই বলতে পারিনি কোনও দিন। আমার এমন ই একটা প্রেমিক চাই। ক্লাস নাইন মনটা উড়ুউড়ু। সব কিছু ই যেন ভাল লাগছে।
একটু একটু বড়ো হচ্ছি। কৈশোর ছেড়ে যাচ্ছে। বড়ো হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা। সেই সময় ক্লাসের ফাঁকে আকাশ দেখা শুরু। একটু একটু করে প্রেম এর ভালোলাগার নির্যাস টুকু গোপনে যত্নে রেখে দেওয়া ,,,,,
এ কে ডি স্যার এর তো তখন সব ক্লাসেই প্রেমিকা। সে একটা দিন গেছে বটে। তবে জান পরে বড়ো হয়ে ফিলজফি ,, তারপর সাইকোলজি পড়তে পড়তে মনে হয়েছিল মেয়ে রা প্রথম ভালোবাসে তার বাবাকে। পরে শিক্ষক কে।। তুমি লক্ষ্য করে দেখবে মেয়ে রা সব কিছুতেই তার বাবার কিংবা প্রিয় টিচারের কিছু কিছু বিষয় তার স্বামীটির সঙ্গে মেলাতে চায় । কখন কখনও কমপেয়ার ও করে।। আমার প্রথম ভালোলাগা ছিল এস কে বি আর স্যার। যা কোনও দিন কাউকে ই বলি নি। ওনার পড়ানোর স্টাইল, স্মার্টনেস আমাকে মুগ্ধ করেছিল। বিজ্ঞান আমার ভাল লাগত না কিন্তু ওনার পড়া আমি মন দিয়ে শুনতাম। খুব কষ্ট করে পড়েও আসতাম। উনি পড়া ধরলে যেন পড়া বলতে পারি।
বিজ্ঞান আমার জন্য নয় বুঝতে পেরেছিলাম। অংক র ক্লাসে চৌবাচ্ছার জলের অংক মেলাতে চেয়েছিলাম জীবন দর্শন এর সঙ্গে। পাঁজরের কোণায় কোণায় সবটুকু ভালোবাসা ভর্তি করতে জীবনের কতটা যন্ত্রণা নিংড়ে দিতে হয়,,, কতটা সময় চলে যায়,
সেটা ভাবতাম।
বাঁশের ঐ বাঁদর টার মতো এগিয়ে যাওয়ার পর কতটা পিছোলে, এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটাই আর থাকে না।। সেটাই মেলানোর চেষ্টা করতাম।
কত কিছুই ভাবতাম সেই সময় ।। পঁয়তাল্লিশ মিনিট খুব ভালো করে মন দিয়ে ভর আর ভারের পার্থক্য শোনার পর গোপ স্যার কে একটা প্রণাম করে কাঁচুমাচু মুখ করে বলেছিলাম স্যার বিজ্ঞান আমার জন্য নয়। আমি না হয় মন নিয়ে ই পড়াশোনা করি?
এইসব কথা কেন বললাম জান? আমি বিজ্ঞান এর স্টুডেন্ট ছিলাম না। তাই টেনেটুনে কোনও রকম এ পাশ করতাম। তাও এস কে বি আর স্যার আমাকে কত্ত ভালবাসতেন! চিনতেও পারেন এক কথায়।
গোপ স্যার আমাকে দেখলেই শম্পু উউউউউ বলে ডাকবেন।
কি করে সম্ভব হয় জানি না।। আমাদের টিচার রা এ এমন ই ছিলেন গো। তুমি যদি 17 সালের রিইউনিয়ন এ যেতে। খুব বড়ো একটা ব্যাপার মিস করে ফেললে । তারপর অনেকেই পট পট করে চলে গেলেন। কি যে আনন্দ হয়েছিল কি বলব। আমার মিশন ফরাক্কা যদি পড়। কিছুটা বুঝতে পারবে। এত ভালোবাসা প্রতিটি স্টুডেন্ট এর প্রতি। সত্যিই আমরা ভাগ্যবান। শেষ বয়েসে আমাদের স্মৃতি রোমন্থন এর একটা বিষয় রয়েছে , এটা ভেবেই কি যে ভাল লাগে!
আমার আবার সবথেকে ভাল এবং প্রিয় বন্ধু ছিল আমার বাবা তারপর আমার ভাই। আমার মা কোনও দিন সেভাবে আমার ভাল বন্ধু হয়ে উঠতে পারে নি।
মাকে খুব ভয় পেতাম আমি।
আমাকে এত শাসনে রেখেছিল সারাটা জীবন যে মাকে কোনও দিন আমি বন্ধুই ভাবতে পারি নি। চেষ্টা করতাম, আমার তো কোনও বোন বা দিদি ছিল না, তাই ওদের অভাবটা মিটিয়ে নিতে চাইতাম।
আসলে মা সব সময় আমাকে একটা শাসন, একটা কঠিন নিয়মের মধ্যে বেঁধে রাখতে চেয়েছিল।
কোনও সময় আমি বাঁধন আলগা করতে পারতাম না।
খুব ছোট বেলাটা আমার একদমই ঠিকঠাক ছিল। দারুণ কাটিয়েছি কিন্তু আমার সেই ছোট্ট মেয়েবেলা। যা আজও মনের ভেতর জ্বলজ্বল করে।
কিন্তু একটু বড়ো হতেই। আমার চেনা পৃথিবীটা যেন আচমকাই অচেনা হয়ে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে নয়। হঠাৎ ই। তাই কষ্টটা বেশি পেয়েছিলাম।
কারোর সঙ্গে গল্প করা যাবে না, বারান দাঁড়ালেই ঘরে ডেকে নিত। কোনও আত্মীয়স্ব।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।