|| মানচিত্র আর কাঁটাতার, হৃদয় মাঝে একাকার || বিশেষ সংখ্যায় সমর সুর

বাঙাল মাষ্টার 

এবছর পাড়ার ছেলেরা ক্লাবে বসে সিদ্ধান্ত নিল এবার পনেরই আগষ্ট পতাকা উত্তোলন করবে পাড়ারই কোন সিনিয়র মানুষ।এবার আর কোন নেতাহাতা বা সিরিয়াল নাটকের লোকজন নয়।মোদ্দাকথা কোন সেলিব্রেটি নয়। কারন এই লকডাউনে কাউকে না আনাই ভাল বেশি ভীড়ভাট্টা হলে আবার পুলিশি ঝামেলায় পড়তে হবে। তারচেয়ে বড়কথা ঠিকও নয় এবছর সবাই এবিষয়ে সহমত হয়ে খোঁজ নিতে লাগল পাড়ার সবচেয়ে সিনিয়র মানুষটা কে ! যে স্বাধীনতার দিন দেখেছে।অন্তত তিনি তখন কিশোর ছিলেন।এই কথা শোনামাত্রই একজন বলে উঠল কেন আমাদের বাঙালদাদু মানে আশুকাকুর বাবা বাঙাল মাষ্টারতো আছেন।নাইনটি টুতে এখনও চুটিয়ে ব্যাটিং করছেন। ব্যাস এই কথা শেষে হতে না হতেই ছেলেরা সব বলে উঠল চল চল এখনই আশুকাকুর বাড়ি যাই।
দল বেধে সব আশু মিত্রির বাড়িতে ঢুকতেই বাড়ির লোকজন বেশ ঘাবড়ে গেল।কি হল একবারে আটদশ জন ছেলে হঠাৎ একসাথে বাড়িতে ঢুকে পড়ল।কি হল আবার এইসময় কেউ কারোর বাড়িতে ঢুকে পরা মানেই চিন্তার বিষয়।আবার ভাবল হয়ত করোনা নিয়ে নতুন কিছু বলবে নাকি ! সে যাই হোক আশুকাকু বলে ডাকার আগেই আশুকাকু বাইরে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল কি ব্যাপার রে ? তোরা হঠাৎ কেন?
— কাকু আমরা এবছর ঠিক করেছি এবার পনেরই আগষ্ট দাদু আমাদের পাড়ার ক্লাবের স্বাধীনতা দিবসের পতাকা তুলবেন।
— সেতো ভাল কথা কিন্তু বাবার যাওয়া কি ঠিক হবে এবয়সে ! চারিদিকে যা অবস্থা মনে হয় ঠিক হবে না !
এইকথা শোনমাত্র প্রায় একসাথে সবাই বলে উঠল আরে দাদু এখনও আমাদের চেয়েও ষ্ট্রং।রোজ সকালে এখনও মর্নিংওয়াক করেন।তাছাড়া সোশ্যাল ডিসট্যান্সও থাকবে।দাদু যেন রেডিই ছিল এইসব শুনে পাশ থেকে বলে উঠল
অ কস কি তোরা? পতাকা তুলুম ! হালা তোগো এই স্বাধীনতা আমাগোই তুইলে দিইলো ঐ দ্যাশ থেইক্যা?
দাদুর এইকথা শোনামাত্র ছেলেরা অতি উৎসাহে বলে উঠল হ্যা দাদু তুমিই এবার পতাকা তুলবে। হ,হ তুলুম আমি যামু কয়ডায় যাইতে হইবো?
— সকাল দশটা।
ছেলেরা খুশি হয়ে চলে এল। তিনদিন পরেই ক্লাবের ফাঁকা মাঠে সব রেডি হয়ে গেল।পতাকা ফেস্টুন ফুল মালা দিয়ে সাজানো হয়েছে মাঠ।ঝোলানো হয়েছে মনিষীদের ছবি। হালকা হাওয়া বইছে।আকাশও মেঘলা এখনতো বর্ষার সময় পাড়ার লোকজন হাজির হলেন মাঠে।নাকে মাক্স জড়িয়ে মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। অনেকেই পাতা চেয়ারে বসে আছেন। অনেকেই জানে এইদিন ক্লাবের ছেলেরা কিছুনা কিছু করেই ফলে উৎসাহ সবার ভিতরে আছে দেখার জন্য। ছোটদের উৎসাহ আরো বেশী ওরা জানে পতাকা বাঁশের মাথায় উঠে গেলে বলতে হবে বন্দেমাতরম্ ব্যাস তারপরেই লজেন্স আর পাট কাটির মাথায় কাগজের পতাকা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি সারাদিন ছুটি ।
যথা সময়ে মাঞ্জা দেওয়া ধুতি পাজ্ঞাবি পড়ে হাজির হলেন বাঙাল মাষ্টার। ছেলেরা এগিয়ে নিয়ে একটা চেয়ারে বসিয়ে বলল এখানে বসুন দাদু আর দশমিনিট পরে শুরু হবে। তারপর ঠিক দশটা বাজলেই পতাকা উত্তোলন করবেন। একথা শুনেই বাঙালমাষ্টার বলে উঠলেন হালা এইডা কি পোলামাইয়ার জন্মের সময় ঠিক দশডায় কইরতে হইবো।
— তা নয় সবাইকে দশটা বলা হয়েছে তাই।
–অ।
বলতে বলতেই দশটা বাজল বাঙাল মাষ্টার দড়ি টান দিয়ে পতাকা তুলেই বললেন বন্দেমাতরম্।সঙ্গে সঙ্গে একসাথে উচ্চারিত হল বন্দেমাতরম্ ধ্বনি। তারপর লাউড স্পিকারটা বাড়িয়ে দিয়ে একজন বলল এবার আপনি কিছু বলুন দাদু।লাউড স্পিকারটা হাতে দিতেই মাঠের মধ্যেই দুএক জন ফিসফিস করে বলতে শুরু করল যাক এবার জমে যাবে।দাদুর বাঙাল ভাষার ভাষণ।সঙ্গে সঙ্গে অন্য একজন বলে উঠল নারে হবেনা।উনি যখন পড়াতেন তখন কিন্তু বাঙাল শব্দে বলতেন না।তবে মাঝে মাঝে দুএকটা বেরিয়ে যেত।মাতৃভাষায় যে শিকড়ের টান তা তিনি ছাড়বেন কি করে বলতে বলতেই মাষ্টার মানে দাদু শুরু করলেন বলতে আজ স্বাধীনতা দিবসে আমারে পতাকা উত্তোলন করতে দিছে বলে আমি গরবিতো। তবে আজ বড় দুখের দিন।সারা পৃথিবীটই অসুস্থ মৃত্যুমিছিল। জানিনা আর কত মানুষ মারা যাবেন আর কত মানুষ অনাহারে থাকবেন তবুও দিবসটা যখন মানা হয় মর্যাদার সঙ্গে। কিন্তু স্বাধীনতা দিবস না বলে যদি দানপত্র দিবস হতো তা হইলে ভালা হতো।কারন আমার কাছে ক্যান আমাগো মতো অনেকের কাছেই বড় দুখের দিন আজ।এই সব আজকের দিনে এই প্রজন্মের ছেলেমাইয়ারা বুঝবো না। দ্যাশ হারানো যন্ত্রণা স্বজন হারানো ব্যাথা। সব কিচ্ছু ছাইড়া রিফিউজি হইয়া থাকার যন্ত্রণা যে কি !অন্ন নাই বাসস্থান নাই যেন সবার চোখে দয়ার পাত্র।দেশ ভাগের দোষটা কী আমাগো ! কি পাইলাম অবহেলা,ঘৃণা, দয়া,ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া।কতকষ্টে আমরা যহন এদেশে আইস্যা নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা কইর‍্যা লইছি তবুও আমাগো বাঙাল বইলা টিটকারি দিতে ছাড়ে না।কই এই বাংলায়তো কত জিলার কত রকম ভাষা কই তারে লইয়া কেউতো টিককিরি দিতে শুনি না।যাক এইটুকুই ভাল লাগে স্বাধীনতার আগেও ভারতবর্ষে ছিলাম আজও ভারতবর্ষেই আছি আমাগো পতাকা পাল্টাই নি।
বলতে বলতেই অঝরে বৃষ্টি নামল।ঘোষক ছেলেটি তাড়াতাড়ি লাউডস্পিকারটি হাতে নিয়ে বলতে থাকল কেউ যাবেন না সবাই ক্লাব ঘরের ভিতরে চলে যান।অনুষ্টান এখনও কিছু বাকি আছে। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে কাগজের জাতীয় পতাকাগুলো ভিজে ল্যাতপ্যাত করছে আর ছোটছোট ছেলেমেয়েরা পতাকাগুলো ভিজে যাওয়ার জন্য তাদের পাটকাটির দিকে তাকিয়ে মুখগুলো বেজার করে দাঁড়িয়ে আছে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।