Mon 20 October 2025
Cluster Coding Blog

ক্যাফে গল্পে প্রদীপ গুপ্ত

maro news
ক্যাফে গল্পে প্রদীপ গুপ্ত

লোকটা

নদীর বুকে তিন চারটা পাথর মিলে যেন ওর জন্যই থাকার মতো একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো। পাথরের সেই খাঁজ থেকে বেরিয়ে এলো লোকটা। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে জঙ্গলের ভেতর একটা ভাঙাচোরা প্রাচীন মন্দিরের সিঁড়িতে এসে বসে মানুষটা। তখন সবে আকাশে চাঁদ উঠেছে। আর মন্দিরের চাতাল ভরে আছে রাঙা পলাশে। লোকটা যে কে, কেন, কবে, কীভাবে এখানে এসে পৌঁছেছিল সেটা অনেক মাথা খুঁড়েও সে মনে করতে পারেনি। আসলে মনে করবেই বা কীভাবে? মন বলে যে কোনো একটা বস্তু আছে, সেটারই তো নাগাল পায় না সে। কাজেই ওর কাছে বেঁচে থাকাটা যেমন অর্থহীন, মরে যাওয়াটাও সেরকমই নিরর্থক। ক্ষুধাতৃষ্ণাবোধ বলে যে কিছু একটা আছে, সেটা যে কখনও একেবারেই জানান দেয় না অথবা দেয় মানুষটা এসবের ঊর্ধ্বে। নদীর জলের ছলাৎ শব্দ শুনে হয়তো ওর গলায় গান আসে। কিন্তু মনে কোনো শব্দ বা সুর আসে না। যেহেতু ওর মনে কোনো ভাষার ছলনা নেই, কাজেই গলা দিয়ে যে কখন কী শব্দ বেরোয়, সে সেটা জানে না। হয়তো সেটা গান, হয়তো সেটা রবিঠাকুরের কবিতা অথবা হয়তো সেটা গোঙানির শব্দ। সেটা যে আদপেই কী, সেটা বোঝার মতো ওর কোনও উপায়ই নেই। ওর কাছে মানুষও যা, কাঠবেড়ালিও তাই।
লোকটা ধীরে সুস্থে মন্দিরের চাতালে উঠে আসে। চাতাল জুড়ে লালরঙা পলাশ ছড়িয়ে আছে। ও পলাশগুলোকে কাঁচিয়ে এক জায়গায় জড়ো করতে থাকে। কেন করছে সেকথা ও জানেও না, অথবা জানার কথাও নয়। চাতালের ওপর পলাশগুলোকে স্তুপ করছে লোকটা। চাঁদটা -- না সে তখনও পূর্ণিমার পুর্ণতা পায় নি। সেসবে অবশ্য মানুষটার কোনও মাথাব্যথা নেই। চাঁদটা আলো ঢালছে ভেঙেচুরে যাওয়া জীর্ণ মন্দিরটার চূড়ায়। সেখান থেকে আলোটা -- দুধরঙা আলোটা -- কালোবরণ গাইয়ের ঘন, আঠালো দুধের মতো পিছলে, গড়িয়ে গড়িয়ে মন্দিরের গা বেয়ে মেঝেতে এসে পড়ছে। লোকটার হঠাৎ যেন তৃষ্ণা পেলো। প্রচন্ড তৃষ্ণা। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। ও ঘন কুয়াশার মতো জ্যোৎস্নাকে দু হাতের আঁজলা ভরে নিচ্ছে। তারপর সেই আঁজলাকে তুলে আনছে ওর তৃষ্ণার্ত ঠোঁটের কাছে। ওর দু'হাত থরথর করে কাঁপছে। আঁজলার আঙুলের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পড়ছে জ্যোৎস্না। ওর তৃষিত দু'ঠোঁটের কষ বেয়ে পিছলে যাচ্ছে কুয়াশার মতো তৃষ্ণার জল। ওর তৃষ্ণা ক্রমে ক্ষুধায় রূপ নিচ্ছে। ও জড়ো করা পলাশের স্তুপে ঢেলে দিচ্ছে দুধরঙা আলোর প্লাবন। দুহাত দিয়ে মেখে নিচ্ছে দ্রুত। ওর ক্ষুধিত মন পরম আদরে তৈরি করে নিচ্ছে ওর ক্ষুধার গ্রাস। মূহুর্তের জন্য ও যেন ছিটকে পড়ে মন্দিরের দাওয়ার ওপর থেকে। ওর সামনে আবছা মতো কী একটা যেন এসে দাঁড়ায়। ওকে যেন বলে ওঠে -- তুই অবিকল তোর ঠাকুর্দার মতো দেখতে রে খোকা। খুব ভয় হয় -- তুই আবার ওঁর মতো শেষ বয়েসে সংসার ছেড়ে বিবাগী হয়ে যাবি না তো? ও কিছু বুঝে উঠতে পারে না। ওর মনে হতে থাকে, ও যেন দু'হাত দিয়ে ওর মাথার চুল ছিঁড়ছে। মনে হয় যেন। কিন্তু কি যে মনে হয়, সেটাই মনে করতে পারে না মানুষটা। ও মনে করতে পারে না -- কী যেন পেয়েছিলো ওর। দু'হাতের আঁজলা ভরে কী যেন -- কী যেন --। মন্দিরের চাতালের কী গুলো যেন কী দিয়ে যেন -- কিছুই -- আসলে কিছুই যে ও -- আসলে মন বলেই তো মানুষটার কিছু -- হঠাৎ ওর বেশ ঠান্ডা বোধ হচ্ছে। বোধ হচ্ছে! কীভাবে? তাহলে কি মানুষটার বোধশক্তি ফিরে আসছে --? এখন নদীর জলে ওর শরীর। ধীরে ধীরে গভীর থেকে আরও গভীরে ওর শরীর, ও বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে। একটা স্রোত, ভীষণ স্রোত, পাথর থেকে পাথরে ওকে, ওর শরীরটাকে নিয়ে আছাড় মারছে। ও ভয় পাচ্ছে, ওর ব্যথা লাগছে। কতদিন পর যে ওর ভয় পেলো, কতদিন পর যে ওর ব্যাথা করছে। ও মৃত্যুর ভয় পাচ্ছে। হঠাৎ ওর গলা থেকে একটা আর্ত চিৎকার বেড়িয়ে এলো। ওর নিঃসাড় মনে বোধ ফিরে আসছে। জলের গভীর থেকে শেষ বুদবুদটা উঠে আসার সময় মানুষটার মনে পড়লো সংসারের কথা। যে সংসার মনের খবর রাখে না, শুধু ব্যস্ত থাকে জ্যামিতিক সমীকরণ মেলানোর চেষ্টায়।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register