- 10
- 0
এদিকে ড্যানিশ কোম্পানির এমন প্রহসনমূলক বিচারে বাড়তে থাকলো স্থানীয় মানুষদের ক্ষোভের পরিমাণও। অবশেষে ১৮০৩ সালে কোম্পানির উদ্যোগে শ্রীরামপুরে তৈরি হল কোর্ট আর জেলখানা। জজ ও ম্যাজিস্ট্রেট পদে বসলেন মিঃ বয়েক সাহেব। তিনিই শ্রীরামপুরের প্রথম নিরপেক্ষ ও বিচক্ষণ বিচারক। তাঁর বিচারপদ্ধতি ছিল দেখবার মতোন। নিজে ঘুষ নেওয়া তো দূরস্থ, কোনও কর্মচারী ঘুষ নিয়েছেন শুনলে তাঁর শাস্তি ছিল কড়া। শোনা যায় একদল দুর্ধর্ষ ডাকাত আশপাশের গ্রামে ডাকাতি করে বেড়াত নিয়মিত। মিঃ বয়েক এদের প্রত্যেককে ধরে বন্দী করে উচিৎ শাস্তি দিলেন। তাঁর আমলেই শ্রীরামপুরে ধীরে ধীরে কমতে থাকলো চুরি ডাকাতির মতো অপরাধমূলক কাজ। তাঁর অবসরগ্রহণের পর ম্যাজিস্ট্রেটের পদ সামলালেন মিঃ হর্লেনবার্গ। বিচক্ষণতায় এনারও জুড়ি মেলা ভার।
বাংলায় নীল চাষের কাহিনী আর কে না জানে। নীলকর সাহেবদের অত্যাচার এমন জায়গায় পৌঁছোয় যে ইংরেজ সরকার বাহাদুরকেও সে বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে হয়। ব্রিটিশদের এই কালো অধ্যায় আজও বাংলা ও বাঙালীর কাছে ঘৃণার ইতিহাস। কিন্তু সে তো অনেক পরের কথা। একসময় ভাগীরথীর তীর ঘেঁষে জন্মাত প্রচুর নীল গাছ। আজও জন্মায়। কিন্তু ক'জন আর আজ চেনে তাকে। সেযুগেও কেউ চিনতো না। যিনি প্রথম ব্যবসার জন্য এই গাছকে চিহ্নিত করেছিলেন, তিনি প্রিন্সেপ সাহেব। ড্যানিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কুঠির কর্মচারী। হ্যাঁ, বাংলার কুখ্যাত নীল চাষের জন্মভূমিও এই শ্রীরামপুরই। তারপরে এই বিপুল লাভের পরিমাণ দেখাদেখি ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির উদ্যোগে দিকে দিকে শুরু হয় এই চাষের রমরমা। প্রিন্সেপ সাহেব গঙ্গার তীরে ফলে থাকা অসংখ্য নীল গাছ থেকে নীল সংগ্রহ করে তা রপ্তানি করা শুরু করেন ডেনমার্কে। ইউরোপের বাজারে একসময় ভারতীয় নীলের চাহিদা আকাশ ছোঁয়। পরে শ্রীরামপুরের সাথে সাথে নীল চাষ শুরু হয় বাঁশবেশিয়া আর চুঁচুড়াতেও। মুহূর্তে কোম্পানির লাভের অংক বাড়তে থাকে চড়চড় করে। সুযোগও যেন আকাশ ফুঁড়ে হাজির হয় কোম্পানির ঘরে। নীল বানিজ্যে সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে বাঁশবেড়িয়ার রাজার কাছে ১৭০০ বিঘা জমি আদায় করে কোম্পানি। শুধুমাত্র নীল চাষের জন্য। পরিবর্তে বিঘাপ্রতি ১ টাকা পাট্টা। এরপরের দিনগুলো সকলেরই জানা। নীল চাষ শুধু থেমে থাকেনি গঙ্গার তীরেই। ব্রিটিশ কোম্পানি সারা বাংলায় ছড়িয়ে দেয় নীলের বীজ। আর সেই বীজ ফুটে বেরিয়ে আসে এক একজন নীলকর সাহেবের কুখ্যাত আগ্রাসন। এদিকে গর্জে ওঠেন দীনবন্ধু মিত্র। তাঁর নীলদর্পণ নাটক চোখ খুলে দেয় বাঙালীর। কিন্তু ড্যানিশ কোম্পানির হাতে যে নীলচাষের গোড়াপত্তন হয়েছিল, তার চরিত্র যে ব্রিটিশদের মতো ছিল, তা কখনোই নয়। ড্যানিশরা চিরকালই নির্ঝঞ্ঝাট আর শান্তিপ্রিয়। তাদের চোখে লেগে নেই ব্রিটিশদের মতো সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বপ্ন। শ্রীরামপুরের গণ্ডীর বাইরে আর কোনও অঞ্চল তাদের চিন্তাভাবনার মধ্যেও নেই। মানদণ্ডকে রাজদণ্ড করে নি তারা। যে ভাবনা নিয়ে সর্টম্যান সাহেব এসে পৌঁছেছিলেন শ্রীরামপুরে, পরবর্তী সময়েও সেই উদ্দেশ্য থেকে এতটুকু বিচ্যুত হয় নি তারা। তাই সমগ্র শ্রীরামপুর শহরটা আজও সাক্ষী দিয়ে যায় প্রায় এক শতাব্দীকাল ইউরোপীয় শাসনের। কারাগৃহ থেকে সরকারী ভবন, গীর্জা থেকে ছাপাখানা, সবই আজও সেযুগের ক্লাসিক ইউরোপিয়ান এবং ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যের স্পষ্ট জানান দেয়।
0 Comments.